×

মুক্তচিন্তা

পাটের সোনালি দিনের প্রত্যাশায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০৮:৪৭ পিএম

পাটের সোনালি দিনের প্রত্যাশায়
পাটের সোনালি দিনের প্রত্যাশায়

পলিথিন উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার বন্ধ ও পাটপণ্যের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন এবং এর প্রচার বাড়াতে হবে। সারা পৃথিবীর লোক এখন পরিবেশবান্ধব দ্রব্য ব্যবহার করতে আগ্রহী, আর এর জন্য পাট একটি নেয়ামত।

আমার জন্ম পাকিস্তান আমলের প্রথমদিকে। জন্মের পর দেখতাম বাবা-চাচাসহ আশপাশে সবাই পাট চাষ করছে। সে সময় কৃষকের স্বপ্নই ছিল এ পাটকে কেন্দ্র করে। কারণ বিশ্ববাজারে এ দেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের একক আধিপত্য ছিল। রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাতও ছিল পাট।

ব্রিটিশ আমল তো বটেই, পাকিস্তান আমলেও এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। এ পাটের যে কতটা কদর ছিল, তা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আবার আমার চোখের সামনে পাটের সে সোনালি দিন মলিন হয়ে যাওয়ার দৃশ্যও দেখতে হয়েছিল। কিন্তু পাট এ ভূখণ্ডের মানুষের মতোই নানা দুর্বিপাক আর বিপর্যয় থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে।

আমার দেখা, ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে বিতাড়িত হলে এই অঞ্চলের পাটশিল্প নিয়ন্ত্রণে চলে যায় পাকিস্তানিদের হাতে। সেই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানের ২২ পরিবারের অন্যতম আদমজী পরিবারের তিন ভাই ওয়াহেদ আদমজী ওরফে দাউদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী এবং গুল মোহাম্মদ আদমজী যৌথভাবে ১৯৫০ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ২৯৭ একর জমির ওপর আদমজী জুট মিলের নির্মাণকাজ শুরু করেন।

১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর যার উৎপাদন শুরু হয়। পরবর্তীকালে সারাবিশ্বে আদমজী একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়। আদমজীকে স্কটল্যান্ডের ড্যান্ডি শহরের নামানুসারে প্রাচ্যের ড্যান্ডি বলা হতো। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ‘বাওয়া গ্রুপ’-এর উদ্যোগে ১৯৫১ সালের ‘দি বাওয়া জুট মিলস’ স্থাপিত হয়। নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি খুলনার খালিশপুর, দৌলতপুর হয়ে উঠেছিল পাট শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র।

আমার দেশের কৃষকরা অনেক পরিশ্রম করে সে সময় পাট উৎপাদন করলেও তার ন্যায্যমূল্য পেতেন না। এ পাট থেকে যে বড় অঙ্কের অর্থ আসত, তা পশ্চিম পাকিস্তানিরাই নিয়ে বিভিন্ন ইমারত থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ নির্মাণ করত। আর বঞ্চিত হতেন এ দেশের কৃষক। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভেতর অসন্তোষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমার মনে পড়ে, সে সময় রাজনৈতিক একটি স্লোগান ছিল- ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন? আইয়ুব শাহী জবাব চাই’।

১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার জনপ্রিয়তার পেছনে এই পাট শিল্পের ভূমিকাও ছিল। ৬ দফার পঞ্চম দফা ছিল ‘অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে এবং এর নির্ধারিত অংশ তারা দেবে’, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পাট থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য দাবি উত্থাপিত হয়েছে, যা বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে।

একাত্তরে আমরা যেমন দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, তেমনি পাটের জন্যও আমরা যুদ্ধ করেছি। পাট থেকে পাওয়া অর্থ যেন আমাদের কাছেই থাকে, তার জন্য লড়াই করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এ পাটকে ঘিরে। তখন ভাবা হতো পাট বাংলাদেশের মানুষেরই কাজে লাগবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ শিল্পের সমৃদ্ধ অবস্থা বেশি দিন ধরে রাখা যায়নি।

স্বাধীনতার পর পাটখাতকে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য নয় বরং জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিকাশের লক্ষ্যে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশপ্রেমহীন শাসককুলের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত এবং পাটের বিকল্প হিসেবে সিনথেটিক পণ্যের ছড়াছড়ির কারণে বাংলাদেশের পাট তার গৌরব হারিয়েছে। পাট শিল্প চলে গেছে ধ্বংসের মুখে।

