×

মুক্তচিন্তা

শ্রবণ বধির হওয়ার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে শব্দদূষণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০১৯, ০৯:২৮ পিএম

চরম বিরক্তিকর, মেজাজ খিটখিটেকারী, পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী, অস্থিরতা বৃদ্ধিকারী, শ্রবণশক্তি বিনষ্টকারী, উচ্চরক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার এবং অনিদ্রাসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী এক নীরব ঘাতকের নাম শব্দদূষণ। শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক ডেসিবেলকে সাংকেতিকভাবে ফই দ্বারা প্রকাশ করা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতানুসারে, সাধারণত ৬০ ফই শব্দ একজন মানুষকে সাময়িকভাবে বধির করে ফেলতে পারে এবং ১০০ ফই শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। শ্রবণশক্তি হ্রাসের বিষয়ে মনোযোগের অভাবে বিশ্বব্যাপী ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক খরচ হয় যা ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

WHO শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা দিবাকালীন ৪৫ ফই রাত্রীকালীন ৩৫ ফই নির্ধারণ করেছে এবং WHO-এর মতে শব্দের মাত্রা ৮০ ফই-এর উপরের হলে তা বিপজ্জনক। বাংলাদেশে শব্দের মাত্রা বিপজ্জনকই থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) শব্দদূষণকে শ্রবণ হ্রাসের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে।

শব্দদূষণের প্রভাবে সর্বস্তরের জনগণ সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে শ্রবণ বধির হচ্ছে। তবে ছাত্রছাত্রী, শিশু, হাসপাতালের রোগী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী এবং গাড়ি চালকরা শব্দদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বে ৪৬৬ মিলিয়ন মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস হয় যাদের মধ্যে ৩৪ মিলিয়ন শিশু। এই শিশুদের শ্রবণশক্তি হ্রাস বেশিরভাগই প্রতিরোধযোগ্য। শৈশবে শ্রবণ শক্তি হারানোদের ৬০ ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় বিকট হর্নের শব্দে ভয় পাচ্ছে, যা তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে শব্দদূষণ সাধারণ মানুষের শরীর ও মনের ওপর তীব্র প্রভাব ফেলছে, যা তাদের সাংসারিক জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ট্রাফিক পুলিশের ওপর শব্দদূষণের ফলে শারীরিক ও মানসিক প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা করে, এ গবেষণার সময় ১১০ জন ট্রাফিক পুলিশকে একটি প্রশ্নোত্তর জরিপ করা হয়।

১১০ জন ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে ১১.৮% পুলিশের শ্রবণ ক্ষমতা কম ছিল, ১৫.৫% পুলিশ মনে করেন তারা ফোনে কথোপকথন করার সময় অনেক কিছু মিস করে, ২৫.৫% পুলিশ অধিক শব্দ দূষণের সময় কথা কম শুনে, ৩৩.৬% পুলিশ টেলিভিশন দেখার সময় ভলিউম বেশি দিতে হয়, ৮.২% পুলিশ একদমই শুনে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার জন্য শব্দের মানমাত্রা- নীরব (হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার), আবাসিক, মিশ্র, ব্যবসায়িক এবং শিল্প এলাকার জন্য দিবাকালীন যথাক্রমে ৪৫, ৫০, ৬০, ৭০ ও ৭৫ ডেসিবল এবং রাত্রীকালীন যথাক্রমে ৩৫, ৪০, ৫০, ৬০ ও ৭০ ডেসিবল নির্ধারিত রয়েছে।

বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ২০০২ সালের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যে কোনো ধরনের হর্ন গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং গাড়িতে বাল্ব হর্ন সংযোজনের নির্দেশ প্রদান করে।

কিন্তু তা কতটুকু মান্য হচ্ছে সেটা বড় প্রশ্ন। প্রয়োজন সচেতনতার, আমাদের নিজেদের শব্দদূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকে শব্দদূষণের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।

আমরা নিজেরা কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারলে নিজে ও আশপাশের মানুষ ভালো রাখতে পারব যেমন : কম শব্দে গান শোনা ও টিভি দেখা, বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এমন মাত্রার শব্দ ব্যবহার করা যেন তা অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ থেকে বাইরে না যায়। সবাইকে শব্দদূষণ বিধিমালা সম্পর্কে জানাতে হবে এবং এর পাশাপাশি দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও আইনের বাস্তবায়ন।

আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, মারজিয়াত রহমান : লেখকদ্বয় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতায় ও গবেষণায় সংযুক্ত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App