×

জাতীয়

দায় এড়াতে পারে না কেউ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০১৯, ০২:৫৯ পিএম

দায় এড়াতে পারে না কেউ
রাজধানীর বনানীর এফ আর (ফারুক রূপায়ণ) টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সামনে চলে এসেছে এর অব্যবস্থাপনার নানাদিক। বিশেষ করে ভবন নির্মাণে ত্রুটি, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, সরু সিঁড়ি, ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা ভবন নির্মাণসহ বেশ কিছু অসঙ্গতি চিহ্নিত হয়েছে। তবে এসব অসঙ্গতি দেখভাল, তদারকি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে যাদের উদ্যোগী হওয়ার কথা তারা কেউই নিজেদের দায়িত্ব পালন করেননি। সবাই ছিলেন উদাসীন। বৃহস্পতিবার মর্মস্পর্শী অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের প্রাণহানি এবং শতাধিক আহতের পর দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষই ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও অসঙ্গতিগুলো সামনে নিয়ে আসে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের কেউই ব্যর্থতা এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায় এড়াতে পারেন না। এমনকি ভবন মালিক, ব্যবহারকারী ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি ওইসব উদাসীন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের ছাড় দেয়া যাবে না। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এখন বলছে, অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কার কথা জানিয়ে ওই ভবন মালিককে তিনবার নোটিস দেয়া হয়। তবুও তারা আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখেনি। প্রশ্ন উঠেছে, শুধু নোটিস দিয়েই কি ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে? নোটিস উপেক্ষা করায় তারা কেন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। রাজউক ২৩ তলার অনুমোদন দেয়নি দাবি করছে, তবে অনুমোদনবিহীন তলাগুলো নির্মাণের পরও তারা কেন নীরব ছিল? সিটি করপোরেশন কিভাবে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে এবং সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কেন তদারকি করেনি- এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে? জানা গেছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ মতে বহুতল ভবন নির্মাণে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, ট্রাফিক পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল এভিয়েশন), বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, তিতাসসহ ১৩টি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি না হলে ওই ভবন ত্রুটিপূর্ণ বলে চিহ্নিত হয়। বনানীর এফ আর টাওয়ার এই বিধিমালা প্রণয়নের আগে নির্মিত হওয়ায় তারা রাজউক, সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের দারস্থ হয়েছে মাত্র। ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজউকের ইমারত পরিদর্শক আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু দুটি বেইজমেন্টসহ ২৩ তলা এই ভবন (সম্প্রসারিত) অনুমোদন করেন। এমনিতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫৬টি। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেছেন, কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে শুধুমাত্র সতর্কীকরণের মধ্য দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে সেবা সংস্থাগুলো। যথাযথ আইন প্রণয়নই শুধু নয়, তা মানতে নগরবাসীকে বাধ্য করাও রাষ্ট্রের কর্তব্য। বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. মাকসুদ হেলালী বলেছেন, বিল্ডিং কোডে অগ্নিনির্বাপণ বিভাগের মহাপরিচালকের অনেক ক্ষমতা দেয়া আছে, তিনি চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। আবার রাজউকও ওই ভবনে তালা ঝুলাতে পারত। এমনকি সিটি করপোরেশন ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেয়, তারাও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু কেউই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, ১৯৯৬ সালে ১৮ তলা এফ আর (ফারুক রূপায়ণ) টাওয়ার নির্মাণের অনুমোদন হয়। ২০০৫ সালের আরেকটি কপি দাখিল করে ভবনটি ২৩ তলা করার কথা বলা হয়। বিষয়টি সন্দেহ হলে তদন্ত করা হয়। তদন্তে দেখা যায় ২৩ তলার ব্যাপারে রাজউকে কোনো ডকুমেন্টস নেই। ফলে তাদের পরের নকশা সঠিক নয়। তাই পরবর্তীতে ব্যবস্থা না নেয়ায় রাজউক কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন, বনানীর অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটি গাফিলতির মাধ্যমে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড। জড়িতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) তাজুল ইসলাম বলেছেন, শুধু এফ আর টাওয়ার নয়। রাজধানীতে আরো যেসব ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবন আছে সেগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়ে যৌথভাবে কাজ করা হবে। যারা নিয়ম অমান্য করে ভবন বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখানো হবে। ঢাকা (উত্তর) সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশন বহুতল ভবনের আনুষঙ্গিক কাগজপত্র রাজউকের কাছে চেয়ে পাঠিয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে সব ভবনের কাগজপত্র সিটি করপোরেশনকে দিতে হবে। এরপর বাড়ি বাড়ি নোটিশ পাঠানো হবে। বহুতল ভবনগুলোর ফায়ার সেফটি ও ভবন সেফটির কাগজপত্র রেডি রাখতে জনস্বার্থে নোটিশ দেয়া হবে। নোটিশে কাজ না হলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান শুরু করবে। অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এবং রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেছেন, এফ আর টাওয়ার নির্মাণে গাফিলতি ও ব্যত্যয়ের দায় রাজউক এড়াতে পারে না। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল জুলফিকার রহমান বলেছেন, ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট বেইজমেন্টে একটি গাড়ি থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ায় আহত হয় ২০ জন। দুই ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ওই ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি জেনে ফায়ার সার্ভিস থেকে তিনবার নোটিশ দেয়া হয়। তবে তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ৭ তলার উপরের ভবনকে বহুতল মনে করে। রাজউক মনে করে ১০ তলার উপরের ভবন বহুতল। দুই কর্তৃপক্ষের দুই মত। তবে কোনো ভবন নির্মাণে ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা অমান্য করা হলে শুধু নোটিশ দেয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ্যাকশন নিতে পারে রাজউক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App