×

বিশেষ সংখ্যা

আঞ্চলিক গানে মুক্তিযুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:২৫ পিএম

আঞ্চলিক গানে মুক্তিযুদ্ধ

ভাষা আন্দোলনের অবধারিত পরিণতি হিসেবে ১৯৭১ সালে সূচিত মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়, তাদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার জমিন ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এত লোকের প্রাণহানি, এত রক্তপাত, এত মা-বোনের সম্ভ্রমহানি পৃথিবীতে বিরল। এ কারণে বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, গান, চিত্রকলা সবকিছুতেই প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগান ও আঞ্চলিক গানেও এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমরা এখানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন তুলে ধরার চেষ্টা করব। আরো খোলাসা করে বললে, মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে রচিত আঞ্চলিক গান উপস্থাপনে সচেষ্ট হবো। চট্টগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য এলাকা বাঁশখালী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এখানকার বড়ঘোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ছিলেন বিনোদবালা নামে এক সুন্দরী নারী। তিনি বিবাহিতা ছিলেন ও তাঁর দুটি কন্যা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁশখালীতে রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর রাজাকারদের কুদৃষ্টি পতিত হয় বিনোদবালার দিকে। ফলে একদিন কতিপয় রাজাকার তাঁকে এবং তাঁর এক কন্যাকে জোরপূর্বক ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর মা-মেয়েকে তারা গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যাও করে।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরপর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে চিরতরে বিলুপ্ত করার হীন ষড়যন্ত্র শুরু করলে, বাঙালিরা বুঝতে পারে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তারা স্বাধীন নয়। ব্রিটিশের পর তারা আবার পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাসে পরিণত হয়েছে।

এ সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন পদার্থবিদ্যা বিভাগের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেম তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। এর উদ্যোগে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ (প্রকাশক-অধ্যাপক এম এ কাসেম এম এস সি, তমদ্দুন অফিস, রমনা, ঢাকা। প্রিন্টার এ এইচ সৈয়দ, বলিয়াদী প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ১৩৭নং বংশাল রোড, ঢাকা) নামে পুস্তিকা। তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে এই পুস্তিকা প্রকাশিত হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) আলোড়িত হয় এবং ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে।

এই আন্দোলন চলে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি এই আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করলেও এ আন্দোলনের সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে চলে নানা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর আক্রমণ সংঘটিত করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

ভাষা আন্দোলনের অবধারিত পরিণতি হিসেবে ১৯৭১ সালে সূচিত মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়, তাদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার জমিন ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এত লোকের প্রাণহানি, এত রক্তপাত, এত মা-বোনের সম্ভ্রমহানি পৃথিবীতে বিরল। এ কারণে বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, গান, চিত্রকলা সবকিছুতেই প্রতিফলিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগান ও আঞ্চলিক গানেও এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। আমরা এখানে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন তুলে ধরার চেষ্টা করব। আরো খোলাসা করে বললে, মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে রচিত আঞ্চলিক গান উপস্থাপনে সচেষ্ট হবো।

চট্টগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য এলাকা বাঁশখালী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এখানকার বড়ঘোনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ছিলেন বিনোদবালা নামে এক সুন্দরী নারী। তিনি বিবাহিতা ছিলেন ও তাঁর দুটি কন্যা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঁশখালীতে রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়ার পর রাজাকারদের কুদৃষ্টি পতিত হয় বিনোদবালার দিকে। ফলে একদিন কতিপয় রাজাকার তাঁকে এবং তাঁর এক কন্যাকে জোরপূর্বক ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।

শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর মা-মেয়েকে তারা গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যাও করে। এ ঘটনায় পুরো বাঁশখালীতে শোকের ছায়া নামে। অনন্তর, অনন্ত শোকে বিনোদবালার অপর কন্যাও অতি দ্রুত মারা যায়। তখন বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল গ্রামের কবিয়াল মিলন সরকার গভীর দুঃখে নিম্নোক্ত গানটি রচনা করেন :

