×

বিশেষ সংখ্যা

স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:১৮ পিএম

স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

সত্য গোপন থাকে না। জিয়াউর রহমান সেখানে এসেছিলেন, কেনইবা তাকে ডেকে নিয়ে আসা হলো? এসব প্রশ্নের মীমাংসা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর গত ৪০ বছর মিথ্যার বেসাতি দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান সেদিন কালুরঘাট এসছিলেন মূলত ২টি কারণে প্রথমত, কালুর ঘাট বেতারের শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদ, রেডিও স্টেশনের নিরাপত্তা এবং সামরিক বাহিনীর কোনো বাঙালি অফিসারকে দিয়ে স্বাধীনতার তৃতীয় ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজন বোধ করেছিলন। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতাকামী ও দেশপ্রেমিক একজন সৈনিক হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে। ২৭ মার্চের পর ২৮ ও ২৯ মার্চ স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র যথারীতি চলেছে। ৩০ মার্চ ছিল কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি কালো দিন। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত বিমান হামলার মধ্য দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। দুপুরের অধিবেশনের পর দুপুর ২টা ১০ মিনিটে শুরু হয় বোমা বর্ষণ।

স্বাধীনতা মানুষের আজন্ম পিপাসা। আর এ পিপাসা থেকেই জন্ম নেয় সংগ্রামী চেতনার। এ সংগ্রামী চেতনাবোধই মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে সুগম করে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হওয়ার পর বাঙালি জাতির ওপর নেমে আসে আরেকটি নব্য উপনিবেশবাদ।

দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের শেষ প্রহর এই অগ্নিঝরা মার্চ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার ঐতিহাসিক সমাবেশে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণার পর শুরু হয় পাকিস্তাানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এক অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধ। এরপর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ।

কিন্তু কিভাবে প্রচারিত হয়েছিল সে ঘোষণা? কখন প্রচারিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী? কী ভূমিকা ছিল স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের! কিন্তু কারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে যেসব বেতারকর্মী তথা শব্দসৈনিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা আজ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পরও স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে মিথ্যার ঝড়ো হাওয়ায় সব কিছু লণ্ড-ভণ্ড। মিথ্যার চোরাবালিতে একজন সেক্টর কমান্ডারকে বানানো হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষক এমনকি মহানায়ক! যদিও একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় এমন কি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও কখনো এ রকম হাস্যকর স্বীকৃতি দাবি করেননি। আজকের অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি বেঁচে থাকলে লজ্জায় মাথা হেট করতেন! আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতারের কিংবদন্তিতুল্য অবদান আজ নতুন প্রজন্মের কাছে ধূসর হতে চলেছে।

২৫ মার্চ কালরাতে রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় বর্বরোচিত গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। ২৫ মার্চ রাতে রেডিও এবং টেলিভিশন কেন্দ্র দখল করে নেয়ার পর ২৬ মার্চ সকাল থেকেই রেডিও টিভিতে প্রচারিত হতে থাকে সামরিক নীতিমালা। হামলা চালিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বিদ্যুৎ টেলিফোন, বিমান চলাচলসহ সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।

২৫ মার্চের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের ১৫ ঘণ্টার মাথায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে একজন বিদ্রোহীর কণ্ঠে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানানোর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। এটি ছিল চট্টগ্রামের জনপ্রিয় নেতা আবদুল হান্নানের কণ্ঠ। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মোটামুটি সংগঠিত আকারে চট্টগ্রাম কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে যাত্রা শুরু করে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায়। ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ইপিআরের অয়্যারলেসে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাঠানো হয়েছিল।

যা হোক ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান অনির্ধারিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী পাঠের পর চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের বেতার ভবনের কর্মীরা দারুণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত ও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা নাসিরের পরামর্শে এবং শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদের প্রচেষ্টায় আগ্রাবাদ বেতার ভবন থেকে কালুরঘাটের ক্ষুদে স্টুডিওতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ আগ্রাবাদ বেতার ভবনটি চট্টগ্রাম বন্দরের খুব কাছে। পাকিস্তানিরা যে কোনো সময় বেতার কেন্দ্রটি দখল করে নিতে পারত।

