×

মুক্তচিন্তা

আগুনের উত্তাপ একই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৯, ০৮:৩৫ পিএম

এই অবস্থা চলতে পারে না। চলতে দেয়া যায় না। মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। আমরা এক ধরনের অসৎ এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। কে কাকে কীভাবে টেক্কা দিতে পারব, কীভাবে একজনকে পেছনে ফেলে আর একজন এগিয়ে যেতে পারব, সে চেষ্টায় আমরা এতটাই বেপরোয়া যে হিতাহিত জ্ঞানও কখনো কখনো তিরোহিত হচ্ছে। নিজের দরজায় যতক্ষণ বিপদ এসে কড়া না নাড়ছে ততক্ষণ আমরা হুঁশে ফিরছি না।

মাত্র এক মাস কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণ গেছে কমপক্ষে ৭০ জনের। আহত হয়েছেন অনেকে। তখন বলা হয়েছিল, পুরান ঢাকায় দাহ্য পদার্থের মজুদ বা বেচাকেনার কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটে। রাস্তাঘাট সরু হওয়ায় আগুন নেভানোর কাজ দ্রুততর করা যায় না। তাই প্রাণহানিসহ অন্য ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়।

২০ ফেব্রুয়ারির আগুনে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির শোক ও বেদনা ভুলতে না ভুলতেই বনানীর একটি বহুতল ভবনে ২৮ মার্চ ঘটল আরেকটি মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। কত জন মারা গেলেন বনানীর ২২ তলা এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগে, তারচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় নতুন নির্মিত একটি ভবনে আগুন লাগল কী করে এবং আগুনের এমন বিস্তৃতিইবা ঘটল কীভাবে?

এই প্রশ্নের জবাবের জন্য আকাশ-পাতাল অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। ভবন মালিক ভবন বানিয়েছেন, ভাড়া দিয়েছেন, এককালীন মোটা সেলামি নিয়েছেন, মাসে মাসে ভাড়ার টাকা গুনছেন, কিন্তু ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি একবারো বিবেচনা করেননি। ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই জরুরিভাবে ভবন থেকে বের হওয়ার কোনো বিকল্প উপায় বা পথ। মালিক এসব দিকে নজর দেননি, কিন্তু ভাড়াটেরা কী করেছেন? তারা কী নিজেদের নিরাপত্তার কথাটা নিজেরা একবারো ভাবেন না?

আগুন লাগার ঘটনা এই প্রথম ঘটল তা নয়। আগুন প্রায়ই লাগছে। আগুন লাগছে বস্তিতে, লাগছে পুরান ঢাকায়, লাগছে বাণিজ্যিক বহুতল ভবনে, দোকানপাটে, গুদামে, আবাসিক ভবনে, শহরে-গ্রামে কোথায় নয়? বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা সিগারেটের আগুন বা আর যে কারণেই আগুন লাগুক না কেন, মোটা দাগে এটা বলা যায়, অসাবধানতার জন্যই মূলত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। শতভাগ দুর্ঘটনামুক্ত ব্যবস্থা হয়তো করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা একটু সাবধান-সতর্ক হলে অনেক দুর্ঘটনাই এড়ানো সম্ভব।

পুরান ঢাকায় আগুন লাগলে আমরা বলি, ওটা অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ও বেড়ে ওঠা এলাকা। তাই ওখানে আগুন লাগতে পারে, হতে পারে আরো নানা দুর্ঘটনা। প্রশ্ন হলো, পুরান ঢাকাকে পরিকল্পনার আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? কেন অব্যবস্থাপনা দূর করা হচ্ছে না? কেন নিরাপদ ও বাসযোগ্য করা হচ্ছে না পুরান ঢাকাকে? বাধা কোথায়, সমস্যা কোথায়? কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, মানুষের জীবন চলে গেলে আমরা কয়েক দিন এসব নিয়ে হৈচৈ করি, চিৎকার-চেঁচামেচি করি, তারপর আবার যথা পূর্বং তথা পরং। আমরা কেন সমস্যা সমাধান না করে সমস্যা নিয়ে বসবাস করতে ভালোবাসি, তার ওপর একটি সমাজতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক গবেষণা করা যেতে পারে।

আচ্ছা, পুরান ঢাকায় না হয় অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য দুর্ভোগ-দুর্দশা হচ্ছে, নাগরিক জীবন বিড়ম্বিত হচ্ছে, কিন্তু নতুন ঢাকায় কী হচ্ছে? বনানীতে কেন অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ হচ্ছে, হতে পারছে? যে এফ আর টাওয়ারে ২৮ মার্চ আগুন লাগল, এখন জানা যাচ্ছে সে ভবনটিও অনিয়ম করেই তৈরি করা হয়েছে। ১৮ তলার অনুমোদন নিয়ে ২২ তলা (আন্ডারগ্রাউন্ডসহ ২৩ তলা) ভবন বানানো হয়েছে? কীভাবে এটা সম্ভব হলো? রাজউক কি চোখে ঠুলি পরে আছে? রাজউকের পরিদর্শক টিম নেই? তারা কী করে? কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই ভবনের অনিয়ম-ত্রুটির বিষয়গুলো সামনে আসে? তারপর এগুলো প্রতিকারের ব্যবস্থা কেন হয় না? ঢাকার অধিকাংশ ভবনেই নাকি অগ্নিনির্বাপণ ও জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা নেই। কীভাবে তাহলে ভবনগুলো মাথা তুলে আছে? এগুলোর কোনো তদারকি প্রতিষ্ঠান নেই? কেন নজরদারি হয় না?