ইয়াহিয়া গুণ্ডা, বাঙালিরে গরলি সর্বনাশ। ঘর পুড়িলি, ছাই গরিলি, দিলি গণভোট; তারপরেতে শুরু গরলি বাঙালিরে লুট; বাঙালি-অবাঙালি মিলি গরলি সর্বনাশরে। বিনোদবালার দুটি মেয়ে মেট্রিক পাস গরিল’ একটি মেয়ে রাজাকারে গুলিতে মারিল; অপর মেয়ে মরি গেল কাঁদিয়া কাঁদিয়ারে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাঁশখালীর ঘরে ঘরে করুণ সুরে গানটি গাওয়া হতো আর মানব-মানবীর চোখ ভিজে উঠত।

বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব বড়ঘোনা গ্রামের সৈয়দ আহমদের পুত্র দিদারুল হক শূন্য দশকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকাকালে তাঁর কাছ থেকে আমরা এই গান উদ্ধার করি। তিনি আমাদের উপর্যুক্ত ঘটনাসহ জানিয়েছেন, গানটি তাঁর পুরোপুরি স্মরণে নেই।

চট্টগ্রামের রাউজান এলাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর নাম সারা বাংলাদেশের মানুষ অবগত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বে তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রামে বহু গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এই ফজলুল কাদের চৌধুরী সপরিবারে বার্মার আকিয়াবের উদ্দেশ্যে নদী পথে পালাতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ধরা পড়ে।

সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, দুপুর। আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়ার চরে এসে তাদের বহনকৃত গানবোট আটকে গেলে, ফজলুল কাদের চৌধুরী পতেঙ্গার ফেলু মিয়া ও নবী হোসেনসহ ৪ জন সাম্পান-মাঝির সাথে শরের সাম্পান-যোগে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সপরিবারে তাকে আকিয়াবে পৌঁছে দেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয় এবং গানবোট থেকে মালামাল ও পরিবার নিয়ে মাঝিদের সাম্পানে উঠে আসে।

ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে মাঝিদের চুক্তিবদ্ধ হওয়া ছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাকে ধরিয়ে দেয়ার কৌশল। চুক্তির পর মাঝিদের দুজন অর্থাৎ ফেলু মিয়া ও নবী হোসেন ফজলুল কাদের চৌধুরীকে একটু অপেক্ষা করতে বলে আনোয়ারা মেরিন একাডেমিতে আসে। তখন একাডেমিতে সেখানকার পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদীর কাছে আত্মসমর্পণ করছিল। মাঝিদ্বয় সেখানে সপরিবারে ফজলুল কাদের চৌধুরী আকিয়াবে পালিয়ে যাচ্ছে সংবাদ প্রদান করলে, সেখান থেকে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গাদিয়ার চরে গিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীদের গ্রেপ্তার করেন।

কবিয়াল রমেশ শীলের সুযোগ্য শিষ্য ফণি বড়ুয়া অসাধারণভাবে ফজলুল কাদের চৌধুরীর এই ধরা পড়া বা গ্রেপ্তার বিষয়ে নিম্নোক্ত গান রচনা করেন:

ফজল কাদের কণ্ডে আছে জাননি খবর, চাটগাঁ ছাড়ি আইক্যাপ যাইতে ধৈর্যে সাম্পানের ভিতর। মুসলিম লীগের বড় পাণ্ডা গুণ্ডাদের সর্দার, দেশদ্রোহী বাংলার শত্রু ফজল ইস্পিকার, তার মতো নাই ভালা মানুষ চোর ডাকাইতের মাতব্বর। ফজল্যার চেলা চামুণ্ডা আছে যেই জায়গায়, মুক্তি ফৌজের পায়ে পড়ি গড়াগড়ি যায়, তারা ইচ্ছামতো জুলুম চালায় কত মা-বোনের ওপর। ফজল্যার মাথার উপরে বসিয়া শকুন, চট্টগ্রামের বহু মানুষ করিয়াছে খুন, গ্রামে গ্রামে দিল আগুন বেশি পোড়ে হিন্দুুর ঘর। ডা-ার ভয়ে যারা করে সালাম নমস্কার, এখন ঝাঁটা জুতার মালা গাঁতে দিতে পুরস্কার, বন্ধু সাজি ইয়াহিয়ার সৃষ্টি করে রাজাকার। জয় বাংলার ধ্বনি দিয়া হাতে হাত মিলাই, মির্জাফরের চামড়া দিয়া ডুকডুকি বাজাই, তাদের হাড্ডি দিয়া বাঁশি বানাই বাজাবে শেখ মুজিবুর।