২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ও দুর্লভ মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসে। ৭.৪০ মিনিটে প্রথম প্রচারিত হলো অধ্যক্ষ আবুল কাসেম সন্দ্বীপের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। এরপর অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক, সুলতানুল আলমের কণ্ঠেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটি বারবার প্রচার করা হয়। এর ২০/২৫ মিনিট পরে কালুরঘাট স্টুডিওতে এসে হাজির হন ডা. আবু জাফর এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। হান্নান সাহেব স্টুডিওতে উপস্থিত হয়ে বেতারকর্মীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন বলে জানান। কোথায় থেকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তা বলা যাবে না এমন আপত্তিও হান্নান সাহেব মেনে নিয়েছিলেন। বেতারকর্মীদের যুক্তি ছিল স্থানের নাম ঘোষণা করা হলে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান জেনে ফেলবে এবং হামলা করবে।

এ ছাড়া এটা ছিল গোপন বেতার কেন্দ্রও বটে। যুক্তি মেনে নিয়ে হান্নান সাহেব দ্বিতীয়বার নিজকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য তথ্য-উপাত্তে হান্নান সাহেবের দ্বিতীয়বার স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীতে কউ লেখা ছিল সে তথ্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায়- বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক তারবার্তার কথামালার লিখিত বিবরণ ‘জরুরি ঘোষণা’- ‘গত রাত ১২ টায় বর্বর পাক বাহিনী ঢাকার পিলখানা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে, এতে লাখ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছে। যুদ্ধ চলছে, আমি এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশগুলোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি- জয় বাংলা’।

২৬ মার্চ শুভ সন্ধ্যার সূচনা অধিবেশনের সময় ছিল মাত্র ৩০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বাণী পাঠের পর ‘আগামীকাল ৭টায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে’ এমন ঘোষণা দিয়ে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। আজকের তরুণ প্রজন্ম তথা স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতকারী ভণ্ড ও মিথ্যাবাদীদের জন্য যে তথ্য জানা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান কর্তৃক দুবার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর কেন কিভাবে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়ার আগমন ঘটে সে তথ্য জানা।

তথ্যবহুল ও ঐতিহাসিক গ্রন্থে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের লেখক বেলাল মোহাম্মদ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালুর জন্য আমি, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক চট্টগ্রামের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর দপ্তরে যাই। কিন্তু নেতাদের কাউকে না পেয়ে চলে যাই রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের পাহাড়ে। সেখানে ছিলেন ইপিআর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। প্রস্তাব দেয়া হলো বেতার কেন্দ্র পাহারার ব্যবস্থা করার। তিনি কথা দিলেন এক ঘণ্টার মধ্যে ২০ জন জওয়ান পাঠাবেন। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে বিকাল এসেছে, রাত হয়েছে, অনুষ্ঠান শেষ হয়ে স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু রফিক তার কথা রাখেননি! কোনো জওয়ানকেও কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পাঠাননি!

এ পরিস্থিতিতে আমি আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক প্রচার ভবনে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি এবং বিশেষ সূত্রে জানতে পারলাম একজন বাঙালি মেজর দেড়শ সৈন্য নিয়ে পটিয়ায় অবস্থান করছেন। খবর পেয়ে বন্ধু মাহমুদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ ১৫/১৬ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সাক্ষাতে মেজর জিয়াকে বেতার ভবনের নিরাপত্তা দিতে অনুরোধ জানাই। মেজর জিয়া সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার অনুগত সৈন্যদের কালুরঘাটে পাঠান এবং তিনি নিজেও আমাদের সঙ্গে বেতার কেন্দ্রে চলে আসেন। আমরা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পৌঁছি ২৭ মার্চ বিকেলে ৫টায়। সন্ধ্যায় মেজর জিয়ার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে রেডিওতে জিয়াকে কিছু বলতে অনুরোধ করি এবং এক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ এগিয়ে দিই। মেজর জিয়া প্রথমে লেখেন, ‘আই এম মেজর জিয়া ডু হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার ইনডিপেন্ডেন্স অফ বাংলাদেশ। কিন্তু আমি মেজর জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বলার অনুরোধ করি। জিয়াউর রহমান তাতে রাজি হয়ে আরো লিখেন (On Behalf of our great National Leader Bangalbandhu Shekih Mujibur Rahaman). কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের মাধ্যম তরঙ্গটি ১০ কিলোওয়াট শক্তি সম্পন্ন। সাধারণভাবে ৫০ মাইল আওতার মধ্যে এর প্রচার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু ২৫ মার্চের পর ঢাকার বাইরে রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও সিলেট কেন্দ্র স্তব্ধ থাকায় মধ্যবর্তী ইন্টারাপশন ছিল না। তাই এখান থেকেই প্রচারিত সব অনুষ্ঠান দেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম এবং ত্রিপুরা থেকেও শোনা যেত।

