×

বিশেষ সংখ্যা

আনন্দ ও বিষাদমাখা বিজয়ের স্মৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:৪০ পিএম

আনন্দ ও বিষাদমাখা বিজয়ের স্মৃতি
আনন্দ ও বিষাদমাখা বিজয়ের স্মৃতি

আনোয়ার পাশা তার উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত-এর এই শেষ কথাগুলো লিখেছিলেন একাত্তরের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। তখনই ‘রাত কেটে যাবে’ বলে তার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জেগেছিল। এরপর ছয় মাসের মাথাতেই রাত কেটে গিয়েছিল বটে, কিন্তু আনোয়ার পাশা তা দেখে যেতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে আমি ছিলাম মেঘালয়ের শরণার্থী শিবিরে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সরাসরি যুদ্ধ চলে মাত্র তেরো দিন। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সংযোগে তৈরি হয়ে যায় যৌথ বাহিনী। এই যৌথবাহিনীর হাতেই পতন ঘটে পাক হানাদার বাহিনীর। ডিসেম্বরের ষোলো তারিখে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটে যুদ্ধের।

তেরোটি দিন বড় দ্রুত চলে যেতে থাকে। রণাঙ্গন থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন খবর আসে। যুদ্ধের খবরের পাশাপাশি আমাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নানা অপতৎপরতার খবর আতঙ্কিত করে তোলে আমাদের। সেইসঙ্গে আসে কমিউনিস্ট চীনের শত্রুতার খবর। ষাটের দশকে পিকিং রিভিউয়ে সোভিয়েত ‘সংশোধনবাদীদের’ বিরুদ্ধে চীনের অনেক অভিযোগের কথাই পড়তাম। শুধু সংশোধনবাদী নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের পরিণত হয়ে গেছে পিকিং রিভিউয়ে সে বিষয়েও অনেক লেখা পড়েছি।

জেনেছি যে, স্তালিনের মৃত্যুর পর থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিচ্যুতি শুরু হয়েছে। এবং বিচ্যুতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সারা দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সহযোগিতা করে যাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে। সমাজ বিপ্লব ও মানব প্রগতির পক্ষে সোভিয়েত এখন কোনো ভূমিকাই রাখবে না। সোভিয়েতের শাসকরা লেনিনের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়েছে স্তালিনের মৃত্যুর পরই। এখন লেনিনবাদের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছে মাও সেতুং-এর মহান চিন্তাধারায় সমৃদ্ধ গণচীন।

গণচীনের এ রকম গরম বক্তব্য আমাদের অবশ্যই আলোড়িত করত। সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতেও এক সময় ভাঙন ধরেছিল চীনা কমিউনিস্টদের গরম কথার তাপেই। ‘সংশোধনবাদীদের’ সংস্পর্শ পরিত্যাগ করে ‘বিপ্লবীরা’ আন্ডার গ্রাউন্ড অবস্থাতেই নতুন পার্টি গড়লেন। ‘সংশোধনবাদী’ আর ‘বিপ্লবীরা’ পরস্পরের বিরুদ্ধে এত বিষোদগার করলেন যে, এর শতাংশের একাংশ যদি তারা ঢেলে দিতে পারতেন তাদের সাধারণ শত্রু অর্থাৎ ধনতন্ত্রী শোষক গোষ্ঠীর ওপর তাহলে সে গোষ্ঠীর কবেই উচ্ছেদ হয়ে যেত।

তবে আমাদের দেশের ‘সংশোধনবাদী’ কমিউনিস্ট পার্টিটি ‘মস্কোর দালাল’ ছিল বলেই মস্কো যতদিন কমিউনিজমের সাইনবোর্ডটি অন্তত ধরে রেখেছিল, ততদিন এ পার্টিতে কোনো ভাঙন দেখা দেয়নি। কিন্তু পিকিংপন্থি বলে পরিচিত বিপ্লবী কমিউনিস্টরা এক পার্টিতে মিলিত হয়ে থাকতে পারেনি, পঁয়ষট্টি থেকে একাত্তর সালের মধ্যেই বহুধা বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। পিকিং বোধ হয় বহুধা বিভক্ত পিকিংপন্থীদের কোনো অংশকেই নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়নি। ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ বলে তারা ভর্ৎসনার পাত্র হয়েছিল। আমাদের পিকিংপন্থিদের পিকিংপন্থা তথা মাও সেতুঙ-এর চিন্তাধারার ব্যাখ্যাতেও ছিল বহু বৈচিত্র্য। সে সব বিচিত্র ব্যাখ্যার সবগুলো কিংবা কোনো একটাকে সঠিক বলে অনুমোদন দেয়াও সম্ভবত পিকিং-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মস্কোপন্থি ও পিকিংপন্থি উভয়গোষ্ঠীর মধ্যেই সুবিধাবাদী, মতলববাজ ও দুর্বলচিত্ত কিছু লোক অবশ্যই ছিল। সন্দেহ নেই যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের বিভ্রান্তির শিকার হয়ে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা অনেক আত্মঘাতী ঘটনাও ঘটিয়েছে। বামপন্থি শিবিরে অবস্থান নিয়েই কিছু লোক প্রতিক্রিয়াশীল শাসক-শোষকদের দালালিও করেছে। তবু কিন্তু বলতেই হবে যে, সামগ্রিকভাবে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ছিল প্রকৃত অর্থেই দেশপ্রেমিক, দেশের অধিকারবঞ্চিত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ ও সমাজ বিপ্লবের জন্য আত্মোৎসর্গে সদা প্রস্তুত।