এই গান আজো চট্টগ্রামের মানুষের কণ্ঠে বাজে। দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকের কী করুণ হতে পারে, সেই শিক্ষা এই গানের ‘ডাণ্ডার ভয়ে যারা করে সালাম নমস্কার/এখন ঝাঁটা জুতার মালা গাঁতে দিতে পুরস্কার’- চরণদ্বয় থেকে পাওয়া যায়।

দুই. বাংলাদেশের স্বনামধন্য কবিয়াল এয়াকুব আলীর দুর্লভ গ্রন্থ ‘চাটগাঁয়ের আঞ্চলিক গান’ থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুটি গান পেয়েছি। একটি গানে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ‘চোর-ডাকাইতে’র সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করার কথা ছাড়াও অবিচার, গোলাগুলি ও বহু হত্যাকাণ্ডের কথা বর্ণনা করে তৎকালীন ভয়াবহ সমাজচিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ বাঙালির শহীদ হওয়া ও অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটার কথা উল্লেখ করে এটাও বলা হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ ‘খাইত’ (খেতে) ও ‘থাইত’ (থাকতে) পারছে না।

চোর-ডাকাইতে স্বাধীনতা বেশ পাইয়ে। আগাছা পরগাছা হওলে লুটপাট করি দেশ খাইয়ে। চোর-ডাকাইতে স্বাধীনতা বেশ পাইয়ে। কার বিচার কনে করের, চোরে যাই পুলিশ ধরের, পইত্য রাইতত মারের ধরের, দেশরে তারা কি পাইয়ে। গোলাগুলির শব্দ হর, আওয়াজ হুনির ডওর ডওর, মাইনষ্যত্তে পরানর ডর, কতজন তো শেষ হইয়ে। চোর-ডাকাইতে স্বাধীনতা বেশ পাইয়ে। দিনত যেই কয় ভালা কথা, রাইতত তে ডাকাইতর নেতা, বাংলাদেশ তো স্বাধীনতা, হেগুণে তো বেশ পাইয়ে। ত্রিশ লাখ মানুষ মরি, মা ভইনরে বেইজ্জৎ করি, (এখন) খাইত ন পারি থাইত ন পারি, গম নেতা কণ্ডে গেইয়ে। চোর-ডাকাইতে স্বাধীনতা বেশ পাইয়ে। ছোট চোর অল ধরা পরে, বড় গুণ ধরতে লজ্জা করে, হিতার লাই বড় গুণ ন ধরে, আঁত্তে লাদ্দে ডরাইয়ে, বড় বড় চোর-ডাকাইতে লুঠ করি খায় দিনে রাইতে, ধরছোনা আল্লার কাইত চাইতে, নইলে দেশ বরবাদ হইয়ে। চোর-ডাকাইতে স্বাধীনতা বেশ পাইয়ে।

অপর গানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছে ‘শোষক শ্রেণির বাইশ পরিবার’ এবং ‘হানাদার পাঞ্জাবি’। তবু সাধারণ মানুষ ‘স্বাধীন দেশত নিজর ঘরত সুখে ঘুম যাইত’ (স্বাধীন দেশে নিজের ঘরে সুখে ঘুম যেতে) পারছে না। প্রতিটি রাতে ‘চুরি ডাকাতি রাহাজানি হাইজ্যাক গোলাগুলির কারবার। অর্থাৎ এই গানেও স্বাধীনতা পরবর্তীকালের এ দেশের কঠোর সমাজচিত্র।