২৬ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দ্বিতীয়বার এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা (৩য় বার) দেশের লাখো কোটি মানুষ শুনেছে। যদিও চাটুকার নেতা ও ইতিহাস বিকৃতকারীরা জিয়াকেই স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারাও শুনেছেন ২৬ ও ২৭ মার্চে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীগুলো। যা হোক আজকে আমার প্রশ্ন কেন সে দিন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র পাহারার জন্য ক্যাপ্টেন রফিক আসেননি? মেজর রফিক কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এলে ইতিহাস বিকৃতকারীদের সে সুযোগ পাল্টে যেত।

সত্য গোপন থাকে না। জিয়াউর রহমান সেখানে এসেছিলেন, কেনইবা তাকে ডেকে নিয়ে আসা হলো? এসব প্রশ্নের মীমাংসা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর গত ৪০ বছর মিথ্যার বেসাতি দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান সেদিন কালুরঘাট এসছিলেন মূলত ২টি কারণে প্রথমত, কালুর ঘাট বেতারের শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদ, রেডিও স্টেশনের নিরাপত্তা এবং সামরিক বাহিনীর কোনো বাঙালি অফিসারকে দিয়ে স্বাধীনতার তৃতীয় ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজন বোধ করেছিলন।

দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতাকামী ও দেশপ্রেমিক একজন সৈনিক হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে। ২৭ মার্চের পর ২৮ ও ২৯ মার্চ স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র যথারীতি চলেছে। ৩০ মার্চ ছিল কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি কালো দিন। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত বিমান হামলার মধ্য দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল এই অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। দুপুরের অধিবেশনের পর দুপুর ২টা ১০ মিনিটে শুরু হয় বোমা বর্ষণ।

ফলে স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটে। এরপর ২য় পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সেই অকুতোভয় শব্দসৈনিকদের প্রচেষ্টায় আবার ভারতের আগরতলায় শুরু হয়। কার্যক্রম চলেছে ২৪ মে পর্যন্ত। ২৫ মে থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৩য় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয় ভারত সরকারের সহায়তায় ৫০ কিলোওয়াট একটি মধ্যম তরঙ্গ দিয়ে। অফিস স্থাপন করা হয় বিএসএফ ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। কালুরঘাট থেকে আগরতলা আবার আগরতলা থেকে কলকাতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গৌরবোজ্জ্বল কর্মকাণ্ড আজ ইতিহাসের সাক্ষী।

প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং পরে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী পাঠের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে বাঙালিদের কাছে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, সৈয়দ আবদুস শকের, বেলাল মোহাম্মদ, আমিনুর রহমান, এ এম শরিফুজ্জামান, রাশিদুল হাসান, রেজাউল করিম চৌধুরী, কাজী হাবিব উদ্দিন আহম্মেদ মনি, আবদুল্লাহ আল ফারুক এবং মুস্তফা আনোয়ার। স্বাধীন বাংলা বেতারের অকুতোভয় এ ১০ শব্দসৈনিকের নাম ইতিহসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

মুক্তিবুদ্ধির চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালিদের হৃদয়ে তারা বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুকে সঙ্গী করে তাদের সেদিনের সাহসিকতাপূর্ণ অবদান আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে দূরে বহুদূরে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর, গণসঙ্গীত, চরমপত্র, বেঈমানের দলিল, জল্লাদের দরবার প্রভৃতি অনুষ্ঠান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রক্তাক্ত মার্চের ২৬ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ পর্যন্ত সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে এ বিষয়গুলো ছিল একমাত্র সাহসের অবলম্বন, বেঁচে থাকার হাতিয়ার এবং অবসর কাটানোর মাধ্যম।

সময় থেমে থাকে না, চলছে চলবেই। অনুরূপভাবে ইতিহাসকে কোনোদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। প্রকৃত ইতিহাস সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবেই। তাই স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যতই মিথ্যাচার হোক না কেন স্বাধীনতার ঘোষক তথা মহানায়কের নাম কখনই মুছে ফেলা যাবে না।

ইতিহাস বিকৃতকারী ভণ্ড ও ক্রীতদাস বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্ট এবং কথিত ঘোষক আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই। কারণ ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র সফল গণআন্দোলন এবং ৭০’র নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয় হলো স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। পক্ষান্তরে ছয় দফার নায়ক বঙ্গবন্ধু, গণআন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গবন্ধু এবং ’৭০ সালের নির্বাচনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App