×

মুক্তচিন্তা

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন হোন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০১৯, ১০:০৪ পিএম

কয়েক যুগ আগের মতো একুশ শতকের এই সময়ে এসে আমরা নির্বিচারে গ্রামের ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাণিজসম্পদ ইত্যাদিকে নষ্ট করে কিছুতেই ঠিকে থাকতে পারব না। আমাদের প্রয়োজন যথাযথ জ্ঞানে এসবের সংরক্ষণ এবং নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন ঘটানো। সেটি করা খুবই সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন দেশের আইন মেনে চলার সংস্কৃতিতে গ্রামের মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করা। তাহলেই আমাদের গ্রাম উন্নত হবে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জীবনও সুন্দর হবে।

বাংলাদেশে এখন উন্নয়নের গতি শুধু শহরেই নয় গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপকভাবে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে গ্রামীণ অর্থনীতি এখন ভীষণভাবে চাঙ্গা। কৃষি কাজ, নানা ধরনের খামার, ফলদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সব ধরনের কর্মকা- গ্রামে সম্প্রসারিত হয়েছে। ব্যাপকসংখ্যক মানুষ এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। আবার ব্যাপকসংখ্যক গ্রামের অদক্ষ জনগোষ্ঠী বিদেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছে- যারা বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা গ্রামের স্বজনদের কাছে প্রেরণ করছেন। ফলে গ্রামে আগে যেভাবে বাড়িঘর ছিল এখন প্রতিটি মানুষই হাতে নগদ অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে নতুন ঘর তৈরি করছে অথবা নতুন করে বাড়িঘর নির্মাণ করছে।

কয়েক বছর আগে গ্রামের নতুন কর্মজীবী মানুষ বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে কৃষিজ জমি ক্রয় করতে চেষ্টা করত, এর পর থাকার ঘরটি টিন ও ভালো কাঠ দিয়ে উন্নত করার চেষ্টা করত। এখন দেশের অভ্যন্তরেও কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ায় ব্যাপকসংখ্যক মানুষ দালানকোঠা তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেছে। বাড়ির আশপাশে খাল-বিল ভরাট করে তাতে নতুন নতুন আবাসন তৈরি করছে। গ্রামাঞ্চলকে এখন আর সে কারণে আগের মতো চেনা যায় না। আগে যেখানে বাড়িতে দু-চারটি টিনের ঘর কিংবা মাটি বা শণের ঘর দেখা যেত, এখন এসবই বিলুপ্ত ঘটতে যাচ্ছে।

বাড়ির জন্য নতুন নতুন বিল্ডিং হচ্ছে, জায়গা না হলে মাঠে মাটি ভরাট করে তাতে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। আগে যেখানে চাষের জমি ছিল এখন সেখানে থাকার বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে। ফসল ফলার জমিতে পুকুর কাটা হচ্ছে, রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে, এমনকি হাটঘাট, নানা ধরনের দোকানপাট, পোল্ট্রি ফার্ম, ছোটখাটো শিল্প প্রতিষ্ঠানও সেখানে তৈরি হচ্ছে। যার হাতে টাকা আসছে সে-ই ইচ্ছামতো কৃষিজ জমিতে নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করছে, খালবিল-পুকুর ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ করছে। অবশ্য গাছ, তরুলতা, লতাপাতা ইত্যাদিরও বপন হচ্ছে। ফলে গ্রামের পরিবেশ এখন দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। এই বদলটি কতটা ভবিষ্যৎকে খাদ্য, পরিবেশ, জলজপ্রাণী ও কৃষিজ পণ্যসামগ্রীর উৎপাদনে ভারসাম্যপূর্ণভাবে রাখছে, সেটি মস্তবড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ২ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের (আইইবি) ৫৯তম কনভেনশন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কৃষিজমি ও জলাধার নষ্ট করে স্থাপনা নয়। তার এই বক্তব্যের মধ্যে দেশে কৃষিজ জমি ও জলাধার নষ্ট করে যেভাবে নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে তার প্রতি সতর্ক বার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের বিশেষজ্ঞমহলকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান। আসলে গ্রামে গত কয়েক দশকে যেভাবে কৃষিজ জমি নষ্ট করা হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে খাদ্যশস্য উৎপাদনসহ নানা ধরনের ফসলাদি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বড় ধরনের সংকট তৈরি হতে পারে।

কেননা আমাদের জমি কমে যাচ্ছে আবার বসতবাড়ি ও পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, স্থাপনা ইত্যাদিতে জমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখভাল করার মতো যথাযথ কর্তৃপক্ষ গ্রামে নেই। ইউনিয়ন কাউন্সিল কিংবা স্থানীয় প্রশাসনও এগুলোকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাধারণ মানুষ বিত্তবৈভবে কিছুটা সমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্মুক্ত পরিবেশে নিজের মতো করে বাড়িঘর নির্মাণ ও স্থাপনা তৈরি করে চলছে। এর জন্য তারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিচ্ছে না।

বাড়িঘর কোথায় কীভাবে নির্মিত হলে যাতায়াত, থাকা, পয়ঃপ্রণালি, স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থা ইত্যাদি কীভাবে নিশ্চিত হবে, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। অনেক জায়গাতেই শত বছরের পুরনো জলাধার ভরাট করে বাড়িঘর ও নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এতে নষ্ট হচ্ছে মাছ চাষের দীর্ঘদিনের অভয়ারণ্য। আবার বাড়িঘরে শত বছরের গাছপালা, বনজঙ্গল ইত্যাদি কেটে তৈরি করা হচ্ছে মানুষের বসতি।