শুধু ধ্বংস নয়, বঙ্গবন্ধুর প্রণীত ১৯৭৩-৭৮ সময়ে যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল তা পরবর্তী সময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হলেও সেখানে পাটখাতের উন্নয়নে পূর্ববর্তী পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। এমনকি আশির দশক থেকে অলাভজনক দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করা হতে থাকে পাটকল। এভাবে ৮৭টির মধ্যে ৬০টি পাটকলই বেসরকারি মালিকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়।

এ সময় পাটের বস্তার পরিবর্তে পরিবেশ দূষণকারী পলিথিনের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়ে যায় এবং ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম পাটের সুদিন ফিরে আসবে। শিল্পবান্ধব পরিবেশের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের বিকাশ করা হবে। কিন্তু সেই আশা সুদূরপরাহতই থেকেছে। বরং ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে তৎকালীন সরকারের পাটমন্ত্রী ওয়াশিংটনে বসে ১৭ ফেব্রুয়ারি আদমজী বন্ধের চুক্তি সই করেন।

সেই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালের ৩০ জুন ১২শ কোটি টাকা লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয় আদমজী পাটকল এবং কর্মরত ৩২ হাজার স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিক তাদের চাকরি হারান। সংশ্লিষ্ট আরো লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ব্যাহত হয়। আদমজী পাটকল বন্ধের ব্যাপারটি ছিল বিশ্বব্যাংকের একটি চক্রান্ত।

অন্যদিকে তৎকালীন সরকারের একটি অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে বাংলার পাট আবারো নতুন সম্ভাবনার মুখ দেখছে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পচনশীল ও পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদা বৃদ্ধি বাংলাদেশের সোনালি আঁশের সোনালি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পাট ও পাটপণ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি পাটখাতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় ও পাট মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০’ এবং ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা ২০১৩’ প্রণীত হয়। যা সফলভাবে বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ মার্চকে ‘জাতীয় পাট দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তার উৎসাহে জিন বিজ্ঞানী প্রয়াত মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে সোনালি আঁশ পাটের জিন বিন্যাস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। পাট শিল্পের অগ্রযাত্রাকে ধরে রাখতে দেশের অভ্যন্তরে ছয়টি পণ্য যথা- ধান, গম, চাল, ভুট্টা, চিনি এবং সার মোড়কীকরণে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে।

আরো ১২টি পণ্য মোড়কীকরণে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মানসম্মত পাট উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন, পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এই পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘জাতীয় পাটনীতি-২০১৮’-এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সরকারের এসব সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও ভোক্তাসহ প্রায় ৪ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনায় পাটখাতের জীবন ফিরে এসেছে।

পাটের উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের আবিষ্কার করা পাটের পাতার চা এখন রপ্তানি হচ্ছে। পাট শুধু বাংলাদেশের অগণিত কৃষকের জীবিকার অবলম্বন নয়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বিবেচনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত। পাটের এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে এখনো। পাটের উন্নত বীজের অভাব রয়েছে। দক্ষ লোকবলের অভাব। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য বিদ্যমান। বিপণন কৌশলে দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিংয়ে ঘাটতির রয়েছে। এ সঙ্গে রয়েছে প্রতিদিন অবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া।

দেশে পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। গবেষণা করে পাটের উন্নত জাত তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মোবারক হোসেন পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প পলিথিনসদৃশ্য বস্তু আবিষ্কার করেছেন। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অতি দ্রুত এর উৎপাদন করা জরুরি। এ পলিথিন সহজে পচনশীল এবং পরিবেশবান্ধব। এর ব্যবহার বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি, যা থেকে প্রচুর অর্থনৈতিক আয় সম্ভব হবে। পাট থেকে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন নতুন পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন করতে হবে। পাটের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা ও পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় গুদামের ব্যবস্থা করতে হবে। এসবের জন্য পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে আধুনিক শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে।

কৃষিজমির হ্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাট চাষ জোন গড়ে তোলা যেতে পারে। সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক বজায় রাখতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পলিথিন উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার বন্ধ ও পাটপণ্যের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন এবং এর প্রচার বাড়াতে হবে। সারা পৃথিবীর লোক এখন পরিবেশবান্ধব দ্রব্য ব্যবহার করতে আগ্রহী, আর এর জন্য পাট একটি নেয়ামত। এ সুযোগ ব্যবহার করা জরুরি।

ফলে সুপরিকল্পনামাফিক উৎপাদন অব্যাহত রাখলে পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে এনে দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলা শুধু সময়ের ব্যাপার।

প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ: ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App