×

বিশেষ সংখ্যা

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা নিরন্তর শিল্পযাত্রা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০১৯, ০৩:৪৯ পিএম

উনিশশ একাত্তর। গত শতাব্দীতে সে ছিল এক অত্যুজ্জ্বল সময়। দীর্ঘ ন’মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে আমরা অর্জন করেছি মহামূল্য স্বাধীনতা। ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে...’। লাখো শহীদের প্রাণ, কোটি মানুষের ত্যাগ, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি গর্বিত লাল সবুজের পতাকা। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন-শোষণ, বৈষম্য-নিপীড়ন, সুপরিকল্পিত পৈশাচিক গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। মরণপণ সংগ্রামে তারা ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন একটি দেশের, সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, জন্মেছি এই দেশে।’ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। একইসঙ্গে স্বজন হারানোর বেদনায় অনিঃশেষ কষ্ট-যন্ত্রণা এবং মর্মবেদনারও কারণ। মুক্তিযুদ্ধ তার অনিবার্য প্রভাব ফেলেছে রাজনীতি-অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য সবখানেই। জাতির মননে চৈতন্যে মুক্তিযুদ্ধ এক অনির্বাণ প্রেরণা ও পাথেয়। বস্তুত, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, একাত্তরে ছিল চ‚ড়ান্ত ও রক্তক্ষয়ী পর্ব। আমরা দেখব, খোদ একাত্তরেই তখনকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশে যখন জনজীবনে বেঁচে থাকার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না, সেই আঁধারকবলিত ঘোর দুঃসময়েও রচিত হয়েছিল মুক্তিসন্ধানী কবিতা। কলম রেখে অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন অনেক কবি। প্রত্যক্ষ সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার রসনির্যাস, হৃদয়নিঃসৃত মর্ম সৌরভ সেসব কবিতায় অঙ্কিত, প্রতিফলিত, সগর্বে উদ্ভাসিত। যাঁদের জন্ম একাত্তর পরবর্তী সময়ে, তারাও অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শৈল্পিক ও প্রাণস্পর্শী অনেক কবিতা লিখেছেন। এই ধারা আজো অব্যাহত। একাত্তর তো আবেগ অহঙ্কারেরই ব্যাপার শুধু নয়, জাতির সার্বিক মহামুক্তির অর্জন এবং পবিত্র অঙ্গীকারও বটে। স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সঙ্গে রূঢ় বাস্তবতার ফারাক যে রয়েছে, তা অনেকের কবিসত্তাকেই পীড়িত হতাশ করেছে। সেটা স্বাভাবিকও বটে। স্বপ্নভঙ্গের নিষ্ঠুর বেদনাকে তাই উপজীব্য করেছেন কেউ কেউ। মুক্তিযুদ্ধ কখনো কোনো কালে শেষ হয় না। প্রগতি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা মানুষের লড়াই সংগ্রাম অহর্নিশ চলতেই থাকে। কেমন ছিল উনিশশ একাত্তরের সেই উত্তাল বিভীষিকার শ্বাসরুদ্ধকর বৈরী সময়? কেমন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি, ধরন-ধারণ, বৈশিষ্ট্য, রণকৌশল? নবীন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা, বীরত্ব, ত্যাগ তিতিক্ষা নিপুণ দক্ষতায় বিধৃত হয়েছে উজ্জ্বল আলোকিত, শিল্প সুষমামণ্ডিত আবেগঋদ্ধ সব কবিতাপঙ্ক্তিতে। ঘৃণ্য পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশি দোসরদের বর্বর নৃশংস পৈশাচিকতা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের দানবীয় নারকীয় চিত্রও ফুটে উঠেছে। সে এক আগুন সময়। উদ্বাস্তু, শরণার্থী মানুষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিগি¦দিকে ছুটছে, সব মিলিয়ে ভয়াবহ একটা ছবি। ওইসব লেখা পড়লে কষ্টে আতঙ্কে মর্মবেদনায় শিউরে উঠতে হয়। পাশাপাশি পাঠক মনে সঞ্জীবিত হয় গভীর দেশপ্রেমও। কবি জসীমউদ্দীন উনিশশ একাত্তরের ৬ জুলাই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শিরোনামে যে কবিতাটি লেখেন, তাতে সেই তাণ্ডব-সময়ের বিশ্বস্ত একটা চিত্র পাওয়া যায়। স্বল্পকথনে মুন্সিয়ানার সঙ্গে তিনি তৎকালীন অবরুদ্ধ বাংলার অনেকগুলো দিক তুলে ধরেছেন। কবি লিখছেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে, ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে। কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা। কখনো সে পশি ঢাকা-বেতারের সংরক্ষিত ঘরে, ক্ষেপা কুকুরের মরণ কামড় হানিছে ক্ষিপ্ত স্বরে। আমি চলিয়াছি চির-নির্ভীক অবহেলিত সবকিছু নরমুণ্ডের ঢেলা ছড়াইয়া পশ্চাৎ-পথ পিছু। ভাঙিতেছি স্কুল ভাঙিতেছি সেতু স্টিমার জাহাজ লরি খান-সৈন্যরা যেই পথে যায় আমি সে পথের অরি ওরা ভাড়া-করা ঘৃণ্য গোলাম স্বার্থ অন্ধ সব, মিথ্যার কাছে বিকাতে এসেছে স্বদেশের বৈভব। আমরা চলেছি রক্ষা করিতে মা-বোনের ইজ্জত শত শহীদের লোহুতে জ্বালানো আমাদের হিম্মত। ভয়াল বিশাল আঁধার রাত্রে ঘন-অরণ্য ছায়, লুণ্ঠিত আর দগ্ধ গ্রামের অনল সম্মুখে ধায়। তাহারই আলোতে চলিয়াছি পথ, মৃত্যুর তরবার হস্তে ধরিয়া কাটিয়া চলেছি খান-সেনা অনিবার। এ সোনার দেশে যতদিন রবে একটিও খান-সেনা, ততদিন তব মোদের যাত্রা মুহূর্তে থামিবে না। মাঠগুলি পুনঃ ফসলে ফসলে পরিবে রঙিন বেশ, লক্ষ্মী ঝাঁপি গড়ায়ে ছড়ায়ে ভরিবে সকল দেশ। মায়ের ছেলেরা হবে নির্ভয়, সুখ হাসি ভরা ঘরে, দস্যুবিহীন এ দেশ আবার শোভিবে সুষমা ভরে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিল্প সাহিত্যকে নতুন ঐশ্বর্য ও মাত্রিকতা দান করেছে। এই বিত্ত, এই বৈভব অতুলনীয় এক মহান প্রাপ্তি। উনিশশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যেমন সাহিত্যের গর্বিত বাঁক বদল ঘটিয়েছিল, সম্পদঋদ্ধ করেছিল, এবারের চ‚ড়ান্ত বিজয়ের তাৎপর্য, সুদূরপ্রসারী প্রভাব আরো গভীর, আরো ব্যাপক ও ব্যঞ্জনাময়। রক্তাক্ত, পুষ্পিত সেই মহতী সময়ের নানা মাত্রিকতা অনুভব উপলব্ধি কবিতাছত্রে আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। এমন দ্যুতি, এমন অহঙ্কার বিশ্বের আর কয়টি দেশের আছে? ধাতব মারণাস্ত্র স্টেনগানে কবি পান চামেলি ফুলের গন্ধ, স্বাধীনতা নামের শিশুটি বেড়ে উঠেছে রক্ত, মৃত্যু আর আগুনের মধ্য দিয়ে। রক্তসাগরের ওপারে উদিত হয়েছে আকাক্সিক্ষত সকালের সূর্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার আগামী অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ। একাত্তরে আমাদের ন্যায্য মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন দূর পশ্চিমের প্রগতির যোদ্ধা, বিবেকের প্রতিধ্বনি বিশ্ববরেণ্য শিল্পীসমাজ। সুদূর আমেরিকার মেডিসন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অবশ্যই আরেকটি প্রেরণাদায়ী, সূর্যকরোজ্জ্বল দিগন্ত। কবি তারিক সুজাতের কবিতায় প্রতিভাসিত সেই প্রতিধ্বনি আমাদের আন্দোলিত শিহরিত করে। মেডিসন স্কয়ারের মুখ শিরোনামের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি-

