×

বিশেষ সংখ্যা

স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:১৩ পিএম

মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর বিশাল অবদান রয়েছে। মুজিব বাহিনীর ৮৮ জন শীর্ষ নেতার একজন হিসেবে আবদুল মান্নান চৌধুরী দেরাদুনে মিলিটারি একাডেমিতে পুনঃপ্রশিক্ষণ নেন। তবে তিনি পূর্বাঞ্চল মুজিব বাহিনীতে শেখ মনির সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। শেখ মনি নভেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখলে যাত্রা শুরুর আগে তাকে পূর্বাঞ্চল কমান্ডের সার্বিক দায়িত্ব দেন। যুদ্ধ শেষাবদি তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শেখ মনির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী যৌথ বাহিনীর কোনো ভূমিকা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করেন। মুজিব বাহিনীর বিশালাংশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলমান শিক্ষার্থী ও সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহের সংসদ কর্মকর্তা। ক্যাম্পগুলো পরিচালনা, চিকিৎসা ও সেবা প্রদানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা জড়িত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গেও তারা জড়িত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাকে প্রায়ই ‘রাজকীয় ক্ষতিপূরণ’ বলে ধারণা করা হয়। ১৯০৫ সালে বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্ববঙ্গ প্রদেশ গঠিত হয় এবং ১৯১১ সালে তথাকথিত হিন্দু ভদ্রলোকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই বঙ্গভঙ্গ রোধ করা হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের বিক্ষুব্ধতাকে প্রশমনের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে পরিত্যক্ত কতিপয় সুরম্য প্রাসাদ ও রমনার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কার্জন হল ও উপাচার্য ভবনের ন্যায় দুয়েকটি বাংলো আজো সে স্মৃতি বহন করে।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে মুসলিম জাগরণে একটি মাইলস্টোন বলে চিহ্নিত করা যায়। এ সময় সাম্প্রদায়িক বিভাজন তীব্র হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন কিছু গ্রাজুয়েট জন্ম নেয় যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুসলমানদের একক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের জন্ম ও বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান আন্দোলনের এক প্রধান নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু রাজনৈতিক নেতা ও যুব নেতারা ঢাকায় বসবাস গড়েন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বরণ করেন। কেউ কেউ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করলেও ঢাকায় এসে তার সমাপ্তি টানার প্রয়াস নেন। বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন, যদিও ঘটনা পরম্পরায় তিনি ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি। অধ্যয়নকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বহিষ্কৃত হন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানে কিংবা পাকিস্তান পূর্ব বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারীদের বেশ অনেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। আবারো শেখ মুজিব প্রসঙ্গে আসতে হয়। তার সংগঠন ছাত্রলীগ ও তাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বস্তুত ভাষা আন্দোলনকে বাঙালির সুপ্তি ভঙ্গের আন্দোলন বা বাঙালি জাতিসত্তার রেনেসা বা পুনর্জাগরণ বলে অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের মহানায়কদের সঙ্গে যেমন শেখ মুজিবের নাম জড়িয়ে আছে তেমনি আছে আবুল কাশেম, নুরুল হক ভূঁইয়া, অলি আহাদ, কামরুদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান খান, সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম। তারা ছিলেন এই ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতিদাতাদের কেউ কেউ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ভাষা আন্দোলনের পর যে আলেখ্য বিশিষ্টতা অর্জন করে আছে তার নাম হলো যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের পূর্বাংশের প্রাদেশিক নির্বাচনে তার বিজয়। এই যুক্তফ্রন্টের তিন নেতার একজন ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। এই যুক্তফ্রন্ট ভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সম্পৃক্ত ছিল। সম্পৃক্ত ছিল কৃষক শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল শামসুল হক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

