×

মুক্তচিন্তা

ইছামতি নদী, তুমি কি আরো কাঁদবে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০১৯, ০৮:৫০ পিএম

অবৈধ দখলে গিয়ে এক সময়ের নদীর অস্তিত্ব শুধু মানচিত্রেই খুঁজে পাওয়া যায়। বাস্তবে খাল-নদী ভরাট করে একশ্রেণির অবৈধ দখলদার তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি তৈরি করে দখল করে নিয়েছে। এখনো যে ক’টি নদী পুরোপুরি দখলদারদের হাতে পৌঁছে যায়নি তার মধ্যে এই ইছামতি নদী আছে। কিন্তু সময়মতো এই ইছামতি নদীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে এই নদীও একদিন ‘কোনো এককালে এখানে এক নদী ছিল’ এমন রূপকথার গল্পেরই সুযোগ করে দিবে।

ঢাকা শহর থেকে মাত্র ২০-২২ মাইল দূরে অবস্থিত নবাবগঞ্জ থানা। পুরোটা জুড়েই আছে ইছামতি নদী। বর্তমানে দোহারের সঙ্গে মিলে ঢাকা-১ নির্বাচনী আসনের অন্তর্গত। দুরন্ত ইছামতি নদীর এক প্রান্তে পদ্মা নদী। এই ইছামতি নদী ঢাকা জেলার দোহার, নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর এবং মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান ও শ্রীনগর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত। পাঁচটি উপজেলার প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের নদী এই ইছামতি। শিকারীপাড়া এবং জয়কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের পশ্চিমের শেষ প্রান্ত থেকে নবাবগঞ্জ থানার পূর্বের শেষ অংশ জুড়েই ইছামতি নদীর চলাচল।

এক সময় এই নদীর গতি, স্রোত, গভীরতা এবং প্রশস্ততা এ অঞ্চলের মানুষের কাছে বেশ গল্পের উদ্রেক করত। বর্ষায় এ নদীর প্রমত্ত লীলাখেলায় ছোট ছোট নৌকা অসহায়ত্বে ভুগত। এই নদীতে সারাটা বছর জুড়েই নৌকা-লঞ্চ চলত। পদ্মার ভাঙন যখন ফরিদপুরের এপাড়ে দোহার-নবাবগঞ্জকে আক্রান্ত করা শুরু করল, তখন ইছামতি নদীর চেহারাও পাল্টে যেতে শুরু করল। ক্রমশ অশান্ত রূপ ধারণ করল ইছামতি নদী। দুপাড় ভেঙে এক সময় এ পরিধি বৃদ্ধি পেতে শুরু করল।

দুপাড়ের ভাঙন এমনই এক ভয়াবহ আকার ধারণ করল যে দুপাড়ের অসহায় মানুষগুলো তাদের ভিটা-বাড়ি রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হতে শুরু করল। পদ্মার সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের আশায় তারা বেড়িবাঁধ দেয়ার বিষয়ে তৎপর হতে শুরু করল। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী। রাজ্জাক পদ্মার ভাঙন সরেজমিন অবলোকন করে পদ্মা এবং ইছামতির সঙ্গমস্থলে একটি বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

এক সময় অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে নবাবগঞ্জ উপজেলার কাশিয়াখালীতে বাঁধ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নবাবগঞ্জের ইছামতি নদীর দুপাশের হাজার হাজার ভিটেবাড়ি নদী ভাঙনের কবল থেকে উদ্ধার লাভ করে। ইছামতির ওপর বাঁধ দেয়ার গল্পটি এমনই।

সবার সুবিধার জন্য জানাচ্ছি, আমি যে ইছামতি নদীটির কথা বলছি তা ঢাকা জেলায় অবস্থিত। ইছামতির উৎপত্তি অনেককাল আগেই হয়েছে। কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুরে প্রবাহিত আরো দুটি নদীর নামও ইছামতি। অনেকের মতে, অনেক আগে এই তিনটি ইছামতি নদীর চ্যানেল ছিল এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ একটি নদী থেকেই তিন ভাগ হয়েছে ইছামতি কালক্রমে।

