×

বিশেষ সংখ্যা

মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০১৯, ০৩:০৬ পিএম

হঠাৎ করেই গুলির শব্দে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে পালানো, কেমন একটা থমথমে যেন ভাব। কিছু বুঝতাম না। তাকিয়ে থাকতাম বড়দের দিকে। আব্বা, গফুর দুলাভাই, দিলদার ভাই, রেন্টু ভাই, জান মোহাম্মদ (জানু কাকা) এরকম দু’চারটা নাম শুধু মনে পড়ে। তারা আব্বার খুব ভক্ত ছিল এবং আব্বার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আব্বার পাশাপাশি থাকতো। তা ছাড়া তারা আমাদের পরিবারে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। আম্মার কাছে তারা চাচি বা ভাবি বলে যে কোনো আবদার করতো। তারা মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিয়ে ট্রেনিং দেয়া শুরু করলো। মনে পড়ে একদিন সন্ধ্যার পর একটা গুলির শব্দ। চারদিকে কেমন একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। পরে জানা গেল দিলদার ভাইয়ের রাইফেল থেকে অসতর্কবশত একটা গুলি হঠাৎ করে বেরিয়ে গেছে, কেউ হতাহত হয়নি। কখন কি হয় এরকম একটা আতঙ্ক বড়দের মধ্যে সব সময় লেগে থাকতো। চারদিকে হতাশা আর আতঙ্ক। এর মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সবার রক্তের শিরায়-উপশিরায় বিদ্যুৎ গতিতে জাগিয়ে তুলতে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে এ দেশের সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে বাঁচাতে হবে, দেশকে স্বাধীন করতে হবে। এই ধারাবাহিকতায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মুজাহিদ বাহিনীর যে দলটি গড়ে উঠেছিল, সে দলটি শপথ নিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে দেশকে স্বাধীনতার অগ্রযাত্রায় শরিক হওয়ার। কোন এক গোপন সূত্র থেকে জানা গেল- রেলবাজার ইপিআর ক্যাম্পে কিছু অস্ত্র আসবে। অস্ত্রগুলো এসে পৌঁছালে মুজাহিদদের সেই অস্ত্রগুলো সরবরাহ করা হবে। আব্বার নেতৃত্বে মুজাহিদরা রেলবাজার ইপিআর ক্যাম্পে জড়ো হয়। সবার মধ্যে একটা উত্তেজনা। এই চলে আসবে অস্ত্র, এভাবে ৩ দিন পার হয়ে গেল। মুজাহিদদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, কখন আসবে অস্ত্র আর কখন ঝাঁপিয়ে পড়বে সম্মুখযুদ্ধে। ৪ দিন পর অস্ত্র এসেছিল (পরে জানা যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ থানায় অস্ত্র ভাণ্ডার ভেঙে এই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিল)। মুজাহিদ বাহিনীর দল এই অস্ত্র নিয়ে রাজশাহীকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাজশাহীর দিকে রওনা হয়ে যায়। উদ্দেশ্য পাকিস্তানি বাহিনীকে কোনোভাবেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে ঢুকতে দেয়া হবে না। মুক্তিযোদ্ধারা মেইন রোডের পাশ দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাজাবাড়ী পার হয়ে চাপালের কাছে গিয়ে রাত্রি নেমে আসে। দলটি তখন খুবই ক্ষুধার্ত। গ্রামের লোকজন খবর পেয়ে চুপি চুপি এসে খাবার দিয়েছিল। আব্বা যখন কথাগুলো বলছিল তখন গফুর দুলাভাই আব্বাকে আরো একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিলো। সবার খাওয়া শেষে একজন বৃদ্ধ মানুষ চাপাল থেকে ১০ মাইল দূর প্রেমতলী থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল। যখন শুনলো যোদ্ধাদের খাওয়া হয়ে গেছে এখন আর খাওয়া যাবে না, তখন লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল “বাবা তোমরা না খেতে পারলেও এই খাবারগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দাও যাতে শান্তিতে বাড়ি ফিরে যেতে পারি।” সেই রাত্রে একটু বিশ্রাম নেয়ার সময় কয়েকটি টর্চের আলো আর খটখট শব্দে কিছু লোক মেইন রোড দিয়ে এগিয়ে আসছে। এরা পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার শুরু করলে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আবার পেছন ফিরে রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা আবার রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট ও রেডিও সেন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে একগ্রুপ ক্যান্টনমেন্টের দিকে অন্য গ্রæপ রেডিও সেন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। আব্বা, গফুর দুলাভাইসহ একটি দল রেডিও সেন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সেদিন রাত্রে অনেক ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। দরজা-জানালাগুলো বৃষ্টির ঝাপটার সঙ্গে জোরে জোরে শব্দ হচ্ছিল। আম্মার কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আম্মার কান্না দেখে কিছু না বুঝে আমিও কাঁদতে লাগলাম। হঠাৎ করেই বাড়ির মেইন গেটে একটা বিকট শব্দ হলে আম্মা দৌড় দিল মেইন গেটের দিকে, আমিও পেছন পেছন দৌড়ালাম। আম্মা গেট খুলতেই দেখলাম আব্বা নিচে পড়ে আছে গোঁ গোঁ শব্দ করছে কোনো কথা বলতে পারছে না। আম্মা-আমি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। গফুর ভাই আব্বাকে ধরে উঠানোর চেষ্টা করছে। সেদিন রাজশাহী রেডিও সেন্টার থেকে পালিয়ে মাঠের ভিতর রাজাবাড়ী বসন্তপুর হয়ে ৩০ কি.