×

জাতীয়

আর কত রক্ত ঝরবে পাহাড়ে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০১৯, ১১:১৬ এএম

রক্ত ঝরছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। ফলে রক্তাভ হয়ে উঠেছে উঁচু-নিচু সবুজ ভূমি। লাশের পাহাড় ছুঁয়েছে আকাশ। ২১ বছর আগে শান্তির জন্য চুক্তি করা হলেও শান্তি এখনো সুদূর পরাহত। গত ১৫ মাসে সংঘাতের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮ জন। পাহাড়ি, বাঙালি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নিরাপদে নেই কেউই। পরের টার্গেট কে, এই আতঙ্কে ভুগছে পার্বত্য জনপদ। মূলত দীর্ঘদিন ধরেই সবুজ পাহাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে গত দুই দিনে আটজনের প্রাণহানি পাহাড়ের পরিবেশকে ফের অশান্ত করে তুলেছে। অথচ রক্তক্ষয়ী সংঘাত অবসানের লক্ষ্যেই ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল। সংশ্লিষ্টদের দাবি, পাহাড়ের অশান্তির জন্য রাজনৈতিক অনৈক্যই দায়ী। গত দুই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটেছে একাধিকবার। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী জেএসএস ও চুক্তির বিরোধিতাকারী ইউপিডিএফ দুই সংগঠনই এখন দলে উপদলে বিভক্ত। চুক্তি হওয়ার পরই বিরোধিতাকারীরা ইউপিডিএফ নামে নতুন দল গঠিত হয়। পরে ২০১০ সালে মূল জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)। বিবদমান এই দলগুলোর মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলায় রক্তাক্ত হতে থাকে পাহাড়। তবে ২০১৫ সালে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পর পাহাড়ে খুনোখুনি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ ভেঙে আরো একটি নতুন দল গঠিত হয়। ইউপিডিএফের সাবেক নেতা তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে নতুন দলটির আত্মপ্রকাশের পরই ফের অশান্ত হয়ে উঠে পাহাড়। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর থেকে পাহাড়ের দুই জেলা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলো একের পর এক সংঘাতে জড়াতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে গত ১৫ মাসে প্রাণ হারিয়েছে ৫৮ জন। পাহাড়িদের মতে, ‘ভূমি বিরোধ’ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধানতম সমস্যা। চুক্তির আগে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে লক্ষাধিক পাহাড়ি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই পাহাড়িদের জায়গা-জমিগুলো সমতল থেকে যাওয়া ‘সেটেলার’দের দিয়ে দখল করানো হয়। ফলে চুক্তির পর ফিরে আসা পাহাড়িরা তাদের আবাদি জমি ও বাড়ি ফেরত পাননি। সম্প্রতি আইনগত সংস্কার সম্পন্ন হলেও, বাস্তবে কাজ দৃশ্যমান হয়নি এখনো। তাছাড়া অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে আসা শান্তি বাহিনীর গেরিলাদের পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এসব কারণেই অসন্তোষ বাড়ছে পাহাড়ে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান ভোরের কাগজকে বলেন, সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধের জন্য পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি আসবে এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। কিন্তু পাহাড়ে শান্তি আসেনি। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াই পাহাড়ে অশান্তির মূল কারণ। অনেকের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। মতানৈক্য থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে একাধিক পক্ষ। চলছে ক্ষমতার আধিপত্য। ভ‚মি সমস্যার সমাধান হয়নি। এখনো চালু হয়নি ভূমি কমিশন। জেলা পরিষদ নির্বাচন হয় না দীর্ঘদিন। ফলে এখনো শান্তি অধরা। পাহাড়ের অধিবাসীদের মতে, শিগগিরই পরিস্থিতির সামাল দেয়া না হলে পার্বত্য শান্তি চুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে পাহাড়ি জনপদ। আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের কারণে পাহাড়ি-বাঙালি সবার মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে। হত্যা, গুম, অপহরণ, চাঁদাবাজির কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। এ ব্যাপারে জন সংহতি সমিতির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলতে রাজি হননি কেউই। তবে গতকাল এক বিবৃতিতে জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক বিনয় কুমার ত্রিপুরা বলেন, বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়িতে ৮ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মহল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মনগড়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতিহিংসামূলকভাবে জনসংহতি সমিতিকে জড়িত করে অভিযোগ করার ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিবাদ জানাই। ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়ার আগেই এ ধরনের বক্তব্য প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে তদন্তকে যেমন বাধাগ্রস্ত করবে, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের যথাযথ বিচারের দাবি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই। পাহাড়ের যে অব্যাহত হত্যাকাণ্ড চলছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য হাজি কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, পাহাড়ে অস্ত্রবাজি ও রাজনীতি দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। অস্ত্র ও চাঁদাবাজির কারণে পাহাড়ের মানুষের কাছে আঞ্চলিক দলগুলো দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। এই এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে অঞ্চল ভেদে জরুরি অবস্থার মতো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। এদিকে পাহাড়ের পরিবেশ আপাতত শান্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবীর। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, গত দুদিনে ৮ জনের প্রাণহানির ঘটনা নির্বাচনের অংশ ছিল। খুনিদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে। তবে পাহাড়ের শান্তি শুধুমাত্র পুলিশের ওপর নির্ভর করে না। আমরা আমাদের অংশটুকু দেখি। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা রয়েছেন যারা দায়ত্ব পালন করছেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গা থেকে নিরাপত্তার জন্য কাজ করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ : রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি আওয়ামী লীগ সভাপতি হত্যাকারী ও বাঘাইছড়ির ৭ নির্বাচনী কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা না হলে যে কোনো সময় হরতাল-অবরোধসহ কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগ। গতকাল রাঙ্গামাটিতে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিক্ষোভ পরবর্তী সমাবেশে এ হুঁশিয়ারি দেন সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার। এতে আরো বক্তব্য রাখেন রাঙ্গামাটি মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী, সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু, নবনির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান রোমান, আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নিখিল কুমার চাকমা, সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর, আওয়ামী লীগ নেতা অংশু ছাইন চৌধুরী, অংশুপ্রু চৌধুরী, স্বেজচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ জাহান প্রমুখ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App