×

জাতীয়

তবু সরকারি হাসপাতালই ভরসা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৩:০৬ পিএম

তবু সরকারি হাসপাতালই ভরসা
প্রতিদিন সকালে সরকারি হাসপাতালগুলোর বহির্বিভাগের টিকেট কাউন্টারের সামনে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। জরুরি বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত হুইল চেয়ার ও ট্রলির ব্যবস্থা। বেড না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় মাদুর পেতে পড়ে থাকেন অসংখ্য রোগী। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট, হাসপাতাল থেকে ওষুধ দেয়ার কথা থাকলেও তা পাওয়া যায় না, কোথাওবা ছারপোকা ও তেলাপোকার উপদ্রব, যন্ত্রপাতি নষ্ট, চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়দের ব্যবহার এবং খাবারের মান নিয়েও আছে অসন্তোষ। এমন বিস্তর অভিযোগ দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে। এরপরও অসুস্থ হলে দেশের সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা সরকারি হাসপাতালগুলো। স্বল্প খরচে চিকিৎসার আশায় প্রতিদিনই সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিড় করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীরা। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কুমিল্লা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয় নূরুল ইসলামকে (৫৫)। হাসপাতালে বেড না পেয়ে মাদুর পেতে স্বামীকে নিয়ে দুদিন ধরে বারান্দায় আছেন জাহানারা। জাহানারা বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। কী সমস্যা কেউ বলতে পারছে না। ঢাকায় বড় বড় ডাক্তার। তাই এখানে নিয়ে এলাম। চাঁদপুরের জেবুন্নেছা বেগম (৪৫) বুকে টিউমারের চিকিৎসা নিতে এসেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট নিতে সকাল ৮টায় লাইনে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বেলা ১১টায়ও রিপোর্ট হাতে পাননি। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে কত মানুষ। দেরি তো একটু হবেই। তবে সেবাও তো ভালো পাওয়া যায়। হৃদরোগে আক্রান্ত বগুড়ার হাবিবুর রহমানকে (৫৫) নিয়ে তার স্বজনরা এসেছেন হৃদরোগ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে বেড না পেয়ে তিনি দোতলার ২ ও ৩ নম্বর লিফটের সামনে মাদুর পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, মেঝেতে থাকতে সমস্যা হলেও এখানে বড় ডাক্তারদের তো পাওয়া যাচ্ছে। এটাই বেশি। টাঙ্গাইলের বাবুল মিয়া (৩৫) সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) এসেছেন। এক্স-রে রিপোর্ট নিয়ে বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখাবেন। জানান এক্স-রে রিপোর্ট তুলতে গিয়ে তাকে বাড়তি ৫০ টাকা দিতে হয়েছে। গলার শ্বাসনালিতে টিউমার অপারেশনের পর রেডিওথেরাপি নিতে লক্ষীপুর থানার বাসিন্দা জাবেদ আলী (৬২) এসেছেন মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। থেরাপির সিরিয়াল পেতে ইতোমধ্যে তাকে হাসপাতালে আসতে হয়েছে চারবার। তবুও তিনি সিরিয়াল পাননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচের শতকরা ৯৫ ভাগ বহন করে সরকার। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে খরচ হয় ১০ টাকা এবং ভর্তি হতে লাগে ১৫ টাকা। হাসপাতালের ৭০ শতাংশ বেড বিনামূল্যে এবং ৩০ শতাংশ নামমাত্র ভাড়ায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া ডায়াগনসিস খরচ বাবদ সামান্য ফি দিতে হয়। ভর্তির পর থাকা-খাওয়ার সব ব্যয় সরকার বহন করে। এ কারণেই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের অন্যতম ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব হাসপাতাল। ২৬০০ বেডের ঢামেক হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকে সাড়ে চার হাজার। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকেন ১৩০০-১৪০০। অথচ হাসপাতালের বেড সংখ্যা সাড়ে ৮০০। হৃদরোগ হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৪১৪। এখানে রোগী থাকেন ১০২৫ জন। এ ছাড়া প্রতি রোগীর সঙ্গে গড়ে ২-৩ জন স্বজন থাকেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগী এলে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ তাদের নেই। হাসপাতালগুলোতে সব সময় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকে। রয়েছে জনবল সংকট। রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকায় নার্স ও চিকিৎসকদের কম্বিনেশন রোগীবান্ধব নয়। রোগীর দর্শনার্থীরাও সেবা ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে এসব হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। হাসপাতালে সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়–য়া ভোরের কাগজকে বলেন, সব শ্রেণির মানুষের আস্থা ফেরাতে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করেছি আমরা। হাসপাতাল পরিছন্ন রাখা, দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধ, চিকিৎসক-নার্স সবার আচরণ উন্নত করতে পদক্ষেপ নিয়েছি। এ হাসপাতাল এখন তিনবেলা পরিষ্কার করা হয়। এটি শতভাগ দালালমুক্ত হাসপাতাল। থেরাপির সিরিয়াল দেরি হবার প্রসঙ্গে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোশারফ হোসেন জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচশ রোগীকে রেডিওথেরাপি দিতে হচ্ছে। রোগীর অনেক চাপ এখানে। তাই সিরিয়াল পেতে দেরি হয়। নিটোর পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গনি মোল্লাহ বলেন, আমাদের এখানে যে রোগী আসছে তার তুলনায় জনবল এবং বেডের সংখ্যা কম। তারপরও রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য ফ্লোরিং করছি। যাতে রোগীরা ভোগান্তির শিকার না হয় এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে বেসরকারি হাসপাতালে চলে না যায়। আগামী জুন-জুলাইয়ে আমাদের নতুন দুটি ভবন উদ্বোধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি হলে আমরা আরো অনেক বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে পারব। রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোগী বা তার স্বজনের কাছ থেকে হাসপাতালের কোনো কর্মচারী যদি টাকা দাবি করে এ বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেলে আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব, যা অতীতেও নিয়া হয়েছি। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, উন্নত দেশগুলোর মতো নাগরিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা না থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলো নামমাত্র মূল্যে সেবা দিয়ে চলেছে। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী, প্রয়োজনের তুলনায় অল্পসংখ্যক চিকিৎসক ও সহকারী সেবাদায়ক, সীমাবদ্ধ বাজেট, প্রভাবশালীদের চাপ সব চ্যালেঞ্জ কাঁধে নিয়ে রোগীদের জন্যই সাধ্যমতো স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App