মি. পথ ঝড় বৃষ্টির মধ্যে অস্ত্র, খাঁকি পোশাক ফেলে পালিয়ে এসেছিল। তখন গফুর ভাইয়ের বয়স কম বলে তাকে ঝড়-বৃষ্টি বা ৩০ কি.মি. পথ পালিয়ে এসেও একেবারে ঘায়েল হয়ে যায়নি। কিন্তু আব্বার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আম্মা, গফুর ভাই আব্বাকে গরম পানি ও গরম দুধ খাওয়ালে একটু চেতনা ফিরে আসে। সে রাত্রিতেই আব্বাকে ভারত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। শুনেছি ১৫-২০ দিন আব্বা কোনো কথা বলতে পারেনি। আব্বা খবর পাঠালো আমরা ভারত চলে যাবো। সে প্রেক্ষিতে আম্মা চার ভাইবোনসহ মহানন্দা নদীর ওপারে ছয়রশিতে মুসলিম ফুপার বাড়িতে উঠলাম ভারত চলে যাব বলে। এরই মধ্যে মো. মনজুর রহমান আমার ছোট চাচা এসে আম্মাকে খবর দিলো- ভারত চলে গেলে জমিজমা বেহাত হয়ে যাবে। আম্মা চিন্তায় পড়ে গেল। আপাতত ভারত যাওয়া বাতিল করে ছয়রশিতেই থাকতে লাগলাম। একদিন আমাকে আমার ছোট চাচা গোদাগাড়ির বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আমার মনে আছে সেদিন রাত্রে এরফান ভাই (বর্তমানে আড়ানি স্কুলের শিক্ষক) কোত্থেকে একটা হাঁস ধরে নিয়ে এসে রান্না করছিল। পরদিন সকাল বেলায় হঠাৎ ঠা ঠা গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এরফান ভাই বলল পাঞ্জাবিরা গুলি করতে করতে আসছে। শোনামাত্রই আমি কাউকে কিছু না বলে বাড়ির পেছন দিয়ে দৌড়াতে থাকলাম। আমার মনে হচ্ছিল গুলির শব্দগুলো কানের পাশ দিয়ে যেয়ে বাঁশঝাড়ের গায়ে লাগছিল। আমি ফটিক ভাইয়ের জমির ওপর দিয়ে হাটপাড়া হয়ে সোজা মহানন্দা নদীর পাড়ে চলে গেলাম। হাজার হাজার মানুষ মহানন্দা নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। যে নৌকাগুলো আছে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। হঠাৎ দেখলাম এক লোক একটা বাঁশের কঞ্চির বোঝা নিয়ে ভেসে যাচ্ছিল মহানন্দার ওপারে যাবে বলে। আমার মনে পড়ে মহানন্দা নদীর এপার-ওপার খুব বেশি দূর ছিল না। জলিল ভাই আমাকে ঐ কঞ্চির বোঝার ওপর বসিয়ে দিলো। এরই মধ্যে ওপারে যাওয়ার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্রসহ ঐ কঞ্চির বোঝার ওপর চেপে বসলো। কঞ্চির বোঝাটি কেমন টলমল করতে লাগলো। অস্ত্রের ঘসা আমার গায়ে লাগছে, আমি ব্যথা পাচ্ছি। তারপরও আমি খুব শক্ত করে কঞ্চির বোঝাটি ধরে রেখেছি। যে লোকটি কঞ্চির বোঝা ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল, সে লোকটি বোঝাটি ঠেলে নিতে পারছিল না। ফলে কঞ্চির বোঝাটি আস্তে আস্তে পদ্মা নদীর দিকে চলে যাচ্ছিল। পদ্মা নদীতে চলে গেলে কি হবে সেটা আমার ধারণা ছিল না তবে চারদিক থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। “কঞ্চির বোঝাটি ধরো ধরো।” পদ্মা নদীতে বোঝাটি চলে গেলে কি হতো সেটা আল্লাহই জানতেন। তবে এরই মধ্যে একটা নৌকা থেকে নৌকার মাঝি একটা দড়ি ছুড়ে মারলো, যে লোকটি বোঝাটি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তার দিকে। ঐ লোকটি তাড়াতাড়ি করে দড়িটি কঞ্চির বোঝার সঙ্গে বেঁধে দিলে কঞ্চির বোঝাটি ঐ নৌকার সঙ্গে সঙ্গে মহানন্দার ওপারে ভিড়লো। মহানন্দার ওপারে একলোক কঞ্চির বোঝা থেকে নামানোর সময় আমাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললোÑ তুই কঞ্চির বোঝায় উঠছিস কেন? আমি আবার কাঁদতে কাঁদতে ছয়রশিতে যেয়ে দেখি আম্মা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। এদিকে না বলে চলে আসায় আমাকে আমার ছোট চাচা এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছয়রশিতে এসে হাজির। আমার বাবা মো. আবদুর রাজ্জাক। তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলবো না তবে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বললাম না এজন্য যে, এখন কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, আর কে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এটা নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার প্রতিযোগিতা। যাইহোক আমার বাবা ৭নং সেক্টরে মেজর গিয়াসের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন রাজশাহী জেলাসহ এবং গোদাগাড়ী থানার বিভিন্ন জায়গায় তার নেতৃত্বে বিভিন্ন অপারেশনের গল্প আমি তার কাছ থেকে শুনেছি। এখন লিখতে বসে খুব আফসোস হচ্ছে এজন্য যে, আব্বা বেঁচে থাকতে যদি মুক্তিযুদ্ধের তার অভিজ্ঞতার আরো কিছু শুনে নিতাম তাহলে আমি এখন অনেক কিছু লিখতে পারতাম তাহলে লেখাটা হতো আরো সমৃদ্ধ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App