×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচন, বিনা ভোটের নির্বাচন এবং গণফোরামের এমপি পেয়েও হারানো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০৮:৫০ পিএম

সুলতান মনসুরের সদস্যপদ বাতিল হয়ে তিনি উপনির্বাচনে আবার জিতে আসতে পারবেন। তেমন সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাকে বহিষ্কার করে গণফোরাম কী পেল বা পাবে? নাকের বদল নরুন? গণফোরাম বিএনপির পথ ধরে দুজন এমপি পেয়েও হারাচ্ছে। আবার কবে গণফোরাম সংসদে যেতে পারবে তা কি কেউ বলতে পারবে? বিএনপি একা পথে পথে না হেঁটে গণফোরামকে পথের সাথী করেছে। পথের ক্লান্তি ভুলে তারা কবে কী করতে পারে, দেখার অপেক্ষা সেটাই।

ঘটনা অনেক। কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা নিয়ে লিখি বুঝতে পারছি না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচন হয়ে গেছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি যে বিজয়ী হবেন তা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ ছিল না। কারণ তার কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।

বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত। ফলাফল যেহেতু পূর্বনির্ধারিত সেহেতু নির্বাচন নিয়ে কোনো উত্তেজনা ছিল না। ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। তারপরও নির্বাচন হয়েছে এবং নতুন মেয়র আতিকুল ইসলাম শপথগ্রহণ করেছেন। এখন তার কাজ শুরু করার পালা। কেমন করবেন নতুন মেয়র। তিনি কি তার পূর্বসূরি আনিসুল হকের সুনামের ধারা অব্যাহত রাখতে পারবেন? তিনি কি নগরবাসীর মনে দাগ কাটার মতো কিছু করতে পারবেন? এসব প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে।

নতুন মেয়র বলেছেন, তিনি চেষ্টা করবেন আনিসুল হকের ধারা অব্যাহত রাখতে। আতিকুল ইসলামের সামনে বড় সমস্যা, তার হাতে সময় কম। তিনি মাত্র এক বছর সময় পাবেন। এক বছর খুব বড় সময় নয়। তবে আন্তরিক উদ্যোগ থাকলে কম সময়েও বেশি কাজ করা সম্ভব। আতিকুল ইসলাম সরাসরি রাজনীতির মানুষ নন। তবে তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। সে হিসেবে তিনি রাজনৈতিক পরিম-লের খুব একটা বাইরের মানুষ নন। আমরা আতিকুল ইসলামের সাফল্য কামনা করি।

দুই. মোট পাঁচ ধাপে দেশের ৪৮১টি উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম দফায় নির্বাচন হবে ১০ মার্চ। উপজেলা নির্বাচন নিয়েও দেশে খুব আগ্রহ এবং উত্তেজনা নেই। তারও কারণ বিএনপিসহ অনেক দলই উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। প্রায় শ’খানেক উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার অবস্থায় আছেন। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থী নেই। কোথাও কোথাও অবশ্য আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থীরা লড়ছেন। এতে নির্বাচন কিছুটা প্রাণ পেয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবার খুব কড়া অবস্থানে নেই। কাউকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়নি। এটা না করলে আরো অনেকেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন।

বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাপারে এবার বিএনপির অবস্থান কড়া। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ায় এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিএনপি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এতে বিএনপি লাভবান হবে, না ক্ষতিগ্রস্ত হবে- সে প্রশ্ন অনেকের মধ্যেই আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও পক্ষপাতমুক্ত হবে না- এই আশঙ্কা থেকে বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জন করছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের কি বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে? বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থেকে বরং সরকারেরই উপকার করছে।

প্রায় একতরফাভাবে নির্বাচিত হচ্ছেন সরকার সমর্থকরা। আবার দলের সিদ্ধান্ত না মানার কারণে দল থেকে তৃণমূলের নেতাদের বহিষ্কার করে বিএনপিই দুর্বল হচ্ছ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভোট ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার যে সংস্কৃতি দেশে চালু হচ্ছে তা গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থি। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর উচিত বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন ও জনমত গড়ে তোলা। প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে সেটাকে নির্বাচন বলে গণ্য করা উচিত নয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করা না হলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়।

