×

জাতীয়

অভিভাবকদেরও দিতে হবে মানসিক পরামর্শ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০১৯, ১১:২৬ এএম

অভিভাবকদেরও দিতে হবে মানসিক পরামর্শ
তিন মাসের ব্যবধানে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের আরেক ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। গত ১১ মার্চ বেইলি রোডের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সারা আক্তার স্বর্ণা। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে পরীক্ষায় ফেলের বিষয়টি আলোচনায় এলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দাবি, একান্ত পরিবারিক কারণেই ছাত্রীটি আত্মহত্যা করেছেন। এর আগে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর একই প্রতিষ্ঠানের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর (১৪) আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র গোটা প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। হাইকোর্ট থেকে ঘটনাটিকে হৃদয়বিদারক হিসেবে উল্লেখ করে কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশনা দেয়া হয়। ওই ঘটনার পরই আত্মহত্যা রোধ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মমতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে কাউন্সেলিং করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে ১২ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল এন্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চারজন শিক্ষকের সহায়তায় বেইলি রোডের মূল ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিকভাবে মানসিক পরামর্শ দেয়া হয়। ওইদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাতৃত্বের সম্পর্ক গড়তে শিক্ষকরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সেইসঙ্গে প্রতিমাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক পরামর্শ দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এ ছাড়া অভিভাবকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানে দুজন মনোবিদ নিয়োগের অঙ্গীকারও করা হয়েছিল। তবে গত তিন মাসে এসব অঙ্গীকারের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এর মধ্যেই গত ১১ মার্চ আত্মহত্যার করে বসে আরেক ছাত্রী। তবে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ হাসিনা বেগমের দাবি, গত জানুয়ারি তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই প্যারেন্টস সভা করে আসছেন। এ ছাড়া শিগগিরই শিক্ষাবিষয়ক মনোবিদ নিয়োগ করা হবে। আগামী ১৮ মার্চ শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নেয়া হবে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, পরীক্ষামুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে দেশে প্রতিবছরই পরীক্ষায় আকৃতকার্য হয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এ প্রবণতার হার সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে ছাত্রীদের মধ্যে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা আর অভিভাবকদের অত্যধিক উচ্চাশার কারণে এ প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। গতকাল বুধবার জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯ উদযাপন উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পড়াশোনার প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয় এমন আচরণ সন্তানদের সঙ্গে করবেন না। সারাক্ষণ পড়ো পড়ো করলে ছেলেমেয়েদেরও মন খারাপ হয়। তারা যেন আনন্দের সঙ্গে পড়ালেখা করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। পরিসংখ্যান মতে, আত্মহত্যার চেষ্টা করে এর চেয়ে আরো ১০ গুণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তথ্যমতে, রাজধানীতে আত্মহত্যাজনিত কারণে প্রতি মাসে গড়ে যে ২১ জন মানুষের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী। যাদের বয়স ২৫-এর নিচে। আবার আরেক গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক সমস্যায় ৪১ দশমিক দুই শতাংশ ও পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। গত ২০১৬ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের আবেগিক বৃদ্ধির বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করার কথা বলেছিলেন। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট না পাওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষককে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ দায়িত্ব দেয়ার নির্দেশনা দিলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া শিশু-কিশোররা কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠছে ও তাদের মানসিক বিকাশে কী করা প্রয়োজন তা জানতে অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত কর্মশালা আয়োজনের কথা থাকলেও বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা মানা হচ্ছে না। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর ড. মো. আবদুল মান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, অতি শিগগিরই প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবিষয়ক মানসিক পরামর্শদাতা নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে চিঠি দেয়া হবে। আপাতত প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে সাইকোলজিকেল কাউন্সেলর হিসেবে কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা রোধের উপায় প্রফেসর মান্নান বলেন, সবার আগে আমাদের পরীক্ষামুখী শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন করে শিক্ষামুখী পদ্ধতি চাল করতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের চাপ কমাতে হবে। এজন্য অভিভাবকদের পরামর্শ দিতে হবে। তবে সারা দেশের বিপুল সংখ্যক অভিভাবককে কাউন্সেলিংয়ের আওতায় আনা খুব দুরূহ ব্যাপার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা আখতার ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীরা বাসাতেই কাটায়। সেজন্য অভিভাবকদের বেশি সচেতন হতে হবে। শুধু শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরই নয়, সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং করতে হবে। জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করা জরুরি প্রয়োজন। কারণ তাদের কারণেই শিক্ষার্থীরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে হতাশায় ভোগে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, শিশুদের চেয়ে আমাদের মায়েদের মধ্যেই প্রতিযোগিতা বেশি। অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের শিশুদের মানসিক চাপে ফেলছে। এজন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের চেয়ে আগে অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App