১৯৫৪ সালে যে ছাত্রটি নূরুল আমিনকে নির্বাচনী ভোটে পরাজিত করেছিলেন সেই খালেক নেওয়াজও ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। এই সময়ে স্বায়ত্তশাসন চেতনা তীব্রতর হতে থাকে, যখন যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ভানুমতির খেলা শুরু হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ৬ দফা আন্দোলনের কথা অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের মহান প্রণেতা ও প্রবক্তা ছিলেন শেখ মুজিব। তার সুযোগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী।

ইতোপূর্বে দুই অর্থনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তি রচয়িতারা বিশেষত আতোয়ার হোসেন, আনিসুর রহমান, নূরুল ইসলাম, ওয়াহিদুল হক ও রেহমান সোবহান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিকদের প্রায় সবাই ছিলেন এই বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুববিরোধী ও মার্শাল ল’ বিরোধী এসব আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল। ছাত্র শক্তি নামে একটি ছাত্র সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। এসব সংগঠনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া তারা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের শিক্ষার্থী।

১৯৬২ সালের দিকে শেখ মুজিব আগরতলা গিয়েছিলেন এবং সে সময় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় সম্মতি লাভ করেন। তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি কতিপয় গোপন সংগঠন যথা স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদ; বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) গঠনে ব্রতী হন। ১৯৫৯ সালে সংগোপনে ছাত্রলীগকে পুনর্জীবিত করার পরই বঙ্গবন্ধু উপর্যুক্ত দুটি সংগঠনের জন্ম দেন। এসবের নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

১৯৬৪ সালের আইয়ুব ও মোনেমবিরোধী আন্দোলনের সৈনিকরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসে অপর একটি অনন্য ঘটনা হচ্ছে ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল। ৬ দফার সপক্ষে ও শেখ মুজিবের মুক্তির লক্ষ্যে সেদিন সারা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

সেদিনের নেতৃত্বে শিরোভাগে ছিলেন শেখ ফজলুল হক, সিরাজুল আলম খান, আল-আমিন চৌধুরী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল মান্নান চৌধুরী, মনিরুল হক চৌধুরী, শেখ শহিদুল ইসলাম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। এদের সবাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনের সব নেতাই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। তোফায়েল আহমেদের মতো কিংবদন্তি নেতা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, শামসুদ্দোহা, মাহবুবুল হক দোলন, ফখরুল ইসলাম, নাজিম কামরান চৌধুরী বা দীপা দত্ত ছিলেন এই বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রী।

১৯৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পুরোধা ব্যক্তিদের সব ক’জন ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবকে তারাই বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। ৬ দফা ও ১১ দফার নেপথ্যের মন্ত্রণাদাতা যথা- আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি ও মতিয়া চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী সন্তান। ৬ দফা আন্দোলনের পূর্বে অতি সংগোপনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগকে পুনর্জীবিত করা হয়। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে কয়েকটি বাহিনী যথা জহুর বাহিনী, জয় বাংলা বাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

এগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। ৬ দফা আন্দোলনে সহায়ক শক্তি হিসেবে শিল্প ও সাহিত্য সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। প্রতিষ্ঠাকালে এর প্রধান ছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী। অমর একুশের সঙ্গীত রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, খালেদ হাশিম, আবদুল মান্নান চৌধুরীও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আইয়ুব মোনায়েমের জাঁতাকলে নিষ্পেশিত ছাত্রলীগের সম্পূরক হিসেবে এর অবদান অনস্বীকার্য। সংস্কৃতি সংসদও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছিল এবং তার নেতারা রাজনীতির সম্পূরক সংস্কৃতি চেতনায় অগ্রগামী ছিলেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুলসংখক ছাত্রনেতা নির্বাচনে অংশ নেন। তাদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সত্তর সালের নির্বাচনের পরই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে সেই ১৯৫৪ সালের মতোই তাকে ও তার দলকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না। তাই তিনি সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্মতি নিয়ে রাখেন।

ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ প্রদানসহ বিভিন্ন ধরনের সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয়। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের মাধ্যমে আত্ম অবমাননাকর বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রস্তাবও দেয়া হয়। এসব প্রস্তাবে সাড়া না দিতে গৃহাভ্যন্তর থেকে শেখ ফজলুল হক মনি ও শেখ হাসিনা, ড. আবদুল ওয়াজেদ মিয়া ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলে বঙ্গবন্ধুর মনোবল তুঙ্গে ওঠে। তবে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেন। তাই ১৯৭১ সালের প্রথম পর্বে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ৬ দফার সপক্ষে অনড় থাকার শপথবাক্য পাঠ করান। তারপর কি হতে যাচ্ছে তা তিনি জানতেন। তিনি ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন স্থগিতের অগ্রিম খবরও জানতেন। ১ মার্চের জঙ্গি কার্যক্রম ২৮ ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত হন।

মূলত সেদিন থেকেই চার যুব নেতা তথা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ ও চার ছাত্রনেতা তথা আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজের ওপর তিনি সশস্ত্র যুদ্ধের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বাংলাদেশের পতাকা জনসম্মুখে প্রদর্শিত হয়। ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার প্রস্তাব, জাতীয় সঙ্গীত ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পালিত হয়। তবে ৩ মার্চ বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীনতার সপক্ষে সক্রিয় ভূমিকায় নামেন।

ওইদিন বেলা ১১টায় শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ১ দফা অর্থাৎ স্বাধীনতার সপক্ষে বটতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হন। বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক আবদুল মান্নান চৌধুরীর প্রস্তাবনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের আগেই ৬ দফার বদলে এক দফার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিত একান্ত সভা ও বৈকালিক টেলিফোন যোগাযোগের পর বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হন যে সশস্ত্র লড়াই ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। তিনি এই সিদ্ধান্ত শেখ মনি ও আবদুল মান্নান চৌধুরীকে জানিয়ে দেয়ার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের গণ্ডি ছাড়িয়ে স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

১ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা অস্ত্র লুট ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণে ব্রতী হন। শিক্ষকরা এক ধরনের থিংক ট্যাংক গড়ে তুলেন এবং বঙ্গবন্ধু ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার জন্য আবদুল মান্নান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেন। ৩ মার্চের পর ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারীদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ৭ মার্চের ভাষণ তৈরিতে সহায়তার প্রস্তাব দিলেও সে ভাষণ সম্পূর্ণ ছিল বঙ্গবন্ধুর একক ও নিজস্ব। সে ভাষণের ব্যাপারে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শেখ হাসিনার প্রভাব বলতে গেলে অনেক বেশি। মার্চের প্রথম সপ্তাহে গণহত্যা আঁচ করতে পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশ পূর্বাহ্নে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে সতর্ক বার্তা প্রেরণ এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে সংযোগ স্থাপন করেন।

২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউন পরবর্তী হত্যাযজ্ঞে সেনাবাহিনীর হাতে আত্মাহুতি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ শিক্ষক; ১০১ শিক্ষার্থী, একজন কর্মকর্তা ও ২৮ কর্মচারী। ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযথা শিক্ষক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জোর্তিময় গুহ, সরাফত আলীসহ অনেকে নিহত হন। সেনাবাহিনী নিরীহ সরাফত আলীকে একটিভিস্ট আবদুল মান্নান চৌধুরী মনে করে হত্যা করে, তথ্য বিভ্রান্তির কারণে এমনটা ঘটে। মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধের সঙ্গে পেশাধার সৈনিক ও সশস্ত্র বাহিনীর সীমিত সংযুক্তি ছিল, ব্যাপক সংযুক্তি ছিল ছাত্রদের। এপ্রিলের পর যুদ্ধটাকে চাঙ্গা রাখতে গণমাধ্যমের আশ্রয় নেয়া হয়।