এক সময় প্রয়োজনে ইছামতিতে বাঁধ দিতে হয়েছিল। নদীর দুপাড়ের হাজার হাজার বসতভিটা রক্ষার তাগিদে তখন বাঁধের কোনো বিকল্প ছিল না। সেই বাঁধের আশায় তখন বুক বেঁধে অপেক্ষায় ছিল নদীর পাড়ের লাখ লাখ মানুষ। বাঁধ হওয়ার পর রক্ষা হয়েছে হাজার হাজার বাড়িঘর। কিন্তু বাঁধ দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ যে ভুলটি করেছিল তা হলো, তখন তারা শুধু পানির গতিই বন্ধ করার চিন্তা করেছিল। কিন্তু সেই গতি বন্ধ হলে এক সময় আবার যে অন্য একটি বড় সমস্যা হতে পারে সেই সুদূরপ্রসারী চিন্তা তখন বাঁধ কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। এই বাঁধে কোন স্লুইস গেট করা হয়নি।

দীর্ঘদিন পানি প্রবাহ বন্ধ থাকতে থাকতে এক সময় নদীর পানি কমতে শুরু করে। বর্তমানে নদীর মধ্যে পানি শূন্যতার অবস্থা বিরাজ করছে। এক সময় এই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিল ইছামতি নদী। দূরপাল্লার নৌকা, মোটরচালিত নৌকা, একপালার ছোট নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা ইত্যাদি নানারকম নৌকার কলতানে এবং লঞ্চের ভোঁ ভোঁ আওয়াজে মুখরিত ছিল ইছামতি নদী। কিন্তু এখন সেই ইছামতিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সবার পরিচিত খরস্রোতা সেই ইছামতি নদী।

ইতোমধ্যে নদীর পানি কমে কমে তলায় ঠেকেছে। দুপাশে জেগে উঠেছে নতুন ভূমি। আর সেই ভূমিকে দখল করেছে দুপাড়ের কিছু কিছু মানুষ। নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে দোকান, বাজার, ক্লিনিক আর অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রমরমা পাকা-কাঁচা ঘর। বাঁধ নির্মাণের সময় স্লুইস গেট করার বিষয় বিবেচনায় না এনে স্থায়ীভাবে পদ্মার পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার ফলে আজ শুকিয়ে যাওয়া ইছামতি তার সাধারণ নাব্য হারিয়েছে।

এতে সুযোগ করে দিয়েছে অসাধু কিছু লোকের নদীর জায়গা দখলের। ধীরে ধীরে দখল হয়ে যাচ্ছে নদীর দুপাড়। যদি এমনিভাবেই চলতে থাকে, তাহলে সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন এ অঞ্চলের মানুষ গল্প করবে- এখানে এককালে ইছামতি নামে একটি নদী ছিল।

বাঁধ নির্মাণের মতো মহৎ কাজে জড়িত ছিলেন যেসব স্থানীয় ব্যক্তি এবং ওই সময়ের সরকারের প্রতিনিধিরা, তাদের একদিকে দিতে হয় হাজারো ধন্যবাদ; কেননা তারাই তখন ইছামতির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল হাজার হাজার ঘরবাড়ি। পাশাপাশি তাদের ছোট্ট একটি ভুল অথবা অল্প অর্থ বাঁচানোর স্বার্থে গৃহীত স্লুইস গেট না করার পদক্ষেপ আজ ইছামতির অস্তিত্বকে নতুন করে হুমকির মধ্যে ফেলেছে।

শিকারীপাড়া এবং জয়কৃষ্ণপুরের শেষ মাথায় অবস্থিত কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধে স্লুইস গেট না দিতে পারলে সামনে ইছামতি নদীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এটা এতই জরুরি হয়ে পড়েছে যে, ওই অঞ্চলের প্রতিটি ভালো মানুষের মনের কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইছামতি নদীর দুপাড় দখল করা কিছু ভূমি দখলকারীদের বাদ দিলে পুরো এলাকাবাসী আজ বেদনায় কাঁদছে। তাদের সাধের ইছামতি নদী আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। নদীতে মাছ নেই, নৌকা নেই, লঞ্চ নেই। নদীর দুপাড়ে আছে শুধু অবৈধ দখলের চি?হ্ন। নদীতে হাট-বাজার ও ক্লিনিক-কারখানার বর্জ্য বস্তু এবং নানা আবর্জনা পড়ে গিয়ে উত্তরোত্তর নদী ভরাট হওয়ার কাজটিই সুগম হচ্ছে।

