×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের গণহত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশে চলমান ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচারও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। উৎসাহিত হবে গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীরা। ’৭১-এর গণহত্যা হয়েছে ধর্মের নামে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে গণহত্যার অভিশাপ থেকে কখনো মুক্তি পাওয়া যাবে না।

গত শতাব্দীতে এই পৃথিবীতে অর্ধশতাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর ভেতর শতকরা ৮০ ভাগ গণহত্যার বিচার দূরে থাক- আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও মেলেনি। ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যা গত শতাব্দীর নৃশংসতম গণহত্যার একটি। প্রায় ৪০ বছর পর গণহত্যাকারীদের বিচার শুরু হলেও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো সুদূরপরাহত।

২৫ মার্চ সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য আমরা গত দুই যুগ ধরে আন্দোলন করেছি। ১৯৯৩ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাত্রির অনুষ্ঠানে আমরা বলেছিলাম- বাংলাদেশে ‘স্বাধীনতা দিবস’ আছে, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ আছে, কিন্তু যাদের রক্তের মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে সেই ৩০ লাখ শহীদকে স্মরণ করার কোনো সরকারি দিবস নেই।

সে বছর ২৫ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আমরা দাবি করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার পাশাপাশি গণহত্যাকারীদের ধিক্কার জানাবার জন্য একটি দিবস পালন জরুরি এবং এর জন্য ২৫ মার্চ হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন একটি সংগঠন থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে, একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার ক্যানভাসও ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। খালেদা-নিজামীদের দুঃশাসনকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নির্মূল কমিটির কয়েকশ কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী ছাড়া ২৫ মার্চ গণহত্যার ভিকটিমদের স্মরণ করার গরজ তেমন দেখা যায়নি। দুঃসময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর বহু সংগঠন ২৫ মার্চ গণহত্যার ভিকটিমদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য মোমবাতি প্রজ্বলনসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করছে।

২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই আমরা সরকারিভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস ঘোষণা এবং এই দিনটি আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য বিদেশে আমাদের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালিয়েছি। গত এক দশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও আমরা বলেছি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণহত্যার ভিকটিমদের স্মরণ, গণহত্যার অবসান এবং গণহত্যাকারীদের বিচার দাবির জন্য জাতিসংঘের একটি ঘোষিত দিন থাকা প্রয়োজন, যেখানে ২৫ মার্চের পক্ষে আমাদের যুক্তি তুলে ধরেছি।

আমাদের দাবি এবং গণহত্যার ভিকটিম আরো কয়েকটি দেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ বছরের একটি দিনকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করেছে। এর ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির একটি অংশের আর কার্যকারিতা থাকছে না। এরপর থেকে আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশে গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য প্রচার অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের পাশাপাশি এই দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আমরা জানতে পেরেছি ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে চিঠিও দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের অনেক আলোচনায় আমরা দেখেছি ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনের জন্য বিজ্ঞজনরা নানা অভিমত ব্যক্ত করছেন। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার সুযোগ আমরা ২০১৫ সালেই হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের এখন প্রয়োজন ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ।

২০১৭ সালের ১৫ মার্চ আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ৫টি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য প্রদান করেছি। এর ভেতর উল্লেখযোগ্য ৩টি প্রস্তাব হচ্ছে-

বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং অন্যান্য গবেষকরা যা লিখেছেন সেগুলোসহ এতদসংক্রান্ত আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন, বিদেশে আমাদের সব দূতাবাস, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী আইনপ্রণেতা, গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো প্রয়োজন।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাতে হবে, যাতে তারা তাদের পার্লামেন্ট এই মর্মে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোসহ যেসব দেশ ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল তাদের অনুরোধ করা হলেই এ বিষয়ে তারা পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণে সম্মত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এ ছাড়া ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রবাসী বাঙালি এবং নির্মূল কমিটির মতো সংগঠনগুলোর সহযোগিতা চাইতে পারে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় গণহত্যা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করার জন্য দেশে ও বিদেশে গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, আইনপ্রণেতা, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন নিয়মিতভাবে আয়োজন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে।

দেশের ভেতর নতুন প্রজন্মকে ’৭১-এর গণহত্যা সম্পর্কে জানাবার জন্য এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৬ বছর পর হলেও নির্দিষ্ট দিবস পালনের মাধ্যমে ’৭১-এর গণহত্যার সরকারি স্বীকৃতি প্রকৃতপক্ষে ৩০ লাখ শহীদের মহান আত্মদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি দেশে ও দেশের বাইরে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের গণহত্যা অস্বীকারের অপচেষ্টা প্রতিহত করবে। একই সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের আত্মপরিচয়ের সংকটও মোচন করবে এই স্বীকৃতি। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রজন্মকে জানতে হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতিকে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তা অন্য কোনো জাতিকে কখনো দিতে হয়নি।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক উদ্যোগ এবং প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দ্রুত অনুরোধ জানাতে হবে ভারত ও রাশিয়াসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে। পশ্চিমে এ বিষয়ে লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তান যেভাবে ’৭১-এর গণহত্যা অস্বীকার করছে এবং এর দায় বাংলাদেশের ওপর চাপানোর যে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র করছে তা প্রতিহত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়া বাংলাদেশে চলমান ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের বিচারও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। উৎসাহিত হবে গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীরা।

’৭১-এর গণহত্যা হয়েছে ধর্মের নামে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না হলে গণহত্যার অভিশাপ থেকে কখনো মুক্তি পাওয়া যাবে না।

শাহরিয়ার কবির : একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, খ্যাতিমান লেখক ও সাংবাদিক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App