তাই আমরা দেখেছি একাত্তরে বামপন্থি পরিচয়দানকারী কিছু লোক যদিও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের সহযোগিতা করেছে, তাদের জন্য ‘মুরগি সাপ্লাইয়ের’ কাজও করেছে কেউ, তবু এ ধরনের কুলাঙ্গারের সংখ্যা মুষ্টিমেয়ই ছিল। মস্কোপন্থি-পিকিংপন্থি নির্বিশেষে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বরং যে যে অবস্থায় যেখান থেকে পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালনে কেউই পিছিয়ে থাকেননি।

এমনকি পিকিংপন্থিদের যে গোষ্ঠীটি মুক্তিযুদ্ধকে আখ্যা দিয়েছিল ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে, তারাও নিজেদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, একই সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে জীবন দিয়েছে। এদের এই আচরণকে বিভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, উন্মাদ, হঠকারী, আত্মঘাতী, বালখিল্য কিংবা বাংলা ভাষায় প্রচলিত এ রকম হাজারো বিশেষণ প্রয়োগ করেও সঠিকভাবে প্রকাশ করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। তবু একান্ত স্ববিরোধী হবে জেনেও এই বিপথগামী তরুণদের আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা করি, এদের বিভ্রান্তিমূলক করুণ পরিণতিতে আমি গভীর বেদনাহত হই। এরা বিপজ্জনক বিপথে পা দিয়ে নিজেদেরই সর্বনাশ করেছে বটে, কিন্তু এদের লক্ষ্যের মহত্ত্ব সম্পর্কে আমি একটুও সন্দেহ পোষণ করি না।

এদের এই সর্বনাশা বিপথগামিতার জন্য বরং ধিক্কার জানাতে হয় এদের আন্তর্জাতিক মুরব্বি গণচীনের ভ্রান্তিবিলাসমত্ত নেতাদের। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ও মার্কসবাদের বিকাশ সাধনে মাও সেতুঙের অবদানকে যারা পুরোপুরি অস্বীকার করেন কিংবা একান্তই খাটো করে দেখেন, আমি তাদের দলে নই। সমাজতন্ত্রের এই একান্ত দুঃসময়েও, মাও সেতুঙের রচনাবলি পাঠ করে আমি গভীর আশবাদের উদ্দীপ্ত হই। কিন্তু সেই মাও সেতুঙ নেতৃত্বাধীন গণচীনই যখন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করে নিতান্তই সংকীর্ণ জাতিগত স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে, ‘বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সোভিয়েত-মার্কিন সহযোগিতার অভিযোগ উত্থাপনকারী চৈনিক নেতৃত্বই যখন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়ার জন্য আমেরিকার সঙ্গে মিলে পাকিস্তানকে মদদ দেয়, তখন ক্ষুব্ধ না হয়ে পারি না। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষই বা তা পারে?

আমাদের সৌভাগ্য যে, সে সময়ে ‘মুক্ত বিশ্বের নেতা’ ‘গণতন্ত্রী’ আমেরিকা ও বিপ্লবী গণচীনের বিপরীতে ‘সংশোধনবাদী’ ও ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত ব্লকের অন্যান্য দেশ ও সারা দুনিয়ার ‘মস্কোপন্থি’ কমিউনিস্ট পার্টগুলো একান্ত দৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় লাভে সহায়তা করেছিল।

ভারতের ‘মস্কোপন্থি’ পার্টিটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বুর্জোয়া কংগ্রেসি সরকারের কার্যক্রম সমর্থন করলেও বুর্জোয়াদের শয়তানি সম্পর্কে সচেতনতা পরিত্যাগ করেনি। প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের বাংলাদেশ-প্রেম যে ‘কামগন্ধহীন নিকষিত হেম’ ছিল না, কমিউনিস্টরা তা বুঝত। তাই ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অগ্রাভিযানের খবর দিতে গিয়ে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিতিদের একটি পত্রিকা যখন ‘যশোর আমাদের দখলে’, ‘হিলি আমাদের দখলে’ এ রকম শিরোনাম জুড়ে দিচ্ছিল, তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা মুখপত্র কালান্তর তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের ব্যাপারটির প্রতিই ভারতের অনেক কমিউনিস্ট নেতা অন্তর থেকে সায় দিতে পারেননি। বাংলাদেশের মুক্তিসেনারাই তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করবে, ভারত তাদের সহায়তা করবে মাত্র- প্রগতিশীল মানুষদের এ রকমই প্রত্যাশা ছিল।