পূর্বাঞ্চল থেকে ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকা ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে যাদের প্রিন্টার লাইনে সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসান চৌধুরী ও রহমতউল্লাহর নাম প্রদর্শিত হয়। এ দুটো ছিল ছদ্মনাম। প্রথমোক্ত জন হলেন আবদুল মান্নান চৌধুরী ও শেষোক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র গুল হায়দার। পরবর্তী সময় জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবদুল মান্নানও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

এমনকি বাংলার বাণী সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক যথাক্রমে শেখ ফজলুল হক মনি ও আমির হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অন্যান্য গণমাধ্যমের প্রায় সব সম্পাদক ও সেবক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা। গণহত্যা শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশে বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি অবশ্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন।

২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর ব্যাপক মানুষজন সীমান্ত অতিক্রম করতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৬৮ লাখ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেলেও এক কোটির বাকিরা পূর্ব বাংলা থেকে পূর্বে হিজরতকারী এককালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে আশ্রয় নেন।

শেষোক্তরা বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি গঠন করে আশ্রয়ন ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ সম্প্রসারণের কাজে নিবেদিত শরণার্থী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কর্মীদের সার্বিক সহায়তা দেন। মুক্তির গানের সঙ্গে কর্নেল নুরুজ্জামানের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুলতানা জামান জড়িত ছিলেন।

ক্র্যাক ডাউনের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে আবদুল মান্নান চৌধুরী, অজয় রায়, মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, আবু জাফর, শহীদউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে সীমান্ত অতিক্রম করেন। তাদের কাউকে কাউকে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা হয়। আবদুল মান্নান চৌধুরী সশস্ত্র সংগ্রামের সঙ্গেই যুক্ত হয়ে যান। এপ্রিলের শেষভাগে শেখ মনির নেতৃত্বে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর পুনর্জাগরণের সময় থেকে তিনি মুজিব বাহিনীতে জড়িত ছিলেন। তাকে ভারতে শিক্ষকতার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর বিশাল অবদান রয়েছে। মুজিব বাহিনীর ৮৮ জন শীর্ষ নেতার একজন হিসেবে আবদুল মান্নান চৌধুরী দেরাদুনে মিলিটারি একাডেমিতে পুনঃপ্রশিক্ষণ নেন। তবে তিনি পূর্বাঞ্চল মুজিব বাহিনীতে শেখ মনির সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। শেখ মনি নভেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখলে যাত্রা শুরুর আগে তাকে পূর্বাঞ্চল কমান্ডের সার্বিক দায়িত্ব দেন। যুদ্ধ শেষাবদি তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। শেখ মনির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনী যৌথ বাহিনীর কোনো ভূমিকা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করেন। মুজিব বাহিনীর বিশালাংশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলমান শিক্ষার্থী ও সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজসমূহের সংসদ কর্মকর্তা। ক্যাম্পগুলো পরিচালনা, চিকিৎসা ও সেবা প্রদানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা জড়িত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গেও তারা জড়িত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের অনেকেই ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থী।

১১ সেক্টরের নেতৃত্বে বেশ ক’জন ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। ঢাকার বুকে ক্র্যাক ফ্লাটুন যে কর্মকা- পরিচালনা করেছে বা দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেছে তার অধিকাংশ সদস্যই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ক্র্যাক ফ্ল্যাটুনের মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী বা সাদেক হোসেন খোকার নাম সর্বজনবিদিত। বর্ণনা দীর্ঘায়িত হয়ে যাচ্ছে তাই সম্প্রসারিত না করে সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করা যায় তা হলো ‘বাংলাদেশের ইতিহাস মানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস।

তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-গরিমায় যেমন অনন্য তেমনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ও বিকাশে তার ভূমিকা ঈর্ষণীয় তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের তার ভূমিকা হচ্ছে সার্বিক। যে দেশের জাতির পিতা ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র, তাদের গর্বের ভা-ারটি সুবিস্তৃত। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ভা-ারটি আরো সমৃদ্ধিশালী করা’।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App