×

মুক্তচিন্তা

কেউ আইন মানে না, কথা রাখে না সড়কে নৈরাজ্যও কমে না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০১৯, ০৯:৩৪ পিএম

কেন এত সড়ক দুর্ঘটনা? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? দুর্ঘটনার কারণগুলো আমাদের জানা। প্রতিকারের উপায়ও আমাদের অজানা নয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? বড় সমস্যা আমাদের আইন না মানার প্রবণতা। আইন প্রয়োগ করার দায়িত্ব যাদের তারাও আইন মানেন না। আবার আইন মেনে চললে যাদের জীবন নিরাপদ হতে পারে তারাও আইন মানেন না। আরেকটি সমস্যা হলো, কথা না রাখা। মালিকরা কথা রাখেন না। অন্যরাও কথা রাখেন না। সবাই বেপরোয়া।

সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। কখনো কখনো দুয়েকটি দুর্ঘটনার পর কিছু প্রতিবাদ হয়, বিক্ষুব্ধ মানুষ যানবাহন ভাঙচুর করে। দুয়েকজন চালক গ্রেপ্তার হয়। ব্যস, ওই পর্যন্তই। যদি কোথাও কোনো শিক্ষার্থী মারা যান তাহলে প্রতিবাদ একটু বেশি হয়। রাজপথ অচল করে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করেন। গত জুলাই-আগস্টে ঢাকায় দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় মৃত্যুবরণ করলে বড় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে নেমে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিলেন। আশা করা হয়েছিল, সবার টনক নড়বে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে, নৈরাজ্য দূর করতে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এগিয়ে আসবে, সচেতন হবে, দায়িত্ববান হবে। কারো গাফিলতি, অবহেলা, আইন না মানার কারণে অকালে কোনো মানুষের করুণ মৃত্যু হবে না। কোনো মায়ের বুক খালি হবে না। কোনো বাবা পুত্র-কন্যাহারা হবেন না। ভাই হারবে না বোন। বোন হবে না ভাইহারা। কোনো পরিবারে নেমে আসবে না স্থায়ী হাহাকার। স্বজন হারানোর কান্নায় বাতাস ভারি হবে না। কিন্তু না, এ আশা পূরণ হয় না। সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হয় না।

গত ১৯ মার্চ একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীকে রাজপথে থেঁতলে দেয় সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস। আবরারের বাবা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেকে বাসচাপা দেয়ার দৃশ্য দেখেছেন। তার বুক ফেটেছে। কিন্তু করতে পারেননি কিছু। আবরারকে হারিয়ে প্রথমে তার সহপাঠীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের সঙ্গে একে একে যোগ দেন আরো অনেক শিক্ষার্থী। শুধু ঢাকায় নয়। দেশের আরো অনেক জায়গায়। দুই দিন ঢাকা ছিল কার্যত অচল। কী লাভ তাতে। আবরারকে হত্যার পর আরো সড়কে হত্যা হয়েছে, হচ্ছে।

কেন এত সড়ক দুর্ঘটনা? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? দুর্ঘটনার কারণগুলো আমাদের জানা। প্রতিকারের উপায়ও আমাদের অজানা নয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? বড় সমস্যা আমাদের আইন না মানার প্রবণতা। আইন প্রয়োগ করার দায়িত্ব যাদের তারাও আইন মানেন না। আবার আইন মেনে চললে যাদের জীবন নিরাপদ হতে পারে তারাও আইন মানেন না। আরেকটি সমস্যা হলো, কথা না রাখা। মালিকরা কথা রাখেন না। অন্যরাও কথা রাখেন না। সবাই বেপরোয়া। দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা একে অপরকে দোষারোপ করি। নিজের কোনো দোষ আছে কিনা তা ভেবে দেখি না।

দুর্ঘটনায় চালকের দায় অবশ্যই বেশি। তবে অনেক ক্ষেত্রে চালকও নিরুপায়, অসহায়। অপরিসর কিংবা চলাচলের অনুপযোগী রাস্তা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, পথচারীদের অসতর্কতা ইত্যাদি নানা কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটতে পারে। তবে চালকের অদক্ষতা দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। এরপর আছে আগে যাওয়ার এবং রাস্তার মাঝখানে বাস থামিয়ে যাত্রী নামানো-ওঠানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে গাড়ির সংখ্যা নাকি ৪০ লাখ। আর লাইসেন্সধারী চালক আছেন ২৩ লাখ। তাহলে বাকি ১৭ লাখ গাড়ি চালাচ্ছেন কারা? আবার যারা লাইসেন্সধারী তারাও সবাই ঠিকঠাক পরীক্ষা দিয়ে লাইসেন্স পেয়েছেন কিনা সে প্রশ্নও আছে।

অনেকে হয়তো ট্রাফিক আইনসহ গাড়ি চালানোর অন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো না জেনে শুধু ‘গরু-ছাগল’ চিনেই লাইসেন্স পেয়েছেন। তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের প্রথমেই দক্ষ চালক তৈরি করতে হবে। সেই উদ্যোগ কি কারো আছে? বলা হবে, রাতারাতি দক্ষ চালক তৈরি করা যাবে না। ঠিক কথা। কিন্তু হচ্ছে, এই সমস্যাটা তো রাতারাতি তৈরি হয়নি। বহু রাত, বহু দিন ধরেই দুর্ঘটনা ঘটছে। দিন দিন এর ভয়াবহতা বাড়ছে। তার পরও কেন চালক প্রশিক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না? কেন আমরা আগের কাজ আগে করছি না। চালকের ব্যবস্থা না করে রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে দিচ্ছি। এ থেকে কি মনে হয় যে, আমরা দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক চাই?