তবু ঘটনা পরম্পরা যখন শেষে পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্তই গড়াল এবং তৈরি হলো যৌথ বাহিনী, তখন ভারতীয় সেনাদের সকর্মক ভূমিকাকে মেনে নিতেই হলো। তবে ভারতীয় বাহিনীর ভেতর যাতে দখলদার বাহিনীর মনোবৃত্তি দেখা না দেয়, ভারতীয় বুর্জোয়াদের বৃহৎ শক্তির দম্ভ প্রকাশিত হতে না পারে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি থাকে শ্রদ্ধাবোধ- ভারতের প্রগতিশীল শক্তিসমূহের এমনটিই কাম্য ছিল। বামপন্থিরা এ ব্যাপারেও যথাযথ ভূমিকা রেখেছিল।

সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীরাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদেরই ছিল মূল ভূমিকা। এ যুদ্ধে ভারতেরও মূল ও সক্রিয় সহায়তাটি এসেছিল একটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী সরকারের তরফ থেকেই। তবু মুক্তিযুদ্ধের আনুপূর্বিক ঘটনাধারার পর্যালোচনায় দেখা যায় যে জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সাম্যবাদী বামপন্থিদের সক্রিয় সংযোগের মধ্য দিয়েই এ যুদ্ধ সফল পরিণতিতে পৌঁছেছিল, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকার একটি ভূখণ্ডে পাকিস্তান নামক একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি যৌক্তিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।

পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্ম ঘটানোতে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সংযোগের গুরুত্ব ও তাৎপর্যটি অনেকেই ধরতে পারেননি। অনেক বাঘা বাঘা রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরও বোধ এ ব্যাপারে একান্ত ভোঁতা। অথচ একজন বাঙালি কথাশিল্পীর ভেতর এ বোধের জাগরণ ঘটেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শুরুতেই। এই কথাশিল্পীর নাম আনোয়ার পাশা। ইনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন অধ্যাপক। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে বসেই ইনি একাত্তরের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে রচনা করে ফেলেছিলেন একটি উপন্যাস- রাইফেল রোটি আওরাত। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম তখনো মোটেই সংহত হয়ে ওঠেনি। তখনকার বর্তমান ছিল একান্তই সংকটময় ও ভবিষ্যৎ নিতান্তই অনিশ্চিত।

তবু সেই সংকট ও অনিশ্চিতির ভেতরই কথাশিল্পী আনোয়ার পাশা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলেন যে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ সফল হবেই। তিনি উপন্যাসের যে নায়ক চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন তার নাম সুদীপ্ত। সেই সুদীপ্ত আসলে আনোয়ার পাশারই প্রতিরূপ। সুদীপ্তও তার স্রষ্টা আনোয়ার পাশার মতোই জীবন বাঁচানোর তাগিদে হানাদার কবলিত ঢাকার এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। উপন্যাসটিতে সুদীপ্ত তথা কথাশিল্পীর নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক মধ্যবিত্তের চরিত্রের নানা অসঙ্গতির দিকগুলো উদঘাটিত হয়েছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুদীপ্তর অন্তরে ক্ষোভের অন্ত নেই।

বাংলাদেশের জন্ম হোক এমনটিই তার উদগ্র আকাক্সক্ষা। অথচ সেই আকাক্সক্ষার পরিপূর্তি ঘটার মতো অনুকূল অবস্থাও সে তার চারপাশে দেখতে পায় না। কিন্তু উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদে এসে দেখি, সুদীপ্ত পরিচিত হয়েছে জাতীয়তাবাদী জামাল আহমদ ও কমিউনিস্ট নেত্রী বুলার সঙ্গে। সুদীপ্ত দেখল, এই দুজনের কর্মপ্রয়াস বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে একত্র সংযুক্ত হয়েছে। আর তখনই সুদীপ্ত তথা তার স্রষ্টা আনোয়ার পাশার চকিত উপলব্ধি-

‘পুরনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা, তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সেই আর কত দূরে? বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মো ভৈঃ। কেটে যাবে।’

আনোয়ার পাশা তার উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত-এর এই শেষ কথাগুলো লিখেছিলেন একাত্তরের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। তখনই ‘রাত কেটে যাবে’ বলে তার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জেগেছিল। এরপর ছয় মাসের মাথাতেই রাত কেটে গিয়েছিল বটে, কিন্তু আনোয়ার পাশা তা দেখে যেতে পারেননি।