ঐতিহাসিক ইছামতি নদীর ইতিহাস আছে, শত গল্প আছে এই নদীকে ঘিরে। এই নদীতে হতো বড় বড় নৌকাবাইচ। সেই নৌকাবাইচ দেখতে আসত দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ। আজ সেগুলো শুধুই ইতিহাস।

ইতোমধ্যে ইছামতি নদীকে বাঁচানোর তাগিদে ‘ইছামতি নদী বাঁচাও আন্দোলন’-এর ব্যানারে দোহার এবং নবাবগঞ্জের একদল সমাজসেবী মানুষ এক পতাকাতলে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করছে। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং নবাবগঞ্জের এলাকাবাসী এই ইছামতি নদী বাঁচানোর সংগ্রামে আজ রাস্তায় নেমেছে। তারা নদী বাঁচানোর জন্য র‌্যালি করছে, সভা-সিম্পোজিয়াম করছে, পথসভা করছে, স্কুলে স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছে। ইছামতি নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে তারা দুপাশের মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছে।

সরকার বিশেষ করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ইছামতি নদীকে বাঁচানোর তাগিদে একটুখানি এগিয়ে এলেই এই নদীটি রক্ষা পেতে পারে। এই অনুভূতি প্রদানের কাজটি ‘ইছামতি নদী বাঁচাও আন্দোলন’ কর্তৃপক্ষ সফলভাবে করতে পেরেছে। মন্ত্রী, সচিব, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজিসহ প্রশাসনের সর্বত্র তারা ধরনা দিয়েছে এবং সভা করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ডিপিপি তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমাও দিয়েছিল ২০১৭ সালে। সংশোধনের সুপারিশ দিয়ে মন্ত্রণালয় সেই যে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে তা ফেরত দিল, বিষয়টি যেন সেখানেই থেমে গেল। এরপর এর অগ্রগতিও থেমে গেল।

পুরোপুরিভাবে অবৈধ দখলে যাওয়ার আগেই ইছামতি নদীকে বাঁচানোর মহান কাজটি সম্পন্ন করতে পারে একমাত্র সরকার। বিশাল অঙ্কের টাকা নয়, শুধু প্রয়োজন একটি উদ্যোগের। এগিয়ে আসুন সময় থাকতেই। বাংলাদেশের অনেক নদীই আজ বিলীন হয়ে গেছে; অবৈধ দখলে গিয়ে এক সময়ের নদীর অস্তিত্ব শুধু মানচিত্রেই খুঁজে পাওয়া যায়।

বাস্তবে খাল-নদী ভরাট করে একশ্রেণির অবৈধ দখলদার তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি তৈরি করে দখল করে নিয়েছে। এখনো যে ক’টি নদী পুরোপুরি দখলদারদের হাতে পৌঁছে যায়নি তার মধ্যে এই ইছামতি নদী আছে। কিন্তু সময়মতো এই ইছামতি নদীকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে এই নদীও একদিন ‘কোনো এককালে এখানে এক নদী ছিল’ এমন রূপকথার গল্পেরই সুযোগ করে দিবে।

শুধু প্রয়োজন কাশিয়াখালী বেড়িবাঁধে একটি মাত্র স্লুইস গেট। আর তাতেই আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে ইছামতি নদী। আবার বইবে অথৈ পানি, আবার স্রোতে নৌকা-লঞ্চ চলবে আবার নৌকাবাইচ হবে। তাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকার, পরিবেশবাদী মানুষ, সমাজ সচেতন জনগণ সবারই দৃষ্টি পড়ুক এই ঐতিহাসিক ইছামতি নদীর দিকে এই কামনা করছি। সব তো হয়েই আছে।

সংশোধিত ডিপিপিটি এখন শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয়ে আসা। তারপর একনেকে পাস হওয়া। আমরা এও জানি, একনেকে একবার পৌঁছে গেলে তা পাস করার ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। কেননা প্রধানমন্ত্রী নদী বাঁচাতে আমাদের চেয়েও বেশি তৎপর। মেজর (অব.) সুধীর সাহা: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App