আমাদের দেশে আইন আছে, বিধিমালা আছে। কিন্তু আইন ও বিধিবিধান মানার বাধ্যবাধকতা নেই। আইন না মানার এমন স্বাধীনতা পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। এক হিসাবে জানা যাচ্ছে, গত ১৫ বছরে দেশে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। কীভাবে এই মৃত্যু, এই অপচয় আমরা মেনে নিচ্ছি? যতদিন যাচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যুর আশা যেন তত কমে আসছে। মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মরছে। এভাবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিছিল কেবল দীর্ঘ হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? নাকি এর শেষ নেই?

মানুষ কেন এত বেপরোয়া? গাড়ির চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাবেন। পথচারীরা পথ চলবেন বেপরোয়াভাবে। ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবেন বেপরোয়াভাবে? অতি মুনাফার আশায় খাদ্যপণ্যে ভেজালেও কারো কারো বেপরোয়া মনোভাব? বাড়ি বানাবেন কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে। বাড়ি ভাড়া বাড়বে বেপরোয়াভাবে। যিনি আইনের মানুষ আইন মানেন না, তার মধ্যে বেপরোয়া ভাব। কারণ তিনি জানেন, আইন না মানলে কিছু হয় না। আইন মানলেই বরং ক্ষতি। এই অবস্থা চলতে পারে না। চলতে দেয়া যায় না। মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। আইনের পথে আনতে হবে।

তার আগে যারা আইনের মানুষ অর্থাৎ আইন প্রণেতা এবং আইন প্রয়োগকারীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আপনি আচরি ধর্ম অপরকে শেখাতে হবে। আমরা এক ধরনের অসৎ এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। কে কাকে কীভাবে টেক্কা দিতে পারব, কীভাবে একজনকে পেছনে ফেলে আর একজন এগিয়ে যেতে পারব, সে চেষ্টায় আমরা এতটাই বেপরোয়া যে হিতাহিত জ্ঞানও কখনো কখনো তিরোহিত হচ্ছে। নিজের দরজায় যতক্ষণ বিপদ এসে কড়া না নাড়ছে ততক্ষণ আমরা হুঁশে ফিরছি না।

অপমৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আর এ কাজটি করার সক্ষমতা এখন বাংলাদেশে একজনেরই আছে, তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য দিন-রাত এক করে ক্লান্তিহীন কাজ করছেন। অগ্নিকাণ্ডের একেকটি ঘটনা ঘটছে আর তিনি রাত জেগে সবকিছু তদারকি করছেন। মানুষের করুণ মৃত্যুতে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তাকে এখন দুর্ঘটনা রোধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।

যারা আইন না মেনে বড় বড় ভবন বানাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন অমান্যকারীদের শাস্তি দিতে হবে। কোনো প্রকার তদবির-সুপারিশে আইন অমান্যকারীদের ছাড় দেয়া যাবে না। যিনি বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের বিচার করে দণ্ড কার্যকর করতে পারেন, যিনি একাত্তরে মানবতাবিরোধী-দেশবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারীদের দেশি-বিদেশি চাপ উপেক্ষা করে বিচার করে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে পারেন, তার কাছে আইন না মানা ব্যক্তিদের আইনের পথে আনা কোনো কঠিন কাজ হতেই পারে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন কার্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান প্রহরীতে পরিণত হয়েছেন। তার নজর, তার হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছুই সচল হয় না। তাই এখন দেশের মানুষের সব প্রত্যাশাই তার কাছে। তিনি জনপ্রত্যাশা পূরণে আপ্রাণ চেষ্টাও করছেন। বনানী অগ্নিকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই অনেক ধরনের পোস্ট দিয়েছেন। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও তুলে ধরেছেন।

সবাই যে কেবল সব কিছুর নিন্দা করেছেন তা-ও নয়। প্রশংসা করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অকুতোভয় ফায়ারফাইটারদের। তারা যেভাবে আগুন নেভানো এবং আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদে উদ্ধারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। আমাদের দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিসের মতো দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ হোক- এটা দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

আমরা চাই সব ধরনের পরিকল্পনাহীনতা দূর হোক, অব্যবস্থার অবসান হোক। আইনের প্রয়োগ হোক সবার ক্ষেত্রে সমান। নাগরিকরা শুধু আইন মানবে না, প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও আইনের অধীনেই চলতে হবে। ছড়াকার মাহবুবুল আলম কবীর তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন: ‘নামার ব্যবস্থা না রেখেই আমরা কেবল উপরে উঠতে চাই। আগুনও কিন্তু উপর দিকেই ওঠে। এ আমার এ তোমার পাপ।’ কবীর যথার্থই লিখেছেন।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App