×

বিশেষ সংখ্যা

তবুও দুর্ঘটনা নয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০১৯, ০৩:২৮ পিএম

মুলুকচানের জীবনে এ এক অভিনব এবং অভ‚তপূর্ব ঘটনাই বটে- বাঁশতলি গ্রামের দীন ইসলাম মেম্বারের সঙ্গে একই সাইকেলে চেপে থানা সদর গাংনীতে যাচ্ছে। কী এমন পরিচয় মুলুকচানের! সে তো আর দীনু মেম্বারের বড় ছেলে মান্নান কিংবা মেজো ছেলে হান্নানের প্রাণের বান্ধব নয়! একই পাড়ায় জন্ম ও বেড়ে ওঠার সুবাদে ছোটবেলায় খেলাধুলা এবং গ্রাম্য মাখামাখির কারণে এক প্রকার গা-আল্গা পল্কা সম্পর্ক রচিত হয়েছিল সে কথা সত্যি। কিন্তু এক বলকের পাতলা দুধের সর কতক্ষণইবা অটুট হয়ে জমে থাকে! মাথায় একটু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মান্নান-হান্নান বিদ্যালাভের তৃষ্ণায় ছুটে যায় ইশকুলের দিকে, মুলুকচান তখন কী করে! পথে পথে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে ঘুরে আর ক’দিন কাটে! দীন ইসলাম মেম্বার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে গোয়ালের গরুর পালের পিছনে লাগিয়ে দেয়। সেই থেকে বাঁধা রাখাল। খানিক সেয়ানা হবার পর প্রমোশন পেয়ে হয়েছে কৃষাণ। দীনু মেম্বারের বিশ্বস্ত কৃষাণ। গাট্টাগোট্টা শরীর, সুঠাম স্বাস্থ্য, দুর্দান্ত সাহস, টগবগে যুবক। মান্নান-হান্নানের সঙ্গে পথের ব্যবধান হয়ে গেছে, হবারই কথা, সেটাই স্বভাবিক, কিন্তু মুলকচানের নামের সঙ্গে কখন এবং কীভাবে যে পাগল যোগ হয়েছে সে কথা বিশেষভাবে কারো মনে পড়ে না। মুলুকচান অপেক্ষা মুলুক পাগল নামেই এ দিগের অধিক মানুষ তাকে চেনে। মুলুকচানের পাগলগামির সূত্রপাত কখন থেকে এবং কী কী উৎকট লক্ষণের কারণে তাকে পাগল বলা হয়, সে খবর কেউ জানে না বললেই চলে। মুলুকচান কি কখনো প্রকাশ্য দিবালোকে পরনের কাপড় খুলে দিগম্বর হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে? জন্মসূত্রে পাওয়া ন্যায়-অন্যায়বোধ কি লোপ পেয়েছে কখনো তার? টাকার নোট কিংবা সিকি-আধুলি চিনতে কি সে প্রায়শ ভুল করে? আত্মীয়-স্বজনকে চিনতে না পেরে কখনো কাউকে ভুল সম্বোধন করেছে সে? না, এমন কোনো অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কখনো ওঠেনি। তাহলে মুলুকচান পাগল হয় কী প্রকারে! এ বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার- সম্পূর্ণ সুস্থ একটা মানুষকে প্রায় অকারণে ছোট-বড় সবাই পাগল বলে ডাকছে, আর সে কিনা একেবারে নির্বিবাদে মেনে নিচ্ছে, ঘাড় দুলিয়ে দাঁত কেলিয়ে সবার ডাকে সাড়া দিয়ে চলেছে? কখনো সামান্য প্রতিবাদও নেই। কী সর্বংসহা গুণ তার! মানুষের সামান্য ঠাট্টা-তামাশারও অর্থ বোঝে না, এমনই সারল্য তার! তবে কি মুলুকচানের এই সীমাহীন সরলতাকেই পাগলামি বলে চালানো হয়েছে! সারল্যের মতো মহৎ গুণটিকে আড়ালে ঠেলে পাঠাবার এ কী অসম্ভব প্রচেষ্টা! বৃষ্টি-বাদলার দিনে কাদাপাঁকের রাস্তায় সাইকেল চালানো মোটেই সোজা কথা নয়, তবু কিনা ডবল-প্যাসেঞ্জারি বলে কথা, যে কোনো মুহূর্তে প্যাডেল থেকে পা হড়কালেই সর্বনাশ। মুলুক পাগলের তো ভয়-ডরের লেশ মাত্র নেই, শক্ত হাতে হ্যান্ডেল ধরে সাইকেলের চাকা গড়িয়ে চলেছে, আর দীন ইসলাম মেম্বার সেই সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে চেপে বসে আছে। গায়ে আচকান, মাথায় জিন্না টুপি, দুচোখে সুরমা টানা, মন মেজাজও বেশ ফুরফুরে। সম্ভবত আতরও মাখা হয়েছে, ভুরভুরে খুশবু কিছুতেই ফুরাচ্ছে না। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে দীনু মেম্বার জানতে চেয়েছিল ঠিকই- তুই প্যাডেল করতে পারবি তো! কোনো প্রস্তাবে না বলার অভ্যাস নেই মুলুক পাগালের। আর সাইকেল চালানো তো রীতিমতো উত্তেজনাকর ব্যাপার। ছোটবেলায় মান্নান-হান্নানের কত রকম বৈধ-অবৈধ হুকুম পালনের বিনিময়ে এক আধটু হাফ-প্যাডেলের সুযোগ পেয়েছে তার ঠিক আছে! তবু কিনা তক্কে তক্কে থাকতে হয়েছে- যেন দীনু চাচার নজরে না পড়তে হয়। বাঘের মতো মেজাজ তার। মেম্বার হবার পর তর্জনগর্জন যেটুকু বৃদ্ধি পেয়েছিল, এই যুদ্ধের মৌসুমে কী এক পিস-কমিটির নেতা হওয়ার সুবাদে সেই ধ্বনি যেনবা প্রতিধ্বনিত হয় চতুর্দিকে। পাগল-টাগল যে যা-ই বলুক, মুলুকচান সব বোঝে, দূরের আওয়াজ বেশ শুনতে পায়। ফলে কাদাপাঁকের রাস্তায় সাইকেল চালানোর প্রস্তাবে এক গাল হাসি ছড়িয়ে সে সম্মতি জানায় এবং দীনু মেম্বারকে পেছনে বসিয়ে দেহের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাইকেল ঠেলতে থাকে। মুলুকচানের গায়েও আজ শোভা পাচ্ছে সাদা-কালো স্টাইপের হাফশার্ট। ভারি মানিয়েছে তাকে। গায়ে চাপানোর পর নিজে হাতে টেনেটুনে দেখেছে। সে জানে এ জামা তার নয়, মান্নান কিংবা হান্নানের পরিত্যক্ত জামা-ই হবে হয়তো, তবু গায়ে দিয়ে খুব ভালো লেগেছে। এমনিতে তো শীতকাল ছাড়া অন্য সময়ে তার জামা পরা হয় না, সে অভ্যাসও মোটেই নেই, কিন্তু দীনু মেম্বর নিজে হাতে তার কাঁধের উপরে জামা চড়িয়ে দিলে তখন সে কী করে! মানুষের শরীর তো সব দিন সমান যায় না! দীন ইসলামের শরীর খারাপ, তবু জরুরি কাজে গাংনী শহরে যেতে হবে, থানা থেকে জোর তাগিদের খবর পাঠিয়েছে, না গেলেই নয়; মাথার উপরে মেঘ থমথম করছে, তবু যেতে একবার হবেই, তাই মুলুক পাগলকে রাজি করিয়েছেÑ সাইকেল চালানোর জন্য। তাই বলে সে উদোম গায়ে গাংনী যাবে দীনু মেম্বরের সঙ্গে! মাথা খারাপ! ইজ্জতের প্রশ্ন আছে না! হোক পুরনো জামা, তবু সেই জামার মধ্যে মুলুকের শরীর ঢোকাতে বাধ্য করে দীনু মেম্বর। বগলের তলে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোশাক-পরিধানের এই দৃশ্য তদারকির পর মন্তব্য করে- বাহ, বেশ মানিয়েছে তো তোকে! খানিকটা থিতু হবার পর মুলুক পাগলও বেশ টের পেয়েছে, জামা-পরা অবস্থায় তাকে অন্যরকম লাগছে। মনের ভেতরে একটু যেন ফুর্তি ফুর্তি ভাব ঢেউ খেলে যায়। আনন্দে ডগোমগো হয়ে সে সাইকেলের প্যাডেলে ভর দিয়েছে পায়ের। বেলেমাটির রাস্তায় চাকা গড়াতে বিশেষ কষ্ট হয় না। সাইকেল বেশ ভালোই গড়িয়ে চলে। কিন্তু গ্রামের মানুষ এরকম দৃশ্য খুব একটা দেখেনি বোধ হয়, চোখেমুখে তাই প্রবল কৌত‚হল নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কেউ বা মুখ বাড়িয়ে প্রশ্নই করে বসে- ‘কী ব্যাপার মুলুকচান যে! যাচ্ছো কনে?’ একটু পরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা দীনু মেম্বরকে দেখে কেউবা দাঁতে জিভ কেটেছে, মুখে চুকচুক করেছে- ‘ও বাবা, মেম্বর চাচাও আছে দেকছি।’ এরপর মুলুকচানকে আর কেউ ঘাঁটায়নি। তবে অভিনব এই দৃশ্যটি কেউ-ই চোখের পর্দা থেকে সহসা মুছে ফেলতে পারে না। মেঘলা আকাশ মাথায় করে সাইকেল ঠেলে যাচ্ছে মুলুক পাগল, পেছনের ক্যারিয়ারে পা এলিয়ে বসে আছে দীন ইসলাম মেম্বর। তারা যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। আগ-বাড়িয়ে এ কথা কেউ শুধায় না। কৌত‚হল থাকলেও তা বুকের মধ্যে চেপে রাখে সবাই। পথে যেতে যেতে দীনু মেম্বর নিজে থেকেই জানায়- আমরা যাব থানা পর্যন্ত, বুঝেছিস? মুলুক পাগল এ কথা আগেও শুনেছে। থানা-পুলিশের বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। নিজের বিয়ে করা বউ নিয়ে গত বছর যে ঝামেলায় সে পড়েছিল, সে কি মানুষের মধ্যে বলার কথা! কোনো জামাই কখনো শ্বশুরবাড়ি যায় চুরি করতে! আর কী এমন ধনদৌলত আছে সেখানে যে চুরি করতে যাবে মুলুক পাগল। হ্যাঁ, তার বউটা ছিল সুন্দরী। কিন্তু সুন্দরী মেয়েমানুষের মনের মধ্যে যে এতখানি বিষকাঁটা মুখ লুকিয়ে আছে, কে জানত সেটা! বিয়ের পর থেকেই শুরু হয় সেই বিষকাঁটার দগ্ধানি। ভাতারের ভাত খাবে না। কেন, কী অপরাধ তার! লোকে পাগল বলে যে! আসল কথা ওটা নয়, ও সব হচ্ছে তার রূপের দেমাগ। আড়াল থেকে কেউ নিশ্চয় তার রূপের বাতির সলতে উসকে দিয়েছে, অমনি শুরু হয়েছে ভাত না খাবার ছল। তলে তলে সে জব্বার দর্জির গলায় মালা ঝুলিয়ে বসে আছে সে কথা একটু বিলম্বে হলেও মুলুক ঠিকই জানতে পেরেছে। কিন্তু জেনে কী করবে সে! ততদিনে মিথ্যে চুরির ফাঁদ পেতে মুলুক পাগলের জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। চুরির কোনো বমাল নেই, সাক্ষীসাবুদ নেই, তবু কী অপমান কী হেনস্তা! মুলুকচানকে লোকে পাগল-টাগল যা-ই বলুক, সে নিশ্চিত বুঝতে পারে- ষড়যন্ত্রের জাল অনেক দূর বিস্তৃত এবং এর কেন্দ্রবিন্দুতে আছে তার সুন্দরী স্ত্রী। সে দফা থানা-পুলিশের খপ্পর থেকে কে উদ্ধার করেছিল, এই দীনু মেম্বরই তো! এতদিন পর রাইপুর বটতলার কাছাকাছি আসতেই সাইকেলের পেছন থেকে তামাশা করে ওঠে দীনু মেম্বর- শ্বশুরবাড়ি যাবি নাকি মুলুক? মুলুকচানের শরীর কেঁপে ওঠে। শক্তহাতে হ্যান্ডেল চেপে ধরে বলে, সিখানে কী কত্তি যাব! দীনু মেম্বর হেসে ওঠে, তা ঠিক। চ, তোকে আজ অন্য শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাব। হ্যাঁ। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না মুলুকচানের, এতদিন এ সব ঠাট্টা-তামাশা ছিল কোথায়! এখন একটা জরুরি কাজে রওনা দেয়ার পর এ সব কথার মানে হয়! কোনো জবাব না দিয়ে জোরে প্যাডেল চেপে সে রাইপুর বটতলা পেরিয়ে আসে। মনের পর্দায় সুন্দরী স্ত্রীর মুখের ছবি ভেসে উঠলে জোর করে সে ছবি সরিয়ে দিতে তৎপর হয়। নিজে থেকে মনকে বুঝায়- সব কিছু চুকেবুকে যাবার পর আবার কেন সেই প্রসঙ্গ উঠছে! দীনু মেম্বরের তো অজানা কিছুই নেই! তবু কেমন সেই প্রসঙ্গ নিয়ে খুঁচিয়ে তার কী যে মজা! কেমন অবলীলায় সে মুলুক চানকে বলে, শ্বশুরবাড়ি মানে আমোদ-আহ্লাদ, একটু আনন্দ-ফুর্তি। এইবার আমি সেই সব ব্যবস্থা দেখছি দাঁড়া। জোয়ানমর্দ ছেলে, আমোদ-ফুর্তি না হলি চলে! মুলুকচান শিউরে ওঠে। বুঝতেই পারে না- এ সব কথার মানে কী! দীনু চাচা কি সত্যি আবার তার বিয়ে দিতে