×

মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশের পরিকল্পনা ব্যবস্থা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০১৯, ০৯:২৪ পিএম

উপযুক্ত ও দক্ষ শিল্প প্রশাসক এবং উদ্যোক্তার মনোভাববিহীন আমলাদের দিয়ে এ জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানায় সার্বিক উৎপাদন যথাযথ হয়নি। বরং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মিল-কারখানার পরিসম্পদ আত্মসাৎ হয়েছে এবং ট্রেড ইউনিয়ন মিল-কলকারখানায় উন্নয়নে সহায়তার পরিবর্তে সম্পদ ও সুযোগ লুটপাট করেছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন প্রেক্ষাপটে শেষার্ধে শিল্প-কলকারখানাগুলোর বিজাতীয়করণ শুরু হয় এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ।

বিদেশি শাসনের নিগড়ে আর্থ-সামাজিক শোষণ বঞ্চনা আর বণ্টন বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার বাঙালির ঐতিহাসিক মুক্তির সংগ্রাম দীর্ঘদিনের পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জনে চূড়ান্ত বিজয়ে বিভূষিত হয়। স্বাধীন স্বার্বভৌম জনগণের জীবনযাত্রার মানের দ্রুত উন্নতি সাধনই ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা। বাংলাদেশের সংবিধানেও গণমানুষের উন্নত জীবনযাত্রার স্বপ্ন পূরণের নিশ্চয়তা স্বীকৃত হয়েছে। সংবিধানের ১৫ ধারায় রাষ্ট্রকে উপযুক্ত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ তথা উন্নততর জীবনযাত্রা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দেশের পরিকল্পিত উন্নয়নের এই দায়িত্ব অর্পণ করে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়। স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশেই বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের ভিত্তি রচিত হয়। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে প্রাদেশিক পরিকল্পনা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সরকারি বিনিয়োগে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তাতে অর্থসংস্থানের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা। পরিকল্পনা বোর্ড পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রযোজ্য উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প মূল্যায়ন এবং সেসব প্রকল্পের আকার ও অবয়ব নির্ধারণ করত।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও একটি ক্ষুদ্রকায় পরিকল্পনা সেল তৈরি করে, যাকে আজকের পরিকল্পনা কমিশনের সূতিকাগার বললে অত্যুক্তি হয় না। সে সময় প্লানিং সেলের কাজ ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পুনর্বাসন পুনর্গঠন কাজে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে তার কর্মকাঠামো ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই নতুন সরকারের প্রথম ও প্রধান একটি পদক্ষেপ ছিল ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন গঠন এবং এর ডেপুটি চেয়ারপারসন ও সদস্যদের নিয়োগদান। সে সময়ে মন্ত্রিপরিষদে নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় : (১) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন রূপকল্প নির্মাণ। (২) উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের নির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়ন, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অর্থসংস্থান ও কার্যবিধি সংরক্ষণে সুপারিশদান এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি সংশ্লিষ্ট হওয়া। (৩) বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে গৃহীতব্য উন্নয়ন পরিকল্পনার নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সমন্বয় সাধন।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ বা ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের (এনইসি) পক্ষে উন্নয়ন ও নীতিনির্দেশনা পরীক্ষা পর্যালোচনার কাজও পরিকল্পনা কমিশনের। এনইসিকে একটি মিনি মন্ত্রিপরিষদ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়, মন্ত্রিপরিষদের অর্থনৈতিক কার্যাবলি বিষয়ক মন্ত্রীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এনইসি গঠিত হয়। একই সঙ্গে এনইসির নির্বাহী কমিটি সংক্ষেপে একনেকের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয় এভাবে- (ক) উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বিবেচনান্তে অনুমোদন, (খ) উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং (গ) অর্থনীতির সার্বিক অগ্রগতি এবং তদসংশ্লিষ্ট নীতিসমূহ বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ করা, তথা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কাছে সুপারিশ রাখা। পরিকল্পনা কমিশন পাঁচ বছরমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। বাংলাদেশে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের ইতিহাসে দুটি পর্ব বা পর্যায় শনাক্ত করা চলে : প্রথম পর্ব ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসনামল; দ্বিতীয় পর্ব বাংলাদেশ আমল। প্রথম পর্বে ১৯৫১-১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রণীত হয় একটি ষষ্ঠ বার্ষিকসহ তিনটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। দ্বিতীয় পর্বে প্রথমদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন কাজে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, ক্ষয়ক্ষতির সুমার পরিসংখ্যান সংগ্রহে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণীত হয় ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ের জন্য। এরপর দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পরিবর্তে একটি অন্তর্বর্তীকালীন দ্বিবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার (১৯৭৮-৮০) কাজ হাতে নেয়া হয়। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সময়ে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শুরু হয় ২ বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৭-২০০২ সময়ের জন্য। ২০০৩-২০১১ সালের জন্য সরকার ষষ্ঠবার্ষিক পরিকল্পনার স্থলে দারিদ্র্র্য নিরসন কৌশলপত্র (অন্তর্বর্তীকালীন ও পূর্ণাঙ্গ) প্রণয়ন করে। ২০১১ সালে প্রণীত হয় ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যার সমাপ্তি বছর ২০১৪-১৫। ইতোমধ্যে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের ভাবনা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিকল্পনা ব্যবস্থার পথিকৃৎ দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। ষাটের দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, মোশাররফ হোসেন, আবু মাহমুদ, মোজাফফর আহমদ প্রমুখরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন কর্মধারায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ এবং তদ্বারা সৃষ্ট বৈষম্য তুলে ধরে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ন্যায্য স্বার্থ উদ্ধারে পরিকল্পনা ধারণাপত্র ইত্যাদি তৈরি করতেন। মূলত এ সব বুদ্ধিজীবীর চিন্তা-চেতনার সূত্র ধরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি প্রণয়ন করেন। মূলত এ ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার লাভের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ‘মুক্তির ও স্বাধীনতা সংগ্রামে’ উপনীত হয়। সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের দাবি সংবলিত স্বায়ত্তশাসন লাভের প্রেরণা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের অন্যতম নিয়ামক ও প্রভাবক বিষয় হিসেবে দাঁড়ায়। বলাবাহুল্য এসব দাবি ও প্রত্যাশা-প্রেরণার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। বিজয়ী দলের কাছে দেশের শাসনভার অর্পণের পরিবর্তে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নবগঠিত পরিকল্পনা কমিশন মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধে তাড়িত হয়ে কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুপ্রতিম দেশ ও অর্থনীতি থেকে দ্বিপাক্ষিক অনুদান গ্রহণের মাধ্যমে স্বনির্ভর দর্শনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়নের কর্মধারা গৃহীত হয়। সাবেক পাকিস্তানি শিল্পপতি ও মালিকদের রেখে যাওয়া শিল্প-কলকারখানা জাতীয়করণ করে তার নিয়ন্ত্রণভার রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার গ্রহণ করে। উপযুক্ত ও দক্ষ শিল্প প্রশাসক এবং উদ্যোক্তার মনোভাববিহীন আমলাদের দিয়ে এ জাতীয়করণকৃত শিল্প-কলকারখানায় সার্বিক উৎপাদন যথাযথ হয়নি। বরং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মিল-কারখানার পরিসম্পদ আত্মসাৎ হয়েছে এবং ট্রেড ইউনিয়ন মিল-কলকারখানায় উন্নয়নে সহায়তার পরিবর্তে সম্পদ ও সুযোগ লুটপাট করেছে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন প্রেক্ষাপটে শেষার্ধে শিল্প-কলকারখানাগুলোর বিজাতীয়করণ শুরু হয় এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে বাংলাদেশ। আশির দশকে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানসহ বিভিন্ন পোশাক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয় এবং দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপকভাবে বিদেশি ঋণ গ্রহণ শুরু হয়। এ প্রেক্ষাপটে নব্বইয়ের দশকে এসে দেশের শিল্প সম্ভাবনা এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক শিল্প উৎপাদন পরিবেশ উদ্ভব হয়। সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় দেশজ ধ্রুপদী যোগাযোগ ব্যবস্থা (নৌপথ) এবং স্বল্প ব্যয়ী মাধ্যম (রেলওয়ে) উপেক্ষা করে বাংলাদেশ সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে এতবেশি অগ্রগামী হয়ে যায় যে রোড ডেনসিতে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সেরা দেশের তালিকায় চলে আসে। নিজ দেশের সম্পদ ও অবকাঠামো এবং সহনশীল উপযুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা না গড়ে ওঠা সত্ত্বেও বিদেশি ঋণের টাকায় গড়ে তোলা সড়ক অবকাঠামো মেরামত পর্যায়ে এসে তহবিল ঘাটতিতে পড়ে কেননা মেইনটেন্যান্সের জন্য বিদেশি ঋণ অনুদান কিছুই মেলে না।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App