×

বিশেষ সংখ্যা

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাঁদের জায়গা মেলেনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০১৯, ০২:০৮ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাঁদের জায়গা মেলেনি
ডায়েরি মার্চ ১৯৭১.. ২৮ মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপালিটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে, বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গণেশ ডোম ও কানাইকে একটি প্রবেশ পথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়া হয়। আমরা উক্ত পাঁচজন দেখলাম ঢাকা জজকোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের যে রাজপথ শাঁখারীবাজারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার দু’ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতির, নারী-পুরুষের, কিশোর-শিশুসহ বহু পচা লাশ। দেখতে পেলাম, বহু লাশ পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, দেখলাম শাঁখারীবাজারের দুদিকে ঘোর বাড়িতে আগুন জ্বলছে। অনেক লোকের অর্ধ পোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। দুই পাশে অদূরে সশস্ত্র পাঞ্জাবি সৈন্যদের প্রহরায় মোতায়েন দেখলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষ, আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ বারোজন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতি, বালক-বালিকা, কিশোর, শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবির প্রহরায় থাকাকালে সেই মানুষের অসংখ্য লাশের ওপর বিহারিদের উদ্যাম উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারি জনতাকে মূল্যবান সামগ্রী, দরজা, জানালা, সোনাদানা সবকিছু লুটে নিয়ে যেতে দেখলাম। লাশ উঠাতে উঠাতে এক ঘরে প্রবেশ করে এক অসহায় বৃদ্ধাকে দেখলাম। বৃদ্ধা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পানি পানি বলে চিৎকার করছিল, তাকে আমি পানি দিতে পারিনি ভয়ে, বৃদ্ধাকে দেখে আমি আরো ভীত হয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পেছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবি সেনা প্রহরায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারিনি। আমরা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ শাঁখারীবাজার থেকে প্রতিবারে একশ লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিনশ লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিনশ লাশ ধলপুর ময়লা ডিপুতে ফেলেছি। ২৯ মার্চ, ১৯৭১... ২৯ মার্চ সকালে আমি মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুপাশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালীবাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি। ২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশ পথে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙালি যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সঙ্গে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমাদের ইন্সপেক্টর পঞ্চম আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এরপর আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতি, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি। আর গণেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশগুলোতে ঝাঁজরা দেখেছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাইনি, যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পেছনের মাংস কাঁটা দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার আগে তাদের স্তন সজোরে টেনেছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতি মেয়েদের যোনিপথের এবং পেছনের মাংস ধারালো চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতি মেয়ের মাথায় খোঁপা খোঁপা চুল দেখলাম। মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশ লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলছি। ৩০ মার্চ ১৯৭১ ৩০ মার্চ আমদের উক্ত পাঁচজনের সঙ্গে দক্ষিণা ডোমকে সাহায্য করতে দেয়া হয়। আমাদের ট্রাক সে দিন সাত মসজিদে যায়। আমি সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে যখন বাঙালির লাশ উঠাচ্ছিলাম তখন অসংখ্য বিহারি জনতা আমাদের চারদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল। বাঙালিদের পরিণতি দেখে তারা উপহাস করছিল। আমরা সাত মসজিদের সামনে থেকে আটটি যুবকের লাশ তুলেছি। কতিপয় লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে। সবার পিঠ গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে। পচা, ফুলা লাশ তুলতে গিয়ে দেখলাম কারো লুঙ্গি পরা কারো পায়জামা পরা। আবার কারো দেহে হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামি প্যান্ট। পানি থেকে বারোটি লাশ তুলেছি। প্রতিটি লাশের চোখ এবং হাত পেছন দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারোটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁজরা দেখেছি। লাশ দেখে মনে হলো ভদ্রঘরের অভিজাত বাঙালি যুবকদের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে আমরা ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ফিরে এসে ট্রাক নিয়ে আমরা মিন্টু রোডে লাশ তুলতে গিয়েছি। মিন্টু রোডের রাস্তার পাশ থেকে প্যান্ট পরা দুটি পচা ফুলা লাশ তুলেছি। ধলপুরে যাবার পথে ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের সম্মুখ থেকে এক বৃদ্ধ ফকিরের লাশ তুলেছি। দেখলাম লাশের পাশেই ভিক্ষার ঝুলি, টিনের ডিব্বা ও লাঠি পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সম্মুখ থেকে দুজন রূপসী যুবতি মেয়ে এবং তিনজন যুবকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ তুলেছি। মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি। ঢাকা হলের ভেতর চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি। সে দিন অসুস্থ থাকায় আমি আর লাশ তুলতে যেতে পারিনি। চুন্নু ডোম ০৭/০৪/১৯৭৪ ঢাকা পৌরসভা রেলওয়ে সুইপার কলোনি ২২৩নং ব্লক, ৩নং রেলগেট ফুলবাড়িয়া, ঢাকা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তিনদিনের ঘটনা আমরা জানতে পারি একজন ডোমের মুখ থেকে। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র এই ধরনের বেশ কিছু সাক্ষাৎকার আছে নিম্নবর্গের মানুষদের। যাদের মধ্যে আছেন মেথর, মুচি, ডোম, সুইপারসহ বেশি কিছু নিম্নবর্গের মানুষ। ১৯৭১ সালের ভয়াল সেই ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে প্রথম আক্রমণ করা হয় ঢাকার পিলখানায়। সেখানে আক্রান্ত হয়েছিল পিলখানার অভ্যন্তরে থাকা সুইপার কলোনি। শহীদ হয়েছিলেন কয়েকজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি করা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে আছে সেই সুইপারদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার যাঁরা সেই ভয়াল রাতের সাক্ষী দিয়েছেন। কিন্তু সেই রাতে শহীদ সুপারদের কেউই শহীদদের তালিকায় স্থান পাননি। শুধু ঢাকা পিলখানা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুইপার কলোনিগুলোতে পাক বাহিনী হামলা চালিয়েছিল। সেই পরিবারগুলো শুধু হয়তো তাদের পিতামাতা হারানোর কথা মুখেই বলে কিন্তু ইতিহাস লেখনী তাদের স্থান দেয়নি, কারণ তারা সমাজে ক্ষমতা কাঠামোর কেউ নয়। এই সাক্ষাৎকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দলিত মানুষদের ভ‚মিকা। মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কিংবা বীরাঙ্গনা তালিকাতেও স্থান হয়নি এই দলিত মানুষদের। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে এই মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও স্বাধীন দেশে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন খুব কমই ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতকে তা এভাবেই দেখেছেন সৈয়দপুরের সুইপার জ্যোৎস্না বাঁশফোর। সিরডাপে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় জ্যোৎস্না বলছিল, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার বাবা মারা গেছেন, আমার বোনকে দংশন করছে (ধর্ষণ অর্থে), কিন্তু এখনও আমার ছেলে মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়া আমাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আনেনি।’ জ্যোৎস্না শুধু নয়, এই কথাটি হয়তো বাংলাদেশে বসবাসরত বেশিরভাগ নিম্নবর্ণের/নিম্নবর্গের মানুষের। এই মানুষেরা স্থান পায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও। ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বিভিন্ন নিম্নবর্গের মানুষকে স্থান দিতে যেভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী ইতিহাস নির্মাণও একইভাবে উপেক্ষা করেছে নিম্নবর্গের মানুষের অবদান ও অংশগ্রহণ। উভয় ইতিহাসেই প্রবল শ্রেণির প্রাধান্য লক্ষণীয়। ব্রিটিশ বিরোধীর প্রেক্ষাপটে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল সেই জাতীয়তাবাদের পরিসর নির্মিত ইতিহাস নিম্নবর্গের মানুষের ঐতিহাসিক ও স্থানিক অবদানকে অস্বীকার করেছে। সব সময় তাদের অবস্থা ছিল নিকৃষ্ট অন্যের ভ‚মিকায়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই জাতীয়তা ধারাটিই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে রচনার মূল ধারায় পরিণত হয়েছে। একক ও আধিপত্যশীল জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনায় অভ্যস্ত এই গোষ্ঠী রচনায় তাই প্রধান প্রধান জাতীয়তাবাদী দলগুলোর অবদান ও ভ‚মিকার সমান্তরালে ক্রিয়াশীল সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা অনুচ্চারিত থেকেছে। ইতিহাসে স্থান পেয়েছে সামরিক ও বেসামরিক আমলা, উচ্চ শ্রেণির পেশাজীবী, রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিজীবী এর বাইরে কারো অবস্থান ইতিহাস স্বীকার করতে নারাজ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরও এই ইতিহাস নির্মাণের সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে এবং ইতিহাস নির্মাণের ধারণায় অচিহ্নিতায়ন জারি রয়েছে। একইভাবে সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে চা শ্রমিকরা জীবন দিয়েছেন, অনেক চা শ্রমিক নারী শহীদ হয়েছেন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের জায়গাও হয়নি ইতিহাসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বড় ধরনের অবদান রাখার পরও শিক্ষার সুযোগেই তারা দীর্ঘদিন পাননি, চাকরির কোটা তো অনেক দূরে। এখনো দৈনিক ১০২ টাকা আয় করা অনেকের কাছে স্বপ্নের বিষয়। মেলেনি তার শ্রমের মুক্তি, আটকে থাকা শ্রমিক জীবনের মুক্তি। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবলমাদ্র ধর্ম, বর্ণ গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাদের সঠিক স্থান না হওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র এককভাবে এই অসমতাকে অনুমোদন দেয়। জাতি, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, অঞ্চলভিত্তিক নিরপেক্ষতাই আসলে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানেই বৈষম্যহীন সমাজের জন্য কাজ করা, সমাধিকার এবং ভ‚মি এবং ইতিহাসের মালিকানায় উত্তরাধিকারী হওয়া। তাই এই ভ‚খণ্ডের জঙ্গল, জমি জল, বন্দর, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খনিজসম্পদ সকল রক্ষা করার দায়িত্ব আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে জমি দখল, জঙ্গল চুক্তি, সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ, লিঙ্গীয় সংখ্যালঘুর ওপর আঘাত, মুক্ত চিন্তার ওপর নজরদারি, আদিবাসী স্বীকৃতির দাবির বিপরীতে অনড়তা, নারী ও সংখ্যালঘুর ওপর মানসিক চাপ তৈরি- কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। বরং এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত এবং সংঘর্ষমূলক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App