×

মুক্তচিন্তা

যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০১৯, ০৯:৪০ পিএম

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ- এসব প্রাণঘাতী যুদ্ধের পর ইউরোপে, আমেরিকায় মানুষ আর যুদ্ধ দেখেনি। যদিও আইরিশ আর ইংরেজদের লড়াই চলে এখনো। কিন্তু এমন রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ উন্মাদনা শেষ হয়ে গেছে। শুধু উপমহাদেশেই কিছু হলো না। কত সরকার এল-গেল ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতা শেষ হলো না।

যুদ্ধ কে চায়? মানুষ কখনোই যুদ্ধ চায় না। চায় না বলেই হিটলার হেরেছিলেন। হেরে গেছে অত্যাচারী সম্রাটরা। কারো রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তারপরও যুদ্ধ হয়। রাজনীতি যখন ব্যর্থ হয়ে যায় তখন কোনো কৌশল আর কাজ করে না। পাকিস্তান ও ভারত একদা একদেশ হলেও এই দুদেশের জন্ম বৈরিতায়।

ব্রিটিশ যাওয়ার সময় এ দুদেশের ভেতর চিরকালীন বৈরিতার বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। ধর্মের নামে চলমান এই দুশমনী আজো প্রবহমান। দুদেশের মূল সমস্যার কেন্দ্র কাশ্মির। সেই কবে থেকে যুদ্ধংদেহী এই জায়গা। আজো তা চলছে।

এবার নাটক জমে উঠেছে। কাশ্মির নিয়ে দুশমনীর বড় সমস্যা মানুষের থাকা না থাকা। সে এলাকার মানুষ যে আসলে কী চায়, কেন চায়- সেটাই আজ অবধি বোঝা গেল না। একদিকে আজাদী কাশ্মির আরেকদিকে ভারতীয় কাশ্মির। মাঝে মাঝে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। আইয়ুব খান যখন গদিতে আমরা তখন ছোট ছিলাম।

পাক জেনারেলদের তখন রমরমা। মনে আছে সন্ধ্যা হলে আমরা বাঙ্কার থেকে বেরুতাম। কোথায় সীমান্ত আর কোথায় চট্টগ্রাম। তারপরও আমাদের বাড়ির কাছে কয়েকটা বাঙ্কার খোঁড়া হয়েছিল। সেগুলো আবার ইংরেজি বর্ণমালার ভি, জি- এসব সাইজের করে বানানো হতো। ঢোকার পর ঘাসপাতা দিয়ে ঢেকে দেয়ার রেওয়াজ।

আর সাইরেন শেষ হলে বেরিয়ে আসা। একটা বিষয় বুঝতে পারতাম না, আমরা তো জন্মলগ্ন থেকেই জেনেছি, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ভারতের দালাল তাহলে ভারতীয় বোমার ভয়ে গর্তে লুকাব কেন? পরে বুঝলাম বোমা বা বিমান হামলা কোনো জাতি-ধর্ম-ধর্ম-বর্ণ চেনে না। তার কাজ মানুষ মারা।

এক সময় পরিবেশ পাল্টে গেল। গোটা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি হয়ে গেল ভারতের দালাল। পাকিস্তানের দুশমন। বঙ্গবন্ধু ও তার দূরদর্শী রাজনীতি আমাদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। কেবল একটি পতাকা আর গান না। এই বাঁচার আরেক অর্থ মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যুদ্ধের দামামা থেকেও মুক্তি দিয়ে গেছে।

না হলে আজ আমাদের শুদ্ধ বা ভুল যাই হোক পাকিস্তানের হয়ে কথা বলতে হতো। আমরা কারো হয়ে কথা বলব না। আমরা বলব যুদ্ধের কুফল আর মানুষের কথা নিয়ে। ভারত বা পাকিস্তান কেউই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। পাকিস্তানের এখন বেহাল দশা। সামরিক দিকে শক্তিশালী হওয়ার কুফলে তারা দেশের আয়, উন্নতি, অগ্রগতি বিসর্জন দিয়ে সব তাতেই ঢেলে দিয়েছে।

ফলে তাদের কপালে জুটেছে সন্ত্রাসী দেশের তকমা। প্রতিবেশী দেশ কারো সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক নেই। এমনকি মৌলবাদী সমাজের আফগানিস্তানের সঙ্গেও না।

অন্যদিকে ভারতের আয়-উন্নতি তাকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে নিলেও গান্ধী-নেহেরুর দেশে এখন বিজেপি আছে দেশ শাসনে। বিজেপির মতো মৌলবাদী দল দিল্লির মসনদে বসবে সে ভাবনা কেউ সে দিনও ভাবতে পারেনি। অথচ আজ তাই সত্য।

এখন আমরা দেখছি উভয় দেশ পৌঁছে গিয়েছে চরম জায়গায়। মূলত কাশ্মির নিয়ে বিবাদের ফল আজকের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। খেলা বলছি এই কারণে, উভয় দিক থেকে হুঙ্কার আর প্রতিশোধের ভেতরও চলছে সমঝোতার মায়াকান্না। ভারতীয় বাহিনীর ওপর জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে ভারত যখন আক্রমণ চালালো তখন পাকিস্তান তাদের আণবিক বোমার কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি। পাক জেনারেল সাবেক সরকারপ্রধান প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বলেছেন কে কত বোমা মারলে কী হতে পারে।