তিন. উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণের পর দিন অর্থাৎ ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তাকিয়ে আছেন নির্বাচনের দিকে। ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল কি হবে, সে ব্যাপারে কিছু পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের মনোনীতরাই ডাকসু নির্বাচনে জিতবে। দীর্ঘদিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে।

বিএনপি সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের জন্য ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক চলাচলও সম্ভব ছিল না। ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য ছাত্র সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও হয়তো সব হলে নেই। এ রকম সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে ডাকসু নির্বাচনে জেতা কঠিন। তারপরও কেউ কেউ আশা করছেন যে ডাকসুতে এবার নীবর ভোট বিপ্লব হতে পারে। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড ভালো নয়। তাদের আচার-আচরণের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিরক্ত। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখলসহ অনেক নেতিবাচক কাজে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে গেছে। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগকে ভোটের বাক্সে জবাব দেয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করলেও বিএনপি সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। প্রচার-প্রচারণার সমান সুযোগ নেই বলে অভিযোগ করলেও বাস্তবে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারছে।

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ছাড়াও আরো অনেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর মধ্যে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট এবং কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটি প্যানেল উল্লেখযোগ্য। ছাত্রলীগের অবস্থান সাংগঠনিক বিবেচনায় এগিয়ে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিবেচনায় কারা এগিয়ে সেটা বোঝা যাবে ১১ মার্চ ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর। তবে ডাকসু সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হোক, সেটাই সবার প্রত্যাশা। নির্বাচন জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষে যেন শিক্ষার পরিবেশ কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। ডাকসু একটি ঐতিহ্যের নাম। এবারের ডাকসু নির্বাচন সেই ঐতিহ্যের ধারা রক্ষা করুক, এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

চার. গণফোরামে দুই সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধ এখন দলটিতে বড় সংকট তৈরি করছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি জোটের চরম ভরাডুবি ঘটে। তবে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচন করে ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের দুজন এমপি নির্বাচিত হন। এদের একজন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর মৌলভীবাজার থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন। আরেকজন মোকাব্বির খান উদীয়মান সূর্য প্রতীকে ভোট করে জয় পান সিলেট থেকে। সংসদে যাওয়া না যাওয়া, নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ নিয়ে দেখা দেয় টানাপড়েন।

গণফোরাম, বিশেষ করে কামাল হোসেন শুরুতে শপথগ্রহণের প্রশ্নে ইতিবাচক থাকলেও পরে বিএনপির চাপে তিনি অবস্থান বদল করেন। তবে গণফোরামের দুই এমপি শপথগ্রহণের পক্ষে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত সুলতান মনসুর ৭ মার্চ শপথ নিলেও মোকাব্বির খান শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। তবে তিনি শপথগ্রহণের পক্ষে। গণফোরামের ভেতরে সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। সুলতান মনসুরকে গণফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার সংসদ সদস্যপদ বাতিলের দাবিও জানাবে গণফোরাম। গণফোরাম দাবি জানালেই সংসদ সদস্যপদ চলে যাবে না।

এ ব্যাপারে আদালতের শরণাপন্ন হতে হলে কী রায় পাওয়া যাবে নিশ্চিত নয়। তবে সুলতান মনসুরের সদস্যপদ বাতিল হয়ে তিনি উপনির্বাচনে আবার জিতে আসতে পারবেন। তেমন সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাকে বহিষ্কার করে গণফোরাম কী পেল বা পাবে? নাকের বদল নরুন? গণফোরাম বিএনপির পথ ধরে দুজন এমপি পেয়েও হারাচ্ছে। আবার কবে গণফোরাম সংসদে যেতে পারবে তা কি কেউ বলতে পারবে? বিএনপি একা পথে পথে না হেঁটে গণফোরামকে পথের সাথী করেছে। পথের ক্লান্তি ভুলে তারা কবে কী করতে পারে, দেখার অপেক্ষা সেটাই।

বিভুরঞ্জন সরকার: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App