শুধু আনোয়ার পাশা নয়, তার মতো বোধির অনুশীলনে যারা রত ছিলেন, পাকিস্তানের নিশ্চিদ্র তমসার ভেতরে বসেই আপন আপন প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে যারা নতুন একটি প্রভাতের আগমনী রচনা করে চলেছিলেন, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে যারা পাকিস্তানের মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্মের মুহূর্তটির জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন, তাদের অনেকেরই সৌভাগ্য হলো না সেই একান্ত কাক্সিক্ষত মাহেন্দ্রক্ষণটি প্রত্যক্ষ করার। তার আগেই কতকগুলো অন্ধকারের জীব ওই আলোক-তাপসদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল।

ডিসেম্বরের ১ তারিখেরই যে ময়মনসিংহ শহর মুক্ত হয়ে গেছে, সে খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গিয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বরে পাকবাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের পর আর ভিনদেশে শরণার্থী শিবিরে বসে থাকতে পারছিলাম না। অস্থির হয়ে পড়েছিলাম মুক্ত স্বদেশের মাটি স্পর্শ করার জন্য। ১৮ কি ১৯ তারিখেই সীমান্ত পার হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম।

অনুভব করলাম: মানুষের অন্তরে অন্তরে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের এক ঝর্ণাধারা। পরিচিত যার সঙ্গে দেখা হয় সেই বুকে জড়িয়ে ধরে। ‘কেমন আছেন?’ এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করে না। চোখ বড় বড় করে শুধু বলে, ‘বেঁচে আছেন?’ পাকিস্তানি বর্বরদের সেই মারণযজ্ঞের ভেতরেও যার জানটা কেবল বেঁচে রয়েছে, সেই তো মহা ভাগ্যবান। সে কেমন আছে- সে প্রশ্ন তখন একান্তই অবান্তর। কত প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতেই না হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত পথটুকু পাড়ি দিলাম।

রাস্তার সব সেতু ও কালভার্ট ভাঙা। যুদ্ধ চলার সময় এর কতকগুলো ভেঙেছিল মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। অবশিষ্ট ছিল যেগুলো, পাকসেনারা পলায়নের সময় সেগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। কাজেই রাস্তায় কোনো মোটরযানের চলাচল নেই। পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছিলাম দীর্ঘ পথ। সারাদিন পথ চলার পর সন্ধ্যা নামল সরচাপুর নামক একটি গ্রামের ধারে এসে। সে গ্রামেই এক ভদ্রলোকের বাড়িতে রাত কাটালাম। শুয়ে শুয়ে রেডিওতে খবর শুনছিলাম। হঠাৎ কানে এল এক মর্মান্তিক সংবাদ।

পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ওদের এ দেশীয় দালালরা বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এই বুদ্ধিজীবীদের বিকৃত মরদেহ পাওয়া গেছে ঢাকার রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। সে রাতে আকাশবাণীর খবরে সম্ভবত মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসুদ্দিন আহমদ, সন্তোষ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লা কায়সার, ডাক্তার আলিম চৌধুরী, ডাক্তার ফজলে রাব্বি, ডাক্তার মোর্তজা- এই কজন বুদ্ধিজীবীর শহীদ হওয়ার কথা শুনি। এরপর আরো কয়েকজনের নাম জানতে পারি। শুনি আনোয়ার পাশার নামটিও। আনোয়ার পাশার লেখার সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল, তেমন কোনো অসাধারণ বৈশিষ্ট্য তাতে খুঁজে পাইনি। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের অল্পদিন পরেই যখন সেই আনোয়ার পাশার উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত প্রকাশিত হলো, তখন সেটি পড়ে যেন একজন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পীর সাক্ষাৎ পেলাম। দিব্যদৃষ্টিতে যিনি বাংলাদেশের জন্ম প্রত্যক্ষ করেছিলেন চর্মচক্ষে সেই দেশটিকে প্রাণভরে দেখার সৌভাগ্য থেকে তাকে বঞ্চিত করল এ দেশেরই কতকগুলো মনুষ্যরূপী সারমেয়।

সম্ভবত ডিসেম্বরের ২০ তারিখে ময়মনসিংহ শহরে এলাম। স্ত্রী-পুত্রসহ আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হলাম দীর্ঘ নয় মাস পরে। একাত্তরে আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। এই বয়সেই ত্রিকালদর্শী দার্শনিক হয়ে গেলাম। ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর পাকিস্তানের জন্ম দর্শন করলাম। আবার দর্শন করলাম পাকিস্তানের মৃত্যু আর বাংলাদেশের জন্মও। বাংলাদেশের জন্মের ক্ষণটিতে কিন্তু মোটেই ভাবতে পারিনি যে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশেই আমাকে পাকিস্তানের ভূত দেখতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App