এরপর আসে চলাচলের অনুপযুক্ত গাড়ি রাস্তায় চলা। কী করে এটা সম্ভব হয়? যে বিষয়টির সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত সে বিষয়টি নিয়ে অবজ্ঞা-অবহেলা দেখানোর সুযোগ কেন দেয়া হয়? ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছেন, আবরার আহমেদ চৌধুরীকে চাপা দেয়া সুপ্রভাত পরিবহনের বাসটির চলাচলের রুট পারমিট বা চলাচলের অনুমতি ছিল ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে, কিন্তু বাসটি চলছিল ঢাকার সদরঘাট থেকে গাজীপুর পথে। বিভিন্ন অনিয়ম ও ত্রুটির জন্য বাসটির বিরুদ্ধে ২৭ বার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাহলে বাসটি এত দিন ধরে ঢাকায় চলছিল কী করে?’ যার জবাব দেয়ার কথা, তিনি যখন প্রশ্ন করেন তখন আর কিছু বলার থাকে না। এই একটি ঘটনা থেকেই আমাদের সড়ক ব্যবস্থায় নৈরাজ্যের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

২৭ বার আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পরও যে বাস মালিক-চালক ঢাকার রাস্তায় চালানোর সাহস দেখাতে পারেন তার বা তাদের বোঝা হয়ে গেছে যে আইনের কাজ আইন করবে, তাদের কাজ তাদের করবেন। আসলে এই বাসগুলোর ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দেয়া উচিত। এগুলো যেন জোড়াতালি দিয়ে রং বদলে আবার রাস্তায় নামতে না পারে সে রকম অবস্থা না করলে মালিকদের শিক্ষা হবে না। কোনো দুর্ঘটনায় বড় ধরনের প্রতিবাদ হলে মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে সরকার আলোচনায় বসে, নানা রকম প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, কিন্তু পরে আর সেসব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না। মালিক-শ্রমিকরা সংগঠিত। তাদের কাছে যাত্রীরা শুধু নয়, সরকারও জিম্মি হয়ে আছে। মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় যতটা সোচ্চার, সাধারণ মানুষ তথা যাত্রীদের স্বার্থের ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। এই অবস্থাটা চলতে দেয়া যায় না। সরকারকে তার লম্বা হাত দেখাতে হবে। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার যদি শক্তি প্রয়োগ করে, দমনপীড়ন করে তাহলেও মানুষ অখুশি হবে না। মানুষ আর কথা শুনতে চায় না। প্রতিকার চায়। জীবন বাজি রেখে রাস্তায় বের হতে চায় না। নিরাপদ চলাচলের গ্যারান্টি চায়, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়।

পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে তাকে আটক করে ফৌজদারি মামলা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু পুলিশ-ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অনিয়মের অভিযোগ আছে সেগুলোর কী হবে? মাসোহারা দিয়ে পুলিশকে হাতে রেখে মালিক-শ্রমিকরা আইন অমান্য করে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দেয়। পুলিশের কেউ কেউ সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ কারণেও হয়রানি করে, কিন্তু দোষীদের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখায়। বিশেষ লেনদেনের ব্যবস্থাগুণেই নাকি কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের চোখ উপর-নিচ হয়!

পুলিশ কমিশনার বলেছেন, ‘সড়কে বিশৃঙ্খলার জন্য প্রথম দায়ী হলো বাসগুলো চুক্তিভিত্তিক চালানো। চালকরা বাড়তি আয়ের জন্য এই নৈরাজ্য করে। রাস্তার মাঝখানে ত্যাড়া হয়ে দাঁড়ায়, যাতে অন্য কেউ তাকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। আর পেছনে মাইলকে মাইল যানজট পড়ে, ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়। এরপর যখন সে পরবর্তী স্টপেজের উদ্দেশে বাস ছাড়ে, তখন চেষ্টা করে কত দ্রুত সেখানে গিয়ে বেশি যাত্রী নেয়া যায়।’

এই লাগামহীন প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। বাস মালিকরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন, তাই মুনাফা অর্জনের তাগিদ তাদের থাকবে। তবে মানুষের জীবনের বিনিময়ে মুনাফা নয়। আইনকানুন মেনে, সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রেখে গাড়ি চালিয়ে যদি পর্যাপ্ত লাভ হয় না মনে করা হয়, তাহলে তো এই ব্যবসায়ে বিনিয়োগই করা উচিত নয়। আবার নাগরিক এবং যাত্রীদের সচেতনতার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফুটপাত দখল করে ব্যবসা, পদচারী সেতু ব্যবহার না করা, রাস্তা পারাপারের জন্য শর্টকাট উপায় খোঁজা- এগুলো পরিহার করতে হবে। আইন অমান্য করলে চালক-মালিকের যেমন শাস্তি হতে হবে, তেমনি নাগরিকরাও আইন অমান্য করে মার্জনা পাবে না।

সামান্য একটু সময় বাঁচানোর জন্য আমরা জীবনের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করি না। সময়ের চেয়ে জীবনের দাম যে অনেক বেশি, এটা বিবেচনায় রাখলে আমরা অনেক নিরাপদ থাকতে পারব।

বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App