×

জাতীয়

টেকনাফে সীমান্ত এলাকায় নানা সমস্যায় জর্জড়িত নারীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০১৯, ০৪:৪২ পিএম

টেকনাফে সীমান্ত এলাকায় নানা সমস্যায় জর্জড়িত নারীরা
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বদি আলমের স্বামী পরিত্যাক্ত কণ্যা আনোয়ারা বেগম (৪০)। বেশীরভাগ সময় ক্ষেত খামার ও নার্সাারী করে সংসার পরিচালনা করেছিলেন। পাশাপাশি দু’বছর আগেও হোয়াইক্যং বনবিভাগের সহায়তায় নার্সারী করেছিলেন। কিন্তু রোহিঙ্গা আসাতেই কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর পাশ্ববর্তী এলাকায় গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গাদের লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের বসতি। রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের পর থেকে কোনো কোনো সময় ক্ষেত ও নার্সারী উজাড় করেই চলতো। অনেক সময় রোহিঙ্গাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষেত প্রত্যক্ষ করলেও সংশ্লিষ্টদের নালিশ করেও কোন সুরাহা মেলেনি। এখন তিনি জীবিকা নির্বাহের তাগিদে এখানে সেইখানে আসা যাওয়া করছেন। একই উপজেলা ও ইউনিয়নের মনিরঘোনা এলাকার আলী আকবরের মেয়ে রুমানা আক্তার (৩৫)। তার স্বামী হলো সৈয়দ আলম। তিনিও বন নির্ভরশীল ছিলেন। এখন নার্সারী করা বাদ দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকুরীর জন্য ধর্না দিচ্ছেন। শুধুমাত্র আনোয়ারা বেগম ও রুমানা আক্তার নন। কক্সবাজার জেলার সীমান্ত উপজেলা উখিয়া টেকনাফের অসংখ্য নারী বা বিভিন্ন পেশাজীবী নারী সমাজ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পূর্বে নানান সমস্যায় জর্জড়িত রয়েছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। সরেজমিন বেশ কয়েকজন ও বিভিন্ন পেশাজীবি নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পূর্বে সীমান্ত উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফে অস্থিতিশীল পরিবেশ ছিলনা। যখন যা ইচ্ছা, তাই করা যেতো। এখন তা অনেক বিপরীত। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই নাজুক, যে কোনো সময় বড় ধরণের দূর্ঘটনার কবলে পরতে পারেন নারী সমাজ। জেলার চিকিৎসা কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার শহরে। উখিয়া ও টেকনাফ থেকে নারীরা জেলা শহরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া এখন বেশ কঠিন ব্যাপার। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পূর্বে টেকনাফ শহর থেকে কক্সবাজারে পৌঁছতে আড়াই ঘন্টা সময়ের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে তা দ্বিগুন। পাশাপাশি হাসপাতাল গুলোতে রোহিঙ্গারা ভরপুর থাকতে দেখা যায়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন চাকুরির সুবাধে কক্সবাজার জেলা শহরকে নানাভাবে বিষিয়ে তুলছেন। যা নারীদের জন্য অত্যন্ত দূর্বিসহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে যাতায়াত, চিকিৎসা, শিক্ষা, পণ্যদ্রব্যের উর্ধ্ব গতি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের বিভিন্নভাবে উৎসাহ প্রদান করছে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা। নারীদের প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহ নানাভাবে সহায়তা করছে এসব সংস্থা। আবার অনেক সংস্থা নারীদের কৃষি সরাঞ্জামাদি দিয়ে চাষ ও ক্ষেত খামারে আগ্রহি করে তোলা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে হোয়াইক্যং কাটাখালী এলাকার মোহাম্মদ আলী স্ত্রী রুবিনা আক্তার (৩০), ছালেহ আহমদের স্ত্রী হাসিনা আক্তার (৩৫), মনিরঘোনা এলাকার আব্দু রশিদের স্ত্রী খতিজা আক্তার (৩৫) এবং ছালেহা আক্তার (৩৩) সহ ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের গতকাল (৭ মার্চ) বৃহষ্পতিবার স্থানীয় কৃষি অফিসের সহায়তায় গড়ে তোলা ক্ষেত খামারে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন এলএফ পাপিয়া সুলতানা। এই নারী কর্মী জানানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ফাও এবং কৃষি অফিসের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের কৃষি কাজের নানা সরঞ্জামাদি প্রদান করে সহায়তা করা অব্যাহত রেখেছে। তারপরেও ওই নারীরা রোহিঙ্গাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ বলেন, তাদের কারণে