চায়? সেই জন্য তার কাঁধে জামা তুলে দেয়া! মনের ভেতরে প্রশ্ন ওঠে, উত্তর খুঁজে পায় না। শক্ত পায়ে সাইকেলের প্যাডেল চালায়! চলতে চলতে সহসা দীনু মেম্বর প্রশ্ন করে, এত যে অপমান করল তোকে, একবার বদলা নিতি ইচ্ছে করে না? মুলুকচান অবাক, বদলা নিয়া মানে? আরে গাধা, শোধ নিবি। প্রতিশোধ। মুলুকচানের মুখে কথা নেই। পাগল-টাগল যে যাই বলুক, প্রতিশোধের ব্যাপারটা সে এতক্ষণে খানিকটা বুঝতে পারে। বাকিটা খোলাসা করার দায়িত্ব দীনু মেম্বর নিজেই গ্রহণ করে। পিছন থেকে মুলুকচানের পিঠে হাত রেখে সে বলে, বদলা নেয়ার এটাই তো সময়। থানায় না যাস আর্মি ক্যাম্প চল। হাই ইস্কুলে ক্যাম্প খুলেছে। আর্মি ক্যাপ্টেনের কাছে একবার বললেই তোর সেই সুন্দরী বৌয়ের রূপের দেমাগ ভেঙে দেবে। জব্বার দর্জির সঙ্গে ঢলাঢলি বেরিয়ে যাবে। হ্যাঁ। জব্বার দর্জিকে আপনি চেনেন? চিনি মানে! সে তো বজ্জাতের হাড্ডি। মুক্তিযোদ্ধা হয়িচে। ইন্ডিয়ায় গিয়েছে ট্রেনিং নিতে। ট্রেনিং ওর পাছায় দিচ্ছি দাঁড়া। যত সব দুষ্কৃতকারী! আগের গতিতে আর সাইকেল চলে না। বোধ হয় খানিক আগে এদিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা পিচ্ছিল। মুলুকচানও আর বল পাচ্ছে না পায়ে। অথচ এখনো মাইলখানেক মেটো রাস্তা পেরিয়ে তারপর থানাপাড়ার হেরিংবোনের নাগাল মিলবে। মুলুকচানের সারা শরীরে ঘাম ফুটে বেরিয়েছে। গায়ের জামার পিছনের দিক ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টে গেছে। এ সব দিকে নজর পড়ে না দীনু মেম্বরের। সে আছে তার প্রিয় প্রসঙ্গে মগ্ন হয়ে। শ্রোতার মনোযোগের দিকেও যেনবা ভ্রুক্ষেপ নেই। আপন মনে একা একাই গজগজ করে চলেছে- ইন্ডিয়ার কথায় নাচছে দুষ্কৃতির দল। দেশটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করবে। কই, তোদের সে লিডার কোথায়? বাব্বা, কত্ত তার হালুম হুলুম- স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম! সংগ্রাম তোদের পোঁদে ঢুকাবে পাকিস্তানি আর্মি। চিনিস তাদের! গোপনে গোপনে কেন, সামনাসামনি এসে দাঁড়া! দেখি কেমন বুকের পাটা! সত্যিই আর চলতে চায় না মুলুকচানের পা। দুপায়ের পেশি ফুলে ওঠে। গিঁটে ব্যথা করে। হাতের মুঠোয় সাইকেলের হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে রাখাও যেন তার জন্য বড্ড কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু কী করবে সে! দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সাইকেলের প্যাডেল চাপতেই হয়। দীনু মেম্বরের বকবকানি তার কানে যায় কি যায় না, সহজে তা বোঝার উপায় নেই। পেছনের ক্যারিয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার কারণে সে মুলুকচানের মুখচোখের অভিব্যক্তি কিছুই টের পায় না। সে সবে তার দরকারও নেই। সে আছে তার নিজের ভাবনায় মশগুল। কারো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে নিজের গরজে বকবক করে চলে। বুঝলি মুলুক, জব্বারের মতো দুষ্কৃতি সাবড়াতে আর্মি লাগবে না, দেশি রাজাকারই যথেষ্ট। যেমন বাঘা ওল, তেমনি ট্যাঙা তেঁতুল। সমানে সমান। দৃষ্কৃতিরা যেমন এ দেশের পথঘাট জলাজঙ্গল চেনে, রাজাকাররাও ঠিক তাই চেনে। রাজাকারের সঙ্গে ওরা পারে? মাথা খারাপ! রাজাকারের