এর ফলে পশুপাখি, জীবজন্তু হারাচ্ছে তাদের দীর্ঘদিনের বসতি। মৎস্য, পাখিসম্পদ, প্রাণিজসম্পদ ও গাছ-তরুলতা এভাবে বিলুপ্তি মানুষের বসতিতে ভারসাম্যহীনতার যে সংকট তৈরি হয় সেটি বেশিরভাগ মানুষেরই জানার বাইরে থেকে যাচ্ছে। বাস্তু ব্যবস্থার এই সংকট মানুষ মানুষের বসতিতে অনিবার্যভাবেই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। এটি বাস্তুবিজ্ঞানের যে কোনো ধারণা মানুষের জানা থাকার কথা। কিন্তু আমাদের গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ পশুপাখি, জীবজন্তু, প্রাণিজসম্পদ ও মৎস্যসম্পদের সঙ্গে সহবাসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা রাখে না।

ফলে তারা নষ্ট করছে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের জায়গা। দখল করছে নিজেদের ভোগ-বিলাসের লক্ষ্যে। কিন্তু প্রকৃতিতে মানুষ ভারসাম্যহীনভাবে টিকে থাকতে পারে না। মানুষের প্রয়োজন অক্সিজেন, মাছ, পশুপাখির মাংস, দুধ, ডিম এবং তাদের সংস্পর্শ এর বাইরে গিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ, রোগ জীবাণু, ভাইরাস ইত্যাদি সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে। তা ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে পানির প্রবাহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় যেখানে আগে পানি স্বাভাবিক নিয়মে জমির মাটির প্রয়োজনে অবস্থান করত এখন সেখানে কৃত্রিমভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে হয় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নতুবা কোথাও কোথাও পানি দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করার ফলে কৃষিজ ফলন নষ্ট হচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলে এখন এ দৃশ্য মোটেও নতুন নয়। অনেক জায়গাতেই এখন আর বর্ষা সেভাবে আসে না, যায়ও না। একটা বৈপরিত্য চলছে। এর ফলে জীবন-জীবিকার মধ্যে অবচেতনে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, প্রকৃতি থেকে শিক্ষা না নিয়ে যেভাবে প্রকৃতিতে নিধন করা হচ্ছে, মানুষ সেখানে কলোনি বিস্তার করছে। সেটি প্রকৃতির বিরুদ্ধেই মানুষের যুদ্ধ যেন বলে দিচ্ছে। এর পরিণতি হচ্ছে মানুষের জীবন সেখানে দিন দিন অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। জলাধারের অভাবে মৎস্য শিল্পের অভাবই শুধু নয়, পানির দুষ্প্রাপ্যতাও সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঋতু বৈচিত্র্যের এতদিনকার ধারাবাহিকতায় এখন ছেদ পড়ছে। বর্ষাকালে বর্ষা হারাচ্ছে, গরম বৃদ্ধি পাচ্ছে, শীতকালে শীত সংকুচিত হচ্ছে।

আবার গ্রীষ্মকালে অযাচিত শীতের হাওয়া আচমকা উঁকি দিচ্ছে। এসবই মানুষের শরীরের ওপর ভীষণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন হচ্ছে এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে যেসব অজ্ঞতা ও কুসংস্কার রয়েছে তা দূর করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া, মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণাকে শক্তিশালী করা- যাতে প্রতিটি মানুষ বুঝতে পারে মানুষের জন্য কোথায় বসতি, কীভাবে নির্মাণ করতে হয়, কীভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হয়, কৃষিজ জমি কেন আমাদের ইচ্ছমতো নষ্ট করা উচিত নয়, কেন গ্রামের বনজঙ্গল, গাছপালা উজাড় করে দিতে নেই। কেন সেখানে পাখি ও নানা প্রজাতির প্রাণীর বসতি থাকা অপরিহার্য।

আবার শত বছরের পুরনো জলাশয়গুলো আমাদের যেসব মৎস্যসম্পদ দিয়ে আসছিল সেগুলো আমাদের পুষ্টির জন্য কতটা অপরিহার্য। পানি কেন গ্রামে জলাধার থেকে পাওয়ার সুযোগ রাখা দরকার। রাস্তাঘাট কেন যত্রতত্র নির্মাণ করতে নেই। এসবই সরকারের সংশ্লিষ্ট কৃষি প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অন্যান্য বিভাগের দক্ষ, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের পরামর্শে করতে হয়- সেই সুযোগ গ্রামের প্রতিটি মানুষেরই নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

কয়েক যুগ আগের মতো একুশ শতকের এই সময়ে এসে আমরা নির্বিচারে গ্রামের ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, প্রাণিজসম্পদ ইত্যাদিকে নষ্ট করে কিছুতেই ঠিকে থাকতে পারব না। আমাদের প্রয়োজন যথাযথ জ্ঞানে এ সবের সংরক্ষণ এবং নিজেদের জীবনমান উন্নয়ন ঘটানো। সেটি করা খুবই সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন দেশের আইন মেনে চলার সংস্কৃতিতে গ্রামের মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করা। তাহলেই আমাদের গ্রাম উন্নত হবে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জীবনও সুন্দর হবে। সেভাবেই গ্রামের মানুষকে চলতে হবে।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App