স্থানীয় নারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসানের দাবী জানান তারা। এ ছাড়া এসএসসি বা এইচএসসি পাশ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকুরীতে যোগদান করছেন অল্প শিক্ষিত নারীরা। এতে তাদের ভবিষ্যত মান সম্মত লেখা পড়া নিয়ে শঙ্কিত সচেতন মহল। তারা মনে করছেন এই অঞ্চল থেকে নারীরা উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করতে পিছিয়ে থাকবে। কক্সবাজার কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী পাপিয়া সুলতানা পপি। ভালো ফলাফল করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তিনি এখন এনজিওতে চাকুরীরত। তার মেধা ও মনন এখন চাকুরীতে খাটাচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ভালো পড়ালেখা। শুধু পপি নয়, অল্প শিক্ষিত নারীরা অধ্যায়নকালীন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাকুরীর দিকে ঝুঁকছেন। তাদের লেখাপড়ার ভবিষ্যত অন্ধকার বলে জানান থাইংখালী রাহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুবিনা আক্তার। তিনি বলেন, দরিদ্রতা ও অজ্ঞতার কারণে অভিভাকরা তাদের মেয়েদের লেখা পড়া শেষ না করে চাকুরীতে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। হোয়াইক্যং ফাঁড়ীর সামনে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানি মনোয়ারা আক্তার সুমি (৩০)। আমতলী এলাকার সিরাজুল হকের স্ত্রী।তিনি জানান, রোহিঙ্গা আসাতেই ব্যবাসায় ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বারংবার সমস্যায় মুখোমুখি পড়তে হয়েছে তাকে। উনচিপ্রাং পুটিবনিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প লাগোয়া আব্দুল জব্বারের স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৫৫) বলেন, ‘যেখানে আমরা যুগ যুগ ধরে ধান চাষ ও ক্ষেত খামার করতাম। সে সব জায়গা রোহিঙ্গারা বসতি গড়ে তোলায় এসব চাষবাস থেকে এখন বঞ্চিত। রোহিঙ্গাদের কারণে লাখ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি গুনতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি’। সীমান্ত উপজেলা নারীরা যে সব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, এসব সমস্যা চিহ্নীত করে দ্রুত এর সমাধান সংশ্লিষ্টরা করবেন এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন সচেতন নারীরা। হোয়াইক্যং বিট কর্মকর্তা সৈয়দ আশিক আহমেদ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে নারীদের নানা সমস্যর কথা জানিয়ে বলেন, দুঃস্থ পরিবারের সংসারে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটছে। তার কারণ হিসেবে তিনি রোহিঙ্গাদেরকে দায়ি করেন। টেকনাফ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর কবির জানান, হোস্ট কমিউনিটির নারীদের নানাভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নারী দিবেসে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সীমান্ত উপজেলার নারীদের সমস্যা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা করা হবে। সেই সাথে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে আগের তুলনায় অনেক গুণ ভিজিডি কার্ডের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এ ভিজিডি কার্ড ধারীরা প্রতি মাসে নারীদের ৩০ কেজি করে চাল দেওয়ার কাথাও জানান তিনি। এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রবিউল হাসান জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে নারীদের সমস্যার কথা মাথায় রেখে নানাভাবে সহয়তা করছে সরকার। সে হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার পূর্বে শুধুমাত্র ৩ হাজার ৪৬১ জন নারী ভিজিডি কার্ডের মাধ্যে চাল পেতেন টেকনাফের নারীরা। এখন এ সংখ্যার সাথে ২০ হাজার ভিজিডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নারীদের দুই মাস ব্যাপী বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্ব নির্ভর করে গড়ে তোলা হচ্ছে নারীদের। সেলাই মেশিন, হাসমুরগি সহ কারিগারি নানা যন্ত্রপাতি নারীদের বিতরণ অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে সৃষ্ট সহিংসতায় ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে অবস্থান নিয়েছে উখিয়া ও টেকনাফের দু’টি উপজেলায়। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া টেকনাফের প্রায় ৩০ অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App