হাতে আছে সরকারি অস্ত্র, গোলাবারুদ! ইয়ার্কি নাকি? মুলুকচান সব কথা শুনতে পায়, কিন্তু বুঝতে পারে না- এ প্রশ্নে তার কোনো জবাব দেয়ার আছে কিনা। ঠিক এ সময়েই তার সাইকেল মাটির রাস্তা থেকে উঠে আসে খোয়া ওঠা হেরিংবোনের রাস্তায়। রাস্তা বদলের মুহূর্তে সাইকেলের হ্যান্ডেল একটুখানি নড়ে ওঠে। দীনু মেম্বরও সঙ্গে সঙ্গে শরীর হেলিয়ে ব্যালান্স ঠিক করে নেয় এবং তারপরই বেশ আদুরে ঢংয়ে জানতে চায়, হ্যাঁরে পাগলা, তুই কি রাজাকার হবি? চমকে ওঠে মুলুকচান। প্রশ্ন শুনে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রশ্নের এ কোন ধারা- মুলুক পাগল হবে রাজাকার? কেন, সে রাজাকার হবে কেন? উত্তরপাড়ার নবিরদ্দি-খবিরদ্দি দুই ভাই হয়েছে রাজাকার, বিলপাড়ার আমোদ আলী, মসজিদপাড়ার বিশু এবং মোস্তফা রাজাকার হয়েছে, এদের মধ্যে আকালি ঘরামির ছেলে বিশু নাকি কোথায় ডাকাতি করতে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়েছে এবং সরকারি রাইফেলও হারিয়ে ফেলেছে। এ ঘটনাকে অবশ্য প্রকাশ্যে কেউ ডাকাতি বলে না, অন্য রাজাকাররা বলে যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। শহীদ হওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি মুলুক, তবে রাজাকারদের সংসারে উন্নতি হতে সে দেখেছে। তাই বলে মুলুকচানও রাজাকার হবে! জোরপায়ে সে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় ঠিকই কিন্তু ভেতর থেকে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আসে না। কিন্তু দীনু মেম্বর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? সে আবার জিজ্ঞেস করে, কী রে মুলুক, বদলা নিবি না তোর অপমানের? মুলুকচান নীরব। দীনু মেম্বর বুঝাতে চেষ্টা করে, আরে পাগল, রাজাকার মানেই তো দেশের রাজা, সেটা বুঝিস? এতক্ষণে মুখ খোলে মুলুকচান, আমাদের গিরামে তো পাঁচজন রাজাকার আছে। হ্যাঁ আছে। তারা তো বেশ রাজার হালেই আছে। তুইও তাই থাকবি। পাঁচজন আছে, আরো লাগবে রাজাকার? লাগবে মানে আমার উপরে চাপ আছে- আরো রাজাকার লাগবে। তোকে আমি রাজাকারেই দেব। আমার বাড়ি আর কত খাটবি! ইবার একটু মানুষ হ’। সামনেই ভাঙা কালভার্ট। কালভার্টের ওপারে গিয়ে দুটো ডাল ছেড়েছে খোয়া ওঠা লাল সুরকির রাস্তা। একটা গেছে থানায়। অন্যটি হাইস্কুলে। মুলুকচানের সাইকেল কালভার্টে ওঠার আগেই দীনু মেম্বর দিকনির্দেশ করে দেয়- ডাইনে চল বাপ, আগে ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি। তারপর অন্য কাজ। বামের রাস্তা গেছে থানায়। ডাইনেরটা হাইস্কুলে। তার মানে পাকিস্তানি আর্মিদের অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখান থেকে রাজাকারে লোক নেয়। মুলুক পাগল সেদিকে যাবে কেন! তার কি রাজাকার হবার সাধ হয়েছে! কালভার্টে ওঠার মুখে পেছনের ক্যারিয়ারে দীনু মেম্বরের শরীর একটুখানি দুলে উঠতেই সাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে মুলুক। কালভার্টের নিচে কাদাপাঁকের মধ্যে একনিমেষে গড়িয়ে পড়ে সাইকেল, গলাপানিতে হাবুডুবু খায় দীনু মেম্বর, কিন্তু মুলুক পাগল যে কোথায় নিরুদ্দেশ হয় কেউ জানে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App