কে ডাকে অমন স্বরে বাংলাদেশ বাংলাদেশ... যেন স্নেহময়ী মা অজানা আশঙ্কা বুকে নিয়ে ডাক দিচ্ছে সন্তানের প্রিয় নাম ধরে! জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্করের বন্ধুত্বের প্রগাঢ় আহবানে ওড়ে বেদনার স্বরলিপি, ‘বাংলা ধুন’-এ ডুকরে ওঠে অবরুদ্ধ পাড়াগাঁর নিঃসঙ্গ কোকিল বব ডিলানের গিটারের সুরে সুরে প্রমত্ত পদ্মার ঢেউয়ের মতো দেশে দেশে রণাঙ্গনে জয় বাংলার জয়ধ্বনি আল্লারাখার তবলার বোল, আলী আকবর খান আর কমলা চক্রবর্তীর বিষণ্ন আঙুলের স্পর্শে কথা বলে ওঠে বনগাঁর শরণার্থী শিবির! সুরের শিখায় জাগে এরিক ক্লেপটন, বিলি প্রেস্টন লিয়ন রাসেল, রিঙ্গো স্টার... মেডিসন স্কয়ার মেডিসন স্কয়ার শ্রোতার সারিতে অগণন মুখ ঝলমলে আলো আর সুউচ্চ দালান সেজেছে সেদিন ভিন্ন এক সাজে-