শোষক শ্রেণির বাইশ পরিবার ধাইয়ে বাংলাদেশ ছাড়ি। হানাদার পাঞ্জাবি ধাইয়ে হইতো নয় মারামারি। শোষক শ্রেণির বাইশ পরিবার ধাইয়ে বাংলাদেশ ছাড়ি। গাড়ি বাড়ি দখল করি লাইসেন্স পারমিট ধারী মুনাফাখোরী কালোবাজারি সুন্দরী নারী লইয়ারে মজা লুটে। অর ইনদি শতকড়া নব্বই ভাত কাওড়র জালায় মাথা কুটে। টেঁয়া পইযা ধন সম্পত্তি কয়েক জনর যার বাড়ি। শোষক শ্রেণির বাইশ পরিবার ধাইয়ে বাংলাদেশ ছাড়ি। চুরি ডাকাতি রাহাজানি হাইজ্যাক গোলাগুলি পইত্য রাইতত এই কারবার। রক্ষি বাহিনীয়ে রক্ষা ন করের, পুলিশেও যাই ন ত ধরের, গওরমেন্টে ক্যা থওসা চার।

স্বাধীন দেশত নিজর ঘরত সুখে ঘুম যাইত ন পারি। শোষক শ্রেণির বাইশ পরিবার ধাইয়ে বাংলাদেশ ছাড়ি। এখন মালিকর জাগাত প্রশাসক বইস্বে ডবল মালিক তেঁই হইয়ে। উৎপাদন ন ত বাড়ের প্রশাসক মজা মারের, ফোয়াদর কামা কামাইয়ে।

(যেন কি) বিলাইয়ে ছেঁয়ার মাছ পাইয়ে মচমচাই খার লেচ লারি। শোষক শ্রেণির বাইশ পরিবার ধাইয়ে বাংলাদেশ ছাড়ি।

এয়াকুব আলীর সুযোগ্য শিষ্য কবিয়াল মোহাম্মদ সৈয়দও মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে কয়েকটি আঞ্চলিক গান রচনা করেন। পরবর্তী সময় নব্বই ও শূন্য দশকে খ্যাতিমান গীতিকার এম এন আখতার কয়েকটি গান রচনা করেন, যেগুলো মূলত ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়গাথা।

এ ক্ষেত্রে ‘বঁটা উড়াই দে বাস্যালাইন নিশান উড়াই দে’, ‘উনিশশ একাত্তর সন ফেলাই বাড়ি ঘর’, ‘আজিয়া দেশর বিজয় দিন কাম করজ ছাড়ি’, ‘জারি সারি পুঁথি আছে আছে লেখা কবির গান’, ‘মা মা মা বিজয় নিশান হাতে ধরি তোরা’, ‘অ ভাই দিন ঘুরি মাস ঘুরি আইয়ে এক বছর যেদিন ঘুরে’ এবং ‘হাতত আছে কলর বন্দুক-মুখত আছে খিলি পান’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

১৯৯৫ ও ২০০০ সালের ১৬ ডিসেম্বরসহ নানা সময়ে বাংলাদেশ বেতারে প্রচারের জন্য বেতারের অনুরোধে গানগুলো রচিত হয়। ২০০০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বেতারে প্রচারিত ‘মা মা মা বিজয় নিশান হাতে ধরি তোরা’ গানটি উপস্থাপন করা যাক : মা মা মা বিজয় নিশান হাতে ধরি তোরা পুঁছিদে চোগর পানি, কডে আঁর খালা ভাই-ভৈন কডে রে মা দুঃখিনী।

দুঃখিনী মা-র পোয়া মাইয়া এই দেশর লাই পরাণ দিইয়ে তিরিশ লক্ষ, দেখাই দিইয়ে ভাই, কাড়ি লইয়ে স্বাধীনতা মরা লাশ গনি।

