×

জাতীয়

রাজাকারের তালিকা হচ্ছে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০১৯, ১২:১০ পিএম

রাজাকারের তালিকা হচ্ছে
মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও তৈরি হয়নি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় দোসর কুখ্যাত রাজাকার-আলবদর বাহিনীর তালিকা। দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতার উদ্যোগে দালাল আইনে এদের গ্রেপ্তার ও বিচার শুরু হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একে একে ছাড়া পেয়ে যায় সবাই। এক সময় বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায় রাজাকার তালিকা প্রণয়নের কাজ। বরং জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে জাতীয় সংসদ সর্বত্র তাদের দাপটে ধ্বংস হয়ে যায় কুকর্মের অনেক আলামত। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশের প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশিত পাকিস্তানি সরকারের ওই শ্বেতপত্রে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি পূর্বদেশ পত্রিকায় সিকান্দার আবু জাফরের লেখার শিরোনাম ছিল ‘গ্রামে গ্রামে বধ্যভ‚মি তার নাম আজ বাংলাদেশ’। আর গোটা বাংলাদেশকে বধ্যভ‚মি বানানোর নির্মম হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল স্থানীয় কিছু দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামে নানা সংগঠন ও বাহিনী। এদের মধ্যে আলবদর নামের জল্লাদ বাহিনীটি হয়ে উঠেছিল হানাদার বাহিনীর ‘ডেথ স্কোয়াড’। একাত্তরে এসব বাহিনী পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অস্ত্র ও অর্থ পেত। স্বাধীনতার পর ওই তালিকা ধরে রাজাকারদের গ্রেপ্তার শুরু হয়। পরে দালাল আইনে এদের বিচারও চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান দালাল আইন প্রত্যাহার করে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারের মুখোমুখি আসামিদের (রাজাকার) মুক্তি দেন। পরে দেশের বিভিন্ন জেলা ও থানায় তৈরি করা রাজাকারদের তালিকাও নষ্ট করে ফেলা হয়। সম্প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও গণহত্যাকারী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এদের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছিল। তখন রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে তারা ভাতা পেত। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর নিজামী-মুজাহিদরা সেই তালিকা সরিয়ে ফেলে। মন্ত্রী বলেন, হারিয়ে যাওয়া সেই তালিকা উদ্ধার করতে সরকারকে বেগ পেতে হবে। তবু সরকার সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে। জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তালিকা তৈরি করে পাঠাতে। অবশ্যই এই তালিকা জাতির সামনে প্রকাশ করা হবে। রেজাকার বাহিনীর প্রথম ইউনিট খুলনায় : একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনীর নাম ছিল ‘রেজাকার’। এটি অখণ্ড পাকিস্তানপন্থি বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত ছিল। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য একাত্তরের মে মাসে খুলনায় প্রথম রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়। খানজাহান আলী রোডে একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী সমন্বয়ে জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব বাংলা শাখার সহকারী আমির এ কে এম ইউসুফ প্রথম রেজাকার বাহিনী গঠন করেন। তবে পরবর্তীকালে জনগণের কাছে ‘রেজাকার’ শব্দটি ‘রাজাকার’ শব্দে পরিণত হয়। রাজাকার ছাড়াও শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস, আলমুজাহিদ বাহিনী নামে পাকসেনাদের সহযোগীরা যুদ্ধের নয় মাস দেশজুড়ে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, অগ্নিসংযোগ, লুটসহ পৈশাচিক তাণ্ডব চালায়। মুক্তিযুদ্ধে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিশেষ আদালতে বিচার ও রায় কার্যকর হচ্ছে। কিন্তু দেশজুড়ে সাড়ে ১১ হাজার রাজাকার-আলবদর বাহিনীর তালিকাই হয়নি আজও। ফলে মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ৭১-এর চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো বাকি। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর হচ্ছে, এটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু একাত্তরে গোটা বাংলাদেশকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে রাজাকার-আলবদর বাহিনী। এরাই পাকিস্তানি সেনাদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে গেছে। নারীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবীদের চিনতে সহযোগিতা করেছে। লুট করেছে। এদের তালিকা করে প্রতিটি জেলায় জেলায় রাখা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, রাজাকারদের সহযোগিতা ছাড়া পাকবাহিনী এ দেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করতে পারত না। এই রাজাকাররা আমাদের মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে, পাকসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরা লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ প্রতিটি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রকৃত তালিকা নেই কারো হাতেই : বিভিন্ন সংগঠন দাবি করছে, দেশে সাড়ে ১১ হাজার প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীসহ তাদের সহযোগী মিলিয়ে মোট ৪০ হাজারের মতো রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্য রয়েছে। জানা গেছে, ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি এখন পর্যন্ত রাজাকারদের যে তালিকা পাওয়া যায় তাতে কেবল হাজারখানেক রাজাকার এবং শ দুয়েক শান্তি কমিটি ও আলবদর সদস্যের নাম পাওয়া যায়। আলশামস ও আলমুজাহিদের সরকারি-বেসরকারি কোনো তালিকাই এখন পর্যন্ত হয়নি। তবে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর পর অনেক দালিলিক প্রমাণাদি নষ্ট হয়ে গেছে। চাক্ষুস সাক্ষীদের অনেকেই আর বেঁচে নেই। তথ্যমতে, সরকারের হাতে ১১ হাজারের বেশি তালিকা রয়েছে। এ ছাড়া গণতদন্ত কমিশন ১৭, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ৫০, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ১৫৯৭, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার আন্দোলনের তথ্য অনুসন্ধান কমিটি ২৬৫ জন এবং ইসলামী ঐক্যজোট (মিসবাহুর) ৪৫ জনের তালিকা তৈরি করেছে। এ তালিকা সম্পূর্ণ নয়। এর বাইরে আরো অনেক রাজাকার আছে। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের গেজেটেড তালিকাভুক্ত ৫০ হাজার রাজাকার ছিল। ওই সময় তারা সরকারি বেতনভাতা তুলত। মেজর শামসুল আরেফিনের উদ্যোগে প্রতিটি থানা থেকে তথ্য নিয়ে রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো তালিকা হয়নি, যা খুবই দুঃখজনক। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও গবেষক মফিদুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, রাজাকারদের কিছু তালিকা পাওয়া গেলেও আলবদর ছিল অত্যন্ত কুখ্যাত ও গোপন বাহিনী। এর তালিকা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। রাজাকারদের কিছু তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন জেলায় জেলায় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান অত্যন্ত সুকৌশলে এসব চিহ্ন মুছে দেন। আর আমরাও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকায় মনোযোগ দিতে পারিনি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকে পুরো জানতে হলে রাজাকারদেরও জানতে হবে। এদের তালিকা করে এদের ঘৃণা জানাতে হবে। রাজাকার নামটির মধ্যেও ধর্ম নিহিত ছিল, রাজাকাররা ধর্মের রক্ষক। অথচ এরা ধর্মের নামে গণহত্যার সহযোগী ছিল। প্রজন্মকে এসব জানাতে হবে। তাই রাজাকারদের তালিকা প্রয়োজন। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, এদেশ বিরোধী যে কোনো চক্রান্তে রাজাকারের দোসরদের যোগসূত্র রয়েছে। এরাই হচ্ছে নব্য রাজাকার। রাজাকারদের বাচ্চারাও রাজাকারই হয়। এ জন্য এদের তালিকা প্রয়োজন। আমরা আমাদের কাজ করছি। এবার সরকার উদ্যোগ নিলে কাজটি ত্বরান্বিত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App