এক পর্যায়ে তিনি ৫০টি বোমা একসঙ্গে মারার খায়েশও জানিয়েছেন। অন্যদিকে মোদিও তার হুঙ্কার বজায় রেখেছেন। ধারণা করতে পারি সুর নরমের কারণ বিদেশি দেশগুলো। কূটনৈতিক কারণে তারা কাগজে-কলমে এক কথা বললেও অন্তরে সন্ত্রাসী আর মৌলবাদ বিদ্বেষে ভরপুর।

তাই তারা পাকিস্তানের ওপর নাখোশ। সে নাখোশ দেশগুলোকে চটানোর সাহস পাকিস্তানের নেই। তাই তাদের নেতা ইমরান খান ধৃত উইং কমান্ডার অভিনন্দনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এই বৈমানিকের ধরা পড়ায় আর যাই থাক ভারতের বীরত্বের প্রমাণ নেই। তারা মুখে যতই বলুক যুদ্ধ হলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না।

পাকিস্তানিদের দৃঢ় বিশ্বাস তারা ভারতকে ঘায়েল করতে পারবেই। তবে এবার যুদ্ধ হলে ফল কী হতো তা সহজেই অনুমেয়। চির বন্ধু ইরান এখন পাকিদের সঙ্গে নেই। শিয়া-সুন্নির লড়াই এই দেশকে পাকিস্তানবিরোধী করে ফেলেছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আগের মতো নেই। তাদের নিজেরা আছে অস্তিত্ব সংকটে। ফলে একঘরে পাকিস্তান।

ভারতের দুর্বলতা তাদের মনোবলের অভাব। আর আগ্রাসী বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে প্রতিবেশীদের সঙ্গে অবন্ধুসুলভ সম্পর্ক। এদিকে এসব যুদ্ধের যতটুকু হয় যা যেটুকু হয় তার ফলে ভোগে কিন্তু সাধারণ মানুষ। পাকিস্তান যখন বোমা ফেলবে, বোমা কী জানে সে কোথায় গিয়ে পড়বে?

তা কী হিন্দুর ঘরে না মুসলমানের ঘরে পড়বে? অন্যদিকে ভারত যখন মারবে তখন কী তার দিলে পাকি হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের জন্য মায়া থাকবে? কোনোদিনও থাকবে না। এমন বাস্তবতায় যুদ্ধের দায় নেবে কে? কে নেবে মানুষের জানের দায়?

ভারতের মনে রাখা উচিত তাদের আর্থিক সাফল্য রাখতে হলে শান্তির বিকল্প নেই। শান্তির জন্য বড় দেশের যে সহিষ্ণুতা সেটা কেন তারা রাখতে পারছে না, সেটা আমরা বুঝলেও বলব তাদের আরো একটু সহিষ্ণু হওয়া দরকার। একটি পতনমুখী দেশ আরেকটি উন্নতির আকাশে যাওয়া দেশের মানুষের ভাগ্য এক হতে পারে না।

কে না জানে সারা বিশ্বে গান্ধী এখনো শান্তির প্রতীক। তার দেশ এতবার যদি একটা দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় আর সমস্যার সঠিক সমাধান না করতে পারে সে ব্যর্থতা তাকেই নিতে হবে। উপমহাদেশে আমরাও এখন আর ছোট ভাই নয়।

আমাদের সম্মান ও মর্যাদা বোধ বাড়ছে। শেখ হাসিনা তার কূটনৈতিক সাফল্যে এখনো মিয়ানমারকে আটকে রেখেছে তার বৃত্তে। মাঝে মাঝে অপচেষ্টা চালালেও তারা কোনো চক্রান্তই সার্থক করতে পারেনি। শেখ হাসিনা ভারতকেও মোটামুটি বাগেই রেখেছেন। কাজেই কূটনৈতিকভাবে আমরা কারো হয়ে কথা বলতে পারি না।

তবে ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে তার দুশমনী কখনো ভোলেনি। বরং তা জিয়ে রাখতেই তার আনন্দ। একাত্তরে তার পরাজয় সে মানতে পারেনি। সে অপমানে দগ্ধ পাকিস্তান সুযোগ পেলেই তার আসল চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তারপরও আমরা মনে রাখব মানুষের কথা।

সাধারণ মানুষের ভাগ্য বা তাদের জীবন ভালো ও নিরাপদ রাখাই হলো দেশের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব ইতিহাস কেন জানি উপমহাদেশে কাউকেই পালন করতে দেয়নি। জানি না এই বৈরিতা আর কতকাল চলবে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ- এসব প্রাণঘাতী যুদ্ধের পর ইউরোপে, আমেরিকায় মানুষ আর যুদ্ধ দেখেনি। যদিও আইরিশ আর ইংরেজদের লড়াই চলে এখনো। কিন্তু এমন রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ উন্মাদনা শেষ হয়ে গেছে। শুধু উপমহাদেশেই কিছু হলো না। কত সরকার এল-গেল ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতা শেষ হলো না।

শেষ যে সহজে হবে না তার প্রমাণ আছে এবারের যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশে। যুদ্ধ কি বলে-কয়ে করতে হয়? যুদ্ধ তো আসলে চলছেই। এই লড়াই না থামালে বা এর একটা বিহীত না হলে আরো কত বছর যে তা চলবে কে জানে? কথায় বলে রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।

মানুষই আজ সেই উলুখাগড়া। তাদের পায়ের তলায় পিষ্ট করতে কামান, ট্যাংক, বিমান- সব তৈরি। আর নিজের টাকায় পোষা সেনাদের এমন প্রাণঘাতী আচরণকে উসকে দেয় রাজনীতি। সে রাজনীতি শুদ্ধ না হলে পাক-ভারতের কোথাও শান্তি আসবে না সহজে। দেখা যাক সময় কী বলে।

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App