×

মুক্তচিন্তা

কোন পথে যাচ্ছি আমরা?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০১৯, ০৯:১৫ পিএম

ধর্ম, সমাজ, জীবন সব জায়গায় খাই খাই মনোভাব আজ এত প্রকট, চুরি করার যে আর কোনো বিকল্প নেই। উপমহাদেশের পণ্ডিত চাণক্য বলেছিলেন, অতিরিক্ত যে কোনো কিছুই বিষ। সে বিষ আজ আমাদের নিঃশেষ করলেও না ক্ষমতা না সাধারণ কেউই তা বোঝে না। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? এর প্রতিকার কোথায়?

আপনি ভাবছেন রিজার্ভের টাকা চুরিটাই সেরা চুরি? ভুল। ভাবছেন আসলে যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ফেরত দেয় না তারাই ডাকাত? জি না। পুল, সড়ক বা রাস্তা নির্মাণে যারা সিমেন্টের বদলে বালি দিয়ে দিলেন তারাই তস্কর? না। আরো আছে। এই যে ধরুন একটা ঘটনার কথা বলি। শনিবার সকালে বন্ধের দিন হলেও কোনো কোনো পোস্ট অফিস খোলা থাকা এখানে নিয়ম। কাজের সমাজ, কাজের দেশ। মানুষ সোমবার থেকে শুক্রবার অবধি কাজ করতেই ব্যস্ত। চাইলেই আপনি হুট করে বেরিয়ে যেতে পারবেন না। দেশে যেমন আমার একটা ফোন আসছে বলে আপনি গায়েব হয়ে গেলেন, সেটা এখানে অসম্ভব। আমি যখন ব্যাংকে কাজ করতাম ভাবতাম সবচেয়ে কঠিন নিয়ম বোধকরি সেখানে। এখন গত কয়েক বছর আমার কাজ পরীক্ষা নেয়া। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজামও নিয়েছি। নিয়েছি ডাক্তার থেকে ইংরেজি টেস্টের প্রাথমিক পরীক্ষা।

সেখানেও আমরা ফোন ব্যবহার করতে পারি না। কড়া নিষেধাজ্ঞা। করলে আপনি ক্যামেরায় ধরা পড়বেন আর এখানে আওয়ামী লীগের মুরব্বি নেই, নেই বিএনপির নেতা যে আমার চাকরি বাঁচাবে। যা বলছিলাম। শনিবার সকালে পোস্ট অফিসে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট নবায়নের ফরম জমা দিতে। কাউন্টারের ভদ্রমহিলা একাধিকবার স্যার স্যার সম্বোধন করে যতœ সহকারে কাজটি করে বিদায় দিয়ে বললেন দুই সপ্তাহের ভেতর পৌঁছে যাবে পাসপোর্ট। ঘটনাটা বললাম এ কারণে, দেশে কথা বলার সময় আমার ছোট দিদি বলছিল তার সবুজ পাসপোর্টটির মেয়াদ হারিয়েছে। সেও যাবে পাসপোর্ট নবায়ন করাতে। ভুল বললাম। সে যাবে না। কারণ গেলে কাজ হয় না। না গেলে হয়। এ কথা আপনারা সবাই জানেন। যেতে হয় না। টাকা দিতে হয়। দালাল নামের এক শ্রেণির ছাপোষা লোকের এটাই ব্যবসা। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ তাদের যারা কর্তা। যারা দালাল মারফত আসা পাসপোর্টে চোখ বুজে সহি করেন। নিয়মে যেসব পাসপোর্ট জমা পড়ে সেগুলো সই করা তার আওতায় পড়ে না। সেগুলো পরিত্যক্ত। মানে পরিষ্কার। টাকা দেবেন কাজ হবে না হলে গুডবাই।

কোথায় নেই চুরি? খেয়াল করবেন আজকাল চোর-তস্করদের আমরা কত সম্মান করি। মাঝে মাঝে দুয়েকটা নিউজ দেখে আপনি মনে করেন বাবা! দেশের আইন কত কঠিন। মিডিয়া কত সাফসুতর। তারা ধরিয়ে দিচ্ছে মিটার রিডারের বড় বাড়ি, বড় গাড়ি। পিয়নের ঢাকায় কত বড় বাড়ি। কোনো করণিক টাকার পাহাড়ে শুয়ে আছেন। খবর নিন দেখবেন কোথাও হিসাবে গোলমাল হওয়ায় ধরা খেয়েছে তারা। না হলে আরামেই জীবন পার করে দিত। মিডিয়ার কর্তাদের নিয়েও কত কেচ্ছা-কাহিনী। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সমাজের নাটবল্টুটাই নড়ে গেছে। এখন বদলে গেছে মূল্যবোধ। আগে আমাদের পাড়ায় ঘুষ খাওয়া লোকটিকে মানুষ বাঁকা চোখে দেখত। তাদের পরিবারের সঙ্গে মেলামেশা ছিল সীমিত। এখন? এরাই মধ্যমণি। কিছু না। একটা বড় হল ভাড়া করে দাওয়াত দেবে, ভালো করে খাওয়াবে, ব্যস। মহল্লাসুদ্ধ লোক ধন্য ধন্য করবে। তাতে যদি কাজ না হয় পাড়ার ক্লাবের অনুষ্ঠানে সব থেকে বেশি চাঁদা দিয়ে ইনি হবেন অতিথি। তারপর তার মুখের বাণী শুনে ঘুমাতে যাবে সবাই।