মুক্তিযুদ্ধের বর্ণিল ঘটনাসম্পৃক্ত কবিতাপুঞ্জ নানাবিধ কারণেই মনস্কতা দাবি করে। এই কবিতাবলি শুধু শব্দের কৃৎকৌশল বা ফুলঝুরি নয়, উচ্ছ্বাস আবেগ শুধু নয়, আমাদের আত্মার সংহত আর্তি, রাজনৈতিক অর্জন, সংস্কৃতির অনন্য ঐতিহ্য এবং মননের শৈল্পিক রূপায়ণ। জীবনযুদ্ধের আনন্দিত সৌরভ, সামনে এগোনোর পাথেয়, বেঁচে থাকবার জরুরি অক্সিজেন। সে ছিল উত্তাল, অস্থির এক দানবীয় সময়। এমন কাল, এমন দুর্ভোগ জাতীয় জীবনে কখনো আসেনি আর। একাত্তরে অবর্ণনীয় কষ্ট যাতনা উৎকণ্ঠা ছিল কোটি মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সহায় সম্বল ভিটেমাটি ছেড়ে অনিশ্চিত উদ্বাস্তু জীবন- অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর দিন যাপন- কখন মৃত্যুর থাবা কেড়ে নেয় অমূল্য প্রাণ- কিছুই কারো জানা ছিল না। এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের কাল কবে যে শেষ হবে, সেই দুঃসহ প্রতীক্ষায় দিন গোনাই সার ছিল তখন। পাকিস্তানি হানাদাররা কত অমানবিক হতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ দেশজুড়ে বিস্তৃত অনেক অনেক বধ্যভ‚মি। হিংস্র জিঘাংসায় তারা পশুবৃত্তি চরিতার্থ করেছে। ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজে তারা উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। সঙ্গত কারণেই অনিবার্য পরিণতি হিসেবে তাই দেশের সর্বত্র তাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে দৃঢ়, ইস্পাতকঠিন জনপ্রতিরোধ। অধিকৃত প্রিয় মাতৃভ‚মিকে শত্রুমুক্ত করার দীপ্ত শপথে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন সর্বস্তরের মানুষ। তারা মরিয়া হয়ে জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। এ ছাড়া কোনো গত্যন্তরও ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন জাতীয় জীবনের উজ্জ্বল আগ্নেয় আবেগ, তেমনি বিশাল এক ক্ষতও বটে। আমাদের কবিতায়, শিল্পে, সংস্কৃতিতে সেই বিভীষিকার দিনগুলো অপরিসীম মমত্ব ও নৈপুণ্যের সঙ্গে চিত্রিত করেছেন শিল্পী ও কবিকুল। গত শতকের ১৯৮৭ সালে কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ নির্বাচিত কবিতা’ নামের একটি মূল্যবান কবিতা সংকলন। সে গ্রন্থের ভ‚মিকা লিখেছিলেন মনীষী মনস্বী লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “...মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। বাহান্নতে এর সূচনা হয়েছিল, কিন্তু সূচনাতে এমন তীব্রতা পায়নি, ব্যাপকতাও নয়, একাত্তরের নয় মাসে জীবনের সঙ্গে সরাসরি, মুখোমুখি যুদ্ধ হয়েছে মৃত্যুর, সমষ্টিগত জীবনের সঙ্গে সমষ্টিগত মৃত্যুর। সেখানে আপসের কোনো সুযোগ ছিল না। এই কবিতাগুলোতেও নেই। মৃত্যুর কাছাকাছি যিনি, রোগে- তিনিও বলেছেন, মারতে মারতে মরতে চাই। সাতচল্লিশে মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু এমনভাবে যুদ্ধ করেনি। সাতচল্লিশের সাধ্য ছিল না এমন কবিতা সৃষ্টি করে। যুদ্ধ ইউরোপেও হয়েছে। আমরা শুনেছি, আমরা তার দুর্ভোগ কিছুটা সহ্যও করেছি। কিন্তু সেই যুদ্ধ ছিল পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত, আমাদের যুদ্ধ দানবের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের। এই যুদ্ধে অতি নির্মম কষ্ট ছিল, কিন্তু বিশ্বাস ছিল সব সময়েই। কেবল বিজয়ে বিশ্বাস নয়, মনুষ্যত্বে বিশ্বাস। এই কবিতাগুলো তাই বিশ্বাসের কবিতা।...”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App