×

জাতীয়

জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০১৯, ১০:১৯ এএম

জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ
‘যারা গণহত্যা করেছে/শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে/আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু/ সেই সব পশুদের।/ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের/সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে/নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি/ঝরালেই সব/চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না/হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে/ক্যাম্পাসে বাজারে/বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে/আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।’ একাত্তরের ২৫ মার্চের কৃষ্ণপক্ষের রাত। তখনো কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালি জাতির জীবনে। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘুমিয়ে পড়েছেন অনেকেই। হঠাৎই যেন খুলে গেল নরকের সবকটি দরজা। রাত সাড়ে ১১টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে জলপাই রংয়ের ট্যাঙ্ক নেমে এলো ঢাকার রাস্তায়। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। হতচকিত বাঙালি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে এমন বর্বরোচিত হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক। আজ সেই ভয়াল ও বীভৎস কালরাত্রির স্মৃতিবাহী ২৫ মার্চ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। তবে এবার জাতির সামনে এই ভয়াল দিনটি এসেছে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। এবার তৃতীয়বারের মতো ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে জাতীয়ভাবে পালিত হবে ভয়ঙ্কর এইদিনটি। কী ঘটেছিল সেই ভয়াল রাতে : পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালি হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। রাত ১০টা ৩৫। নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ঘিরে ফেলেছে। রিসিপশনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন বাচ্চা ক্যাপ্টেন লিখে দিল বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশি সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। কারফিউর কোনো ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাংকের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুম জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচার। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে জলপাই ট্যাংক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। একে একে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ জন ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ জন ছাত্রী লাফ দিয়ে পড়েছিল। সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দপ্তরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রæর ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দপ্তর। সেই রাতে ১১শ বাঙালি পুলিশের রক্ত ঝরিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়নি, গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দিয়েছিল সবকিছু। পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা, দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কজন গণমাধ্যম কর্মীকেও। এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার, যার ধারাবাহিকতায় নয় মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশের প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষষের জীবননাশ হয়েছিল।’ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা : পরিস্থিতি খারাপ দেখে বঙ্গবন্ধুকে বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ জানান তার শুভাকাক্সক্ষীরা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকবাহিনী তাকে না পেলে একজন বাঙালিকেও বাঁচতে দেবে না। রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাক হায়েনার দল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়ারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দপ্তরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশি জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App