এই চোর-তস্কর এখন সামাজিক মিডিয়ায়ও প্রবল। ফেসবুক নামের যে মিডিয়া তা এখন নানামুখী ভূমিকা রাখে। এর পজিটিভ দিক আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। দেশে যখন রাজনীতি প্রায় নেই বললেই চলে তখন এই সামাজিক মিডিয়া দুয়েকটা ঘটনায় দেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভুল-শুদ্ধ উভয় দিকে শক্তিশালী এই মিডিয়া আমাকে আমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। স্কুল-কলেজ বাল্যকালের বন্ধুরা ফিরে এসেছে জীবনে। এ এক অসামান্য উপহার। সঙ্গে অবশ্য নানা অনাচার আর বিরক্তিও এই মিডিয়ার অযাচিত উপহার। কত জনের যে ঘর ভাঙছে, কত মন যে দেয়াল তুলছে, তার খবর পাই না আমরা। এখানেও চৌর্যবৃত্তি আছে। আছে ভয়াবহভাবে মানুষকে বিপদে ফেলার ঝোঁক। দেশে যে কয়েকটা অঘটন ঘটেছিল তার পেছনে ছিল এই ফেসবুক। সব থেকে বড় কথা, যা যা ইচ্ছা সেভাবে কাট-পেস্ট করে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা। আমি একবার আমার বাবাকে নিয়ে লিখলাম। প্রয়াত বাবা কেমন করে আমাকে আগলে রাখতেন, ছেলেবেলায় কী খাওয়াতেন- এসব। দেখি কি চাটগাঁর এক সাংবাদিক নামধারী হুবহু সেটা তুলে ধরে তার পিতৃস্মৃতি বলে চালিবে দিয়েছেন। শুধু আমার ছেলের বদল তার ছেলের নাম আর তার বাবার নাম বদলে দিয়ে। আমার রাগ হয়নি। করুণা হয়েছিল খুব। নিজের বাবাকে এভাবে অপমান না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম তাকে।

লেখালেখির বিষয়টা তো সাংঘাতিক। এ বেলায় কেউ বাদ নেই। অবাক হবেন না জেনে আমার শিক্ষকতুল্য বড় ভাই-সম এমনকি সম্মানিত বিজ্ঞজনও বাদ যায়নি। আমি এতে আর রাগ করি না এখন। এটাই আমাদের সমাজ। মাননীয়দের সামনে প্রবন্ধ পড়ছেন ভালো কথা। সে কারণে আমার সামান্য লেখা এমনভাবে কাট করবেন যাতে মনে হয় এটি আপনার? এতে না আমার না তার কারো কোনো লাভ-লোকসান আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু যেটা ভয়াবহ বিষয় সেটা হলো কোথায় নৈতিকতা? আপনি না একজন সম্মানিত? আপনি না বুদ্ধিজীবী? আপনি না নেতা বা দেশের বিবেক? লিখে বলে দেশের জনগণকে হেদায়েত করা আপনি যদি ছোট ভাইয়ের বা বোনের সামান্য কিছু নিজের মনে করে তুলে ধরতে লজ্জা না পান বা বিবেকে বোধ না জাগে কীভাবে সমাজ আগলাবেন আপনি? এটাই ভয়ের। চোখের শরম, অন্তরের বোধ, মনের ঘরনা- সব আজ বিসর্জন দিয়েছি আমরা। দেখে-শুনে মনে হবে কেবল আমি আর আমিই দুনিয়া। আর এই আমি যে আসলে কী চাই, আমি নিজেই জানি না। যিনি নেতা তিনি চান আরো বড় নেতা হতে। যিনি ধনী তিনি চান আরো ধনী হতে। যিনি তারকা তিনি চান আকাশ ফুঁড়ে আরো কোথাও যেতে। যিনি চাপরাসি তিনি চান মাথায় উঠতে। সমাজে আজ চোর-তস্কর আর অনৈতিক মানুষই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে। এই রোগ এখন সর্বগ্রাসী। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি কিছুকে ছাড় দিচ্ছে না।

তাই ভাববেন না টাকা-সম্পদ বা জমি চুরিটাই চুরি। ভেতরে ভেতরে আমাদের সব কিছু চুরি হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ভালো নৈতিক মানুষরা এখন গিনিপিগ। দেশে তারা মাথায় একটা টুপি চাপিয়ে কোনো রকমে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ধর্মও সেসব লোকের দখলে যাদের প্রতিদিন নতুন পাঞ্জাবি আর টুপি কেনার সামর্থ্য আছে। তারা অতি সাধারণ যারা কোনো অনুষ্ঠানে পূজা দেখতে যায়। তাদের মূল্যায়ন নেই কারণ তারা মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে পারেন না। ধর্ম, সমাজ, জীবন সব জায়গায় খাই খাই মনোভাব আজ এত প্রকট, চুরি করার যে আর কোনো বিকল্প নেই। উপমহাদেশের পণ্ডিত চাণক্য বলেছিলেন, অতিরিক্ত যে কোনো কিছুই বিষ। সে বিষ আজ আমাদের নিঃশেষ করলেও না ক্ষমতা না সাধারণ কেউই তা বোঝে না। কোন পথে যাচ্ছি আমরা? এর প্রতিকার কোথায়?

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App