×

জাতীয়

আতঙ্কের জনপদ বাঘাইছড়ি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০১৯, ১০:৩০ এএম

আতঙ্কের জনপদ বাঘাইছড়ি
রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের ১০ ঘণ্টা পর বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বিলাইছড়ি ফারুয়া এলাকার আলিক্ষিয়ংয়ে এই ঘটনা ঘটে। তিনি উপজেলা নির্বাচনী কার্যক্রম শেষ করে ফারুয়া ইউনিয়ন থেকে বোটযোগে বিলাইছড়িতে ফিরছিলেন। এদিকে দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে চার আনসার সদস্যসহ সাতজনের মৃত্যুর পর বাঘাইছড়ি এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। ঘটনাস্থলে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বুলেটের খোসা। যা থেকে বোঝা যায়, অত্যাধুনিক অস্ত্রের মাধ্যমে অপারেশন চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। অন্যদিকে নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। আর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে উঠছেন। নতুন করে জীবন ফিরে পাওয়ায় সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছেন তারা। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন আনসার সদস্য ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সৃষ্টিকর্তা আমাদের নতুন জীবন দিয়েছেন। সোমবার সাজেক ইউনিয়নের ৩টি ভোটকেন্দ্র থেকে ভোটগ্রহণ শেষে বিজিবির গাড়িকে সামনে রেখে আমাদের তিনটি কেন্দ্রের ৩টি চাঁদের গাড়ি বাঘাইছড়িতে ফিরছিল। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ৯ কিলোনামক স্থানে পৌঁছলে দুই দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে দুর্বৃত্তরা। প্রথম দুটি গাড়ি কোনোরকমে বের হয়ে যেতে পারলেও পেছনের দুটি গাড়িতে বেশি হতাহত হয়েছে। ভাগ্য ভালো যে ড্রাইভার কোনোভাবেই গাড়ি থামায়নি। ড্রাইভার নিজে গুলি খেয়ে গাড়ি নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেছে। যদি ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিত, তাহলে আহত সবারই লাশ দেখতে হতো। জানা গেছে, নির্বাচনী কাজ শেষে গতকাল সকালে স্ত্রী ও সন্তানসহ বোটযোগে নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা। ফারুয়ার আলিক্ষিয়ং এলাকায় পৌঁছলে আগে থেকে ওঁৎপেতে থাকা দুর্বৃত্তরা বোট থামিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই সুরেশের মৃত্যু হয়। হত্যাকাণ্ডের সত্যতা নিশ্চিত করে বিলাইছড়ির ইউএনও আসিফ ইকবাল বলেন, সকালেই ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতালে পাঠানোর হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের পর উপজেলার সর্বত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে ময়নাতদন্তে শেষে দুপুরে তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপরই রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় ব্যারিকেট দিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এতে করে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভ সমাবেশে এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. মুছা মাতব্বর বলেন, পাহাড়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে জনসংহতি সমিতি। অবিলম্বে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজ বুধবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করবে রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগ। তবে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নীলোৎপল খীসা আ. লীগ নেতা সুরেশ হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের অপরাজনীতি করি না। আওয়ামী লীগ উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। অন্যদিকে বাঘাইছড়িবাসীর আতঙ্ক দূর করতে উপজেলায় প্রতিটি পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। এ ছাড়া গতকাল বাঘাইছড়ি উপজেলায় বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিয়ে নিহতদের স্বজনরা প্রশাসনের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরিবারের কাউকে আর ভোটের দায়িত্বে যেতে দেব না। আইনশৃঙ্খলা সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইডি মো. আবুল ফয়েজ, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ, পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির, বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাদিম সারোয়ারসহ প্রশাসনের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। সভায় বাঘাইছড়ি পৌরসভার মেয়র বলেন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় এই রকম ঘটনা আমরা আর দেখিনি। উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো যে এতো বড় ঘটনা ঘটাবে তা আমাদের কল্পনায় ছিল না। আমাদের মনে হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আবারো আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। প্রশাসন যদি এখনই লাগাম টেনে না ধরে তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তিনি বলেন, প্রশাসনের উচিত এখনই চিরুনি অভিযান শুরু করা। বাঘাইছড়ি উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা বলেন, এই হত্যাকাণ্ড একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস সকালে হুমকি দিয়ে বিকালে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে। বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাচনে তার প্রতিদ্ব›দ্বী বড় ঋষি চাকমার নির্দেশে এই হতাকাণ্ড হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির বলেন, বাঘাইছড়ির সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো ছিল। বিজিবির গাড়ি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের গাড়িকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছিল। ভৌগোলিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাহাড়ে ওঁৎপেতে থেকে সন্ত্রাসীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী যেই হোক তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযানে যাচ্ছি। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশিদ বাঘাইছড়ি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, ভোটের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো কোনো দোষ করেনি; তাদের ওপর এই হত্যাকাণ্ড মানে হচ্ছে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা। পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় অভিযান শুরু করা হবে। এই সভার আগে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর তারা বাঘাইছড়ি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে যান। এসময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আহত সাতজনকে ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া নিহত ৭ জনের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়কমন্ত্রীর নিন্দা ও শোক : রাঙ্গামাটিতে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা ও হামলার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়কমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। তিনি বর্বরোচিত এই হামলার ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় তিনি এ দাবি জানান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App