×

মুক্তচিন্তা

গণহত্যা-রাজনীতি ও প্রতিহিংসার ইতিহাস বিশ্লেষণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। বাঙালি তার কাক্সিক্ষত সোনার বাংলাকে অদম্য সাহসিকতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। বাঙালি একক ও অভিন্ন জাতিসত্তার স্বীকৃতি লাভ করে।

বাংলাদেশে গণহত্যা কার্যক্রম অপারেশন সার্চলাইটের অধীনে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দলগুলো ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। এ ছাড়া ২ থেকে ৪ লাখ নারীকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, উর্দুভাষী বিহারিরা জাতিগত সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত ঘটনাসমূহ গণহত্যা হিসেবে পরিচিতি পায়।

বাংলাদেশের গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতি ও সুপার পাওয়ারদের ভৌগোলিক বা কৌশলগত স্বার্থ। পাকিস্তানের রাজনীতির বিষয়টি আমাদের জানা। কৌশলগতভাবে, আমেরিকা ও পাশ্চাত্য ছিল পাকিস্তানের মিত্র এবং মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে গণহত্যার সময় পাশ্চাত্য বা আমেরিকার জনমত ছিল গণহত্যার বিপক্ষে এবং তা এত জোরালো ছিল যে, তাদের সরকার কাঠামোয় পাশ্চাত্য বা পরে আমেরিকাকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন পাকিস্তান বাহিনী প্রবল গণহত্যা ও নির্যাতন চালায় তখনো এমনটি ঘটেছিল। আজ প্রায় ৫০ বছর পার হয়ে গেছে। ভূরাজনীতির পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে এবং গণহত্যা-নির্যাতন সম্পর্কিত অপরাজনীতি আবার আলোচনায় আসছে। এবং আমরা এটি চাই যাতে বাংলাদেশে অন্তত ১৯৭১ সালের গণহত্যা অবসান ঘটে এবং ইতিহাসের সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে বাংলাদেশে আর যাই হোক পরাজিতের, অপরাধীর রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে না। এই রাজনীতি ইতিহাস থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়েছে, অপরাধের রাজনীতি অপরাধ নয় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতির নৈতিকতা নামের বস্তুটি যাকে ‘মরাল ফেব্রিক’ বলা যায় তা নষ্ট করেছে। বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে তা আর কোনো একটি দেশে হয়েছে বলে জানা যায়নি। এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যা আর নারী নির্যাতন কোথাও হয়নি। এত নির্যাতনও কোথাও চালানো হয়নি। কিন্তু আমাদের মানসজগতে তা তেমন স্থান করে নিতে পারেনি। এটি খুবই আশ্চর্যের বিষয়। এমনকি পাশ্চাত্যে ও প্রাচ্যেও এই গণহত্যা তেমনভাবে স্বীকৃত হয়নি। যদি আমাদের মানসজগতে তা স্থান করে নিতে পারত, তাহলে বাংলাদেশে স্বাধীনতা পক্ষের ও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি স্থান করে নিতে পারত না এবং জামায়াত বা বিএনপর এমন উত্থান হতো না। কেন এমনটি হয়েছিল এবং এর অভিঘাট কী হয়েছিল তা আলোচনা করা যেতে পারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ৫ লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সরকার তাদের সম্মান করে ‘বীরঙ্গনা’ আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু পরে এই অভিধা সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কত মানুষ নির্যাতিত হয়েছে তার হিসাব জানা যাবে না। তবে ১ কোটি নারী-পুরুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। শরণার্থী শিবিরে মানবেতর পর্যায়ে তাদের দিন কাটাতে হয়েছে। এটিও নির্যাতনের অন্তর্গত। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল সেটি নিয়ে ইদানীং আগ্রহ-বিতর্ক দুই-ই দেখা দিয়েছে। বিষয়টি একেবারে নেতিবাচক হিসেবে না দেখাই ভালো। কেননা এই বিতর্ক এবং তারপর আগ্রহ গণহত্যার বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। সম্প্রতি ইয়েমেন, সুদান প্রভৃতি দেশে বিশেষ করে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও অং সান সু কির সরকার যৌথ সম্মতিতে রাখাইন রাজ্যে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে এটিই প্রমাণিত যে গণহত্যা বিষয় হিসেবে এখনো প্রাসঙ্গিক।

২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে গণহত্যা শুরু করে। তাদের পূর্বপরিকল্পিত এই গণহত্যাটি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। এ গণহত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগে থেকেই পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত সব বাঙালি অফিসারকে হত্যা কিংবা গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হয়। ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের ইবিআরসিসহ সারাদেশের সামরিক, আধাসামরিক সৈন্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের কথা যেন বহির্বিশ্ব না জানতে পারে সে জন্য আগেই সব বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং অনেককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। তবে ওয়াশিংটন পোস্টের বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব এই গণহত্যা সম্পর্কে অবগত হয়। আলোচনার নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কালক্ষেপণও এই গণহত্যা পরিকল্পনারই অংশ ছিল। ২৫ মার্চ রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তানিদের অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং জগন্নাথ হলের ছাত্রদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও আশপাশের বহু সংখ্যক শিক্ষক এবং সাধারণ কর্মচারীদেরও হত্যা করা হয়। পুরান ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও চালানো হয় ব্যাপক গণহত্যা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে আক্রমণ করে হত্যা করা হয় পুলিশ বাহিনীর বহু সদস্যকে। পিলখানার ইপিআরের কেন্দ্রে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় নিরস্ত্র সদস্যদের। কয়েকটি পত্রিকা অফিস ভস্মীভূত করা হয়। দেশময় ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বিচারে হত্যা করা হয় বিভিন্ন এলাকায় ঘুমন্ত নর-নারীকে। হত্যা করা হয় শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদেরও। ধারণা করা হয় সেই রাতে একমাত্র ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকাতে প্রায় এক লাখ নিরীহ নর-নারীর জীবনাবসান ঘটে।

পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন (৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য) অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষোভ দমনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় কয়েকশ লোক। আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং পাকিস্তান সরকার প্রদেশে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সে রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানাসহ আনসার সদর দপ্তরে সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হাতে বন্দি হয় ৮০০ ইপিআর অফিসার ও জওয়ান। এদের অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিছুসংখ্যক ইপিআর সদস্য রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যান এবং পরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্যসহ পুলিশ ও ইপিআর জওয়ানরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। আন্দোলনরত জনতাকে প্রতিরোধের জন্য তারা রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে এবং মেশিনগানের গুলিতে বাড়িঘর ধ্বংস করে।

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পর দেশব্যাপী সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধারা দখলদার বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। বাঙালি তার কাক্সিক্ষত সোনার বাংলাকে অদম্য সাহসিকতা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। বাঙালি একক ও অভিন্ন জাতিসত্তার স্বীকৃতি লাভ করে। অবশেষে গণহত্যার নির্মমতা ও বর্বরতাকে ম্লান করে দিয়ে লাল সবুজের মানচিত্র খচিত এক সমুজ্জ্বল পতাকা নিয়ে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহমদ : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App