মাথার ঘাম পইজ্জে ঠেঁঙত গেইয়ে কত লৌ, অল্প বসত রাড়ি হইয়ে ঘরর নোয়া বউ, তবু তারার মুখত হাসি কাঁইনতে ন হুনি।

এম এন আখতারের সমসাময়িক আবদুল গফুর হালীও মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বনে গান রচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত শুধুমাত্র একটি গান রচনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ছেলে ফিরে আসবে বলে দুই যুগ অপেক্ষায় থাকা জননীর বিলাপ নব্বই দশকে রচিত এই গানে প্রকাশ পেয়েছে।

শহীদের মা কান্দে ল্যে বটগাছ তলে বই, বেয়াগ্গুনর পোয়া ফিরি আইলো আঁর পোয়া কই। পঁচিশ বছর বয়স অইয়েল চাঁদর মত মুখ, সোয়ামী হারাই মনে গইয্যেল পুতে দিব সুখ, দারুণ যুদ্ধে সুখর ঘরগান ভাঙি গেইএ গৈ। রাইতদিন কাডায় কান্দি কান্দি পাগলিনি মা, কেয়ারে পাইলে পুছার গরে শহীদ আইএর না, পুতর আশাত দুই যুগ ধরি রাস্তা দিয়ে চাই। ছিঁড়া কেথার গাট্টিবা লই ঘুরে পথে পথে, ভুগ লাগিলে মানুষ দেইলে ভিক্ষাল্লাই হাত পাতে, হক্কল সমত কয় আল্লা আঁরে যা তুই লই। শূন্য দশকে শাহীন নুপুর রচিত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক দুটি আঞ্চলিক গান পাওয়া গেছে। প্রথম গানে রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়ার কথা, রাজাকারের তালিকা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বর্ণিত। এ ছাড়াও বর্ণিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা ‘হিন্দু ধরি খৎনা গইরগ্যে আর গইরগ্যে মার বুক খাইল্যা’ (হিন্দুদের খতনা করেছে এবং মায়ের বুক শূন্য করেছে)।

আঁরা অইলাম অবোধ জাতি লজ্জা রাহার জাগা নাই, রাজাকার আব্বাইস্যাও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পায়। পাকবাহিনীর দোসর সাজি খাইর, হেফাজু, নুরুইল্লা; হিন্দু ধরি খৎনা গইরগ্যে আর গইরগ্যে মার বুক খাইল্যা। পাকবাহিনীর চামচা আছিল মোখতার, আমিন, খোকাইয়া; তারার কারণ, তিনশ মানুষ মইল্য পুঁচি-গলিয়া।

... ... ... ... ... ... তবু তারা স্বাধীন দেশত আছে রাজার মতো অই; রাজাকার কই গালি দিলে তারার বলে মান যায় গই। তারা বেয়াগ ধ্বংস অই যক, পড়ক মহা অভিশাপ; তারার বিচার চাইত পাইল্লি আঁই মতত পাইয়ুম সুখর তাপ।

দ্বিতীয় গানে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও ভূমিকার কথা, এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম অনুল্লেখ থাকার কথা রয়েছে। আঁর বাপেও গইরগ্যে যুদ্ধ দেশ আনিবার লাই, গাছবাইরগাত্তন আঁডি আঁডি রাঙ্গুনিয়া যায়। মুক্তিযোদ্ধার প্রেরণাল্লাই নৌকা বানাই হাঁধুরুত লই ঘুইরগ্যে অনেক এ-গাঁয় ও-গাঁয়। রাজাকারে আঁর বাপরে বন্দি গইরগ্যিল হায়, বহুত কষ্টে জেলখানাত্তন গেইয়্যেলদে পলায়। হথ জাগাত গইরগ্যে যুদ্ধ স্বাধীন দেশরলাই, (কিন্তু) মুক্তিযোদ্ধার তালিকানত আঁর বাপর নাম নাই। বাপে হদ্দে এই হথাল্লাই দুঃখ ন গরি; রাজাকারর বিচার অক, যেন শান্তি পাই মরি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App