×

মুক্তচিন্তা

কেন বিদেশি প্রফেশনালরা স্থান করে নিচ্ছেন আমাদের জায়গাগুলো?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:২৬ পিএম

একদিকে দেশের ভেতরে বেকার এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যেখানে প্রকট সেখানে দেশ থেকে অর্থ চলে যেতে দেখতে হচ্ছে। আমরা একদিকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করাদের এক-তৃতীয়াংশকে বেকার দেখতে পাচ্ছি, অন্যদিকে দেশের ভেতরেই বিদেশিদের কাজ করতে দেখছি এবং তারা দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে এমপ্লয়াররা প্রফেশনাল লোক খুঁজছেন, দেশের ভেতরে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বিদেশি প্রফেশনালরা আমাদের এখানে কাজ করছেন, আমাদের জায়গাগুলো তাদের দিয়ে দিতে হচ্ছে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়ে চলছে প্রতিদিন। ক্ষুদ্র এ দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের চাহিদা। যে পরিমাণ চাকরির বাজার দরকার, তাও দেয়া অনেকাংশে সম্ভব হচ্ছে না। অথচ একটা সময় এ দেশের উচ্চ শিক্ষিতরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতেন মানবসম্পদ উন্নয়নে, প্রশিক্ষণ বা ক্লাস নিতে।

সত্তর-আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যে, ল্যাটিন, সোভিয়েত ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি যেতেন এ দেশের মেধাবী তরুণরা। সে সময় আমাদের শিক্ষকদের কদর ও খ্যাতি দুই-ই ছিল বেশ। অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অর্জিত অর্থ সমৃদ্ধ করেছে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে। বলিষ্ঠ করেছে রেমিটেন্সকে। সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার মান ছিল নাজুক। গবেষণার অবস্থা ছিল ভয়াবহ।

আমাদের গবেষক, বিশেষজ্ঞরা তাদের ২০/২৫ বছর ধরে উচ্চ সম্মানিতে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাদের মাঝে দক্ষ ও মেধাবী একটা দল তৈরি করে। অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করেছিল। আজ মধ্যপ্রাচ্যের সেই দেশগুলোর দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। অভ্যন্তরীণ শক্তি ও মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে সব ঘাটতি কাটিয়ে উঠেছে। সৃষ্টি করেছে নিজেদের দক্ষ জনবল, গবেষক। আর্থিক সাশ্রয়ে ঘটিয়ে অবদান রেখেছে নিজেদের রেমিটেন্সে।

তিন দশক পর আর তেমন ডাক পড়ে না এ দেশের বিশেষজ্ঞদের। কেন এমন হলো? একটু গভীরে খতিয়ে দেখি বিষয়টার। ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এ দেশে। এর মধ্যে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান মেডিকেল, কৃষি, প্রকৌশলী, টেক্সটাইল, লেদার এমনকি ফ্যাশন ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এ দেশে।

এ সব প্রতিষ্ঠানের সরকারিগুলোতে শিক্ষার্থীর সঠিক সংখ্যা জানা গেলেও বেসরকারিগুলোতে পাওয়া কঠিন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ছে শুধুমাত্র একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার উদ্দেশ্যে। যে বিষয়ে পড়ছে তারা, সেই বিষয়টিতে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি, ক্লাসে মনোযোগী করতে বা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারছি না আমরা। তাই বিষয়ভিত্তিক দক্ষ ও বাস্তব উপযোগী সম্পন্ন শিক্ষার্থী পাচ্ছি না তেমন একটা। আবার যারা কিছুটা দক্ষ ও মেধার সাক্ষর রাখছেন তারা উচ্চ বেতনে চলে যাচ্ছেন বিদেশে। এর ফলে একটি বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে গত দুই দশকে।

আবার এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে অনেকে। আমাদের দেশে যোগাযোগ, অবকাঠামো বা উন্নয়নের কথা বলে অসংখ্য বিদেশি এখন নিজেদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছে এ দেশে। এ দেশে তাদের ওয়ার্ক পারমিট নিয়েও প্রশ্ন আছে আমার। ইদানীং কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সাদা চামড়ার শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়ে অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ ও নিজেদের ব্রান্ডিং করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাদের অ্যাবিলিটি, কোয়ালিটি, পারমিশন, আয় ও রেমিটেন্স খতিয়ে দেখা দরকার।

বিশ্বব্যাপী রেমিটেন্স প্রবাহের দেশভিত্তিক পরিসংখ্যান নিয়ে মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের এই বাংলাদেশ থেকে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা তাদের নিজ দেশে নিয়ে যায়।

পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৬টি দেশের নাগরিকরা এক বছরে বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছেন ২০১ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ গেছে আশপাশের ৬/৭টি দেশে। সবচেয়ে বেশি গেছে চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামে।

বাংলাদেশে বর্তমানে কমবেশি প্রায় ১০ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। আর আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে বৈধ পথের বাইরে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে রেমিটেন্স যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার হার ও পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। কারণ প্রতিদিন গড়ে বাংলাদেশে আসা আট হাজার বিদেশি নাগরিকের প্রায় অর্ধেকই দীর্ঘমেয়াদে অর্থ উপার্জনের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলের শীর্ষস্থানীয় পদগুলো চলে যাচ্ছে বিদেশিদের দখলে, তেমনি বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে সীমানার বাইরে।

পিউ রিসার্চের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ২০১ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিটেন্স বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে চীনে গেছে সর্বোচ্চ ৯ কোটি ৪৭ হাজার ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইন্দোনেশিয়ায় ২ কোটি ৭৫ হাজার ডলার, তৃতীয় সর্বোচ্চ মালয়েশিয়ায় ১ কোটি ৯৬ হাজার ডলার, চতুর্থ সর্বোচ্চ ভারতে ১ কোটি ১৪ হাজার ডলার ও পঞ্চম সর্বোচ্চ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে ৯৩ হাজার মার্কিন ডলার।

এ ছাড়া ভিয়েতনামে ৮৩ হাজার ডলার, নেপালে ৬১ হাজার, থাইল্যান্ডে ৫৭ হাজার, জাপানে ৫০ হাজার, নরওয়েতে ৪১ হাজার, যুক্তরাজ্যে ২৯ হাজার, মিয়ানমারে ২৮ হাজার, ব্রাজিলে ২০ হাজার, অ্যান্টিগুয়া এন্ড বারবুডায় ৮ হাজার, লাওসে ৬ হাজার এবং কম্বোডিয়ায় ৪ হাজার মার্কিন ডলার রেমিটেন্স বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়েছেন সেসব দেশের নাগরিক। এই পরিসংখ্যান বৈধ পথে পাঠানো অর্থের। তবে বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাস্তবে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি (তথ্য সংগ্রহ: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।

বাংলাদেশ ঠিক কতজন বিদেশি অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত আছেন এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নানা মাধ্যমে খোঁজ করেও পাইনি। এক এক জায়গায় এক এক রকম। একটির সঙ্গে আরেকটির সংখ্যার মিল পাওয়া যায় না। সরকারি-বেসরকারি দুই খাতের হিসেব দুই রকম। এ বিষয়টা আশঙ্কার। বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি দেয়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর কাছে নিবন্ধিত বিদেশিদের সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো।

অন্যদিকে গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে কাজ করা বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন ৮৫ হাজার ৪৮৬ জনের মধ্যে ভারতীয় ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন, চীনের ১৩ হাজার ২৬৮ জন, জাপানের ৪ হাজার ৯৩ জন, কোরিয়ার ৪ হাজার ৯৩ জন, মালয়েশিয়ার ৩ হাজার ৩৯৫ জন ও শ্রীলঙ্কার ৩ হাজার ৭৭ জন। বাকিরা অন্যান্য দেশের। তবে সূত্রের খবর, প্রতি বছর ৭ থেকে ১০ লাখ বিদেশি বাংলাদেশে আসেন। এর প্রায় অর্ধেক কাজ বা ব্যবসা করেন। এভাবে বিভিন্ন খাতে কর্মরত বিদেশিদের অনেকেই পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তারা কোথাও নিবন্ধিত নন।

দক্ষ বাংলাদেশি কর্মী অভাব থাকায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বাইরে দেশীয় অনেক কোম্পানি এখন বিদেশিদের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, সোয়েটার ফ্যাক্টরি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানি, মোবাইল ফোন কোম্পানি, এয়ারলাইন্স, ফার্নিচার কোম্পানি, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থাসহ বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়। এর পরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক। একটি কোম্পানিতে ৫ জন বাংলাদেশি কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন একেকজন বিদেশি কর্মকর্তা।

এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় বায়িং হাউস খুলে গার্মেন্টস ব্যবসা করছেন চীনা, ভারতীয় ও বিদেশিরা। শুধু তাই নয়, নামে-বেনামে স্থানীয় অনেক গার্মেন্ট কারখানার মালিক বিদেশি নাগরিকরা। এর বাইরে আরো নানান ধরনের আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তারা।

এ বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে আমাকে। তবে কি আমাদের মানসম্মত, সময় উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা নেই। এর জবাব কে দেবে? একদিকে দেশের ভেতরে বেকার এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যেখানে প্রকট সেখানে দেশ থেকে অর্থ চলে যেতে দেখতে হচ্ছে। তবে দেশের ভেতরে যারা গ্র্যাজুয়েট হচ্ছেন, তারাও উপযুক্ত মানসম্পন্ন নন। এখনো ৫০ বছর আগের সেকেলে সিলেবাসে পড়াশোনা হয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমরা একদিকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করাদের এক-তৃতীয়াংশকে বেকার দেখতে পাচ্ছি, অন্যদিকে দেশের ভেতরেই বিদেশিদের কাজ করতে দেখছি এবং তারা দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে এমপ্লয়াররা প্রফেশনাল লোক খুঁজছেন, দেশের ভেