×

মুক্তচিন্তা

বিজিবি যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০১৯, ০৮:৩০ পিএম

মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনকে করেছে গৌরবোজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। দেশের আপামর সব নাগরিকের কাছে এই মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালি জাতি এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য গর্বিত এবং তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তাদের অবদানের স্বীকৃতি এবং শ্রদ্ধা নিবেদন প্রত্যেক বাহিনীর কাছে তাই কিংবদন্তির অহঙ্কার।

এ দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় এবং শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এ দেশের আপামর জনতা মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশের মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে বিজিবি (তৎকালীন ইপিআর) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে।

মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা অসীম মনোবল আর সামান্য সংখ্যক সাধারণ মানের অস্ত্র সম্বল করে যে অগাধ দেশপ্রেম, বীরত্ব ও সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস রচনা করেন তা বিজিবি তথা বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে ঢাকার পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর। তৎকালীন ইপিআর বাহিনী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসযোগে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়। নিজস্ব ওয়্যারলেসযোগে প্রচারের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করেন শহীদ সুবেদার মেজর (সিগন্যাল) শওকত আলী।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা কয়েকজন ছাত্রনেতার মাধ্যমে পিলখানার ২ নম্বর গেটে তৎকালীন ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলীর কাছে পৌঁছে। সুবেদার মেজর শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পিলখানার ইপিআর ওয়্যারলেসযোগে টেলিগ্রাফিক মেসেজের মাধ্যমে কোম্পানি হেডকোয়ার্টার, চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রামে ইপিআরের কর্তব্যরত সিগন্যালম্যান মো. আবুল খায়ের মেসেজটি গ্রহণ করেন এবং ইপিআরের বাঙালি অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে হস্তান্তর করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি প্রেরণের অপরাধে সুবেদার মেজর শওকত আলীকে পিলখানার বাসা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা প্রেরণকারী এই দুঃসাহসী বীরযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অমানুষিক নির্যাতন করে এবং পরবর্তী সময়ে তাকে হত্যা করা হয়। সুবেদার মেজর শওকত আলীর প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ইপিআর সিগন্যাল সেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায় সারাদেশের সীমান্ত বিওপিতে। যা ইপিআর সদস্য ছাড়াও মুক্তিকামী জনতাকে সংগঠিত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে মুক্তিকামী উৎফুল্ল জনতার মাঝে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে ধরেন। একই দিনে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দপ্তরে মুক্তিকামী জোয়ানরাও স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ইপিআরের বাঙালি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাপূর্ণ সাহসী এ কাজের জন্য এ বাহিনীর (বিজিবি) প্রত্যেক সদস্য আজ গর্বিত।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা রণকৌশলগত কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর তীরে জিঞ্জিরায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎকালীন ইপিআরের বাঙালি সৈনিকরা ১১টি সেক্টরে ৯ মাস যুদ্ধে নিয়োজিত থাকেন। ইপিআরের প্রায় ৮ হাজার বাঙালি সদস্য সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও সিলেটে ইপিআরের বাঙালি সদস্য ও পাক বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।

ইপিআরের বাঙালি সৈনিকদের এ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণকে অধিকতর সংগঠিত হয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে রণাঙ্গনে লড়াই করার সাহস জুগিয়েছে। দেশের প্রতিটি সেক্টর ও উইং হেডকোয়ার্টারের বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং বিভিন্ন পদবির সৈনিকরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ, আত্মঘাতী আক্রমণ ও শত্রু ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করতে অসংখ্য দুর্ধর্ষ অপারেশন পরিচালনা করেন।

মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম বীরত্বের জন্য এ বাহিনীর দুজন সৈনিক সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত হন। তারা হলেন শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ। তাদের বীরত্বগাথা এ বাহিনী তথা বাঙালি জাতিকে করেছে গৌরবান্বিত। নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগ দেন।

তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টর, যশোরের অধীনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পর যখন মুক্তিবাহিনীকে সুসংগঠিত করা শুরু হয় তখন তিনি যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার গোয়ালহাটি গ্রামে স্থাপিত একটি ক্যাম্পের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গোয়ালহাটি গ্রামের এক প্রান্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হন।

তিনি দুজন সঙ্গী নিয়ে গোয়ালহাটি গ্রামের অনতি দূরে ছুটিপুর ঘাঁটি টহল দেয়ার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের আক্রমণ করে। নূর মোহাম্মদ শেখ তার টহল দলটিকে রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। হানাদার বাহিনীর গুলিতে সহযোদ্ধা নান্নু মিয়া গুরুতর আহত হলে নূর মোহাম্মদ শেখ হাতে এলএমজি এবং কাঁধে গুরুতর আহত সঙ্গীকে নিয়ে শত্রু বাহিনীর দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিরাপদ জায়গায় যেতে থাকেন।

হঠাৎ শত্রুর দুই ইঞ্চি মর্টারের আঘাতে তার হাঁটু ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তার সঙ্গীরা যেন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পৌঁছাতে পারেন সেজন্য মর্মান্তিক আহত অবস্থায়ও নূর মোহাম্মদ শেখ গুলি চালাতে থাকেন এবং এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। যশোরের শার্শা থানার কাশিপুর গ্রামে এই বীর যোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ নিজের প্রাণের বিনিময়ে সহযোদ্ধাদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। তার এই অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।

এ বাহিনীর অপর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইংয়ে নিয়োজিত থেকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের একটা অংশ এবং তৎকালীন ইপিআরের কিছু বাঙালি সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে মুন্সী আব্দুর রউফ কোম্পানির মেশিন গানার হিসেবে রাঙ্গামাটির মহালছড়ি নৌপথে প্রহরারত ছিলেন। কোম্পানিটি বুড়িঘাট চিংড়ি খাল পাড়ের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল।

৮ এপ্রিল শত্রু পক্ষের দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানি, ৬টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও ৩টি লঞ্চ নিয়ে প্রতিরক্ষা এলাকায় ঢুকে পড়লে ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ তার নিজের অবস্থান থেকে একাই শত্রু পক্ষের ২টি লঞ্চ ও ১টি স্পিডবোট পানিতে ডুবিয়ে দেন। ফলে প্রায় ২ প্লাটুন শত্রু সৈন্য সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়। আচমকা শত্রু বাহিনীর মর্টারের গোলার আঘাতে নানিয়ারচরের বাছড়ি নামক স্থানে তিনি শাহাদতবরণ করেন। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধি পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচরে। তার অপরিসীম বীরত্ব, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।

এ বাহিনীর অহঙ্কার বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সম্মানে পিলখানার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাদের জন্ম ও শাহাদতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে স্বজনদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে সম্মানিত করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এ বাহিনীর আরো ৮ জন বীরউত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম, ৭৭ জন বীরপ্রতীক খেতাব অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর মোট ৮১৭ জন বীর সৈনিক শাহাদতবরণ করেন। এই বাহিনীর অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে সরকার এ বাহিনীকে ‘স্বাধীনতা পদক ২০০৮’ প্রদান করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজিবি (তৎকালীন ইপিআর) সৈনিকদের হিমালয়সদৃশ মনোবল, অতুলনীয় দেশপ্রেম ও চরম আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বিজিবির সৈনিকরা তাদের পূর্বসূরি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের মহিমায় গর্বিত ও অনুপ্রাণিত। তাই এ বাহিনী দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধ থেকে তার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সর্বদা আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানিয়ে থাকে।

প্রতি বছর বিশেষ করে বিজিবি দিবস উপলক্ষে এ বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। বাহিনীর সদর দপ্তরসহ রিজিয়ন, সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ের আওতাধীন অঞ্চলে বসবাসকারী ওই বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশেষ করে বিজিবি সদর দপ্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ বাহিনীর দুজন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের পরিবারের সদস্যদের বিশেষভাবে সম্মান জানানো হয়ে থাকে। ঢাকা অঞ্চলে বসবাসকারী ওই বাহিনীর অন্যান্য খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদেরও একইভাবে সংবর্ধিত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের এ উপলক্ষ এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে একটি উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের এই আয়োজনের মাধ্যমে বাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা সম্পর্কে এ বাহিনীর বর্তমান সদস্যরা সরাসরি জানার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এভাবে এ বাহিনীর সদস্যরা তাদের পূর্বসূরিদের বীরত্বের নিদর্শন নিজেদের মধ্যে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত হন।

মু. আব্দুল আউয়াল মুছুল্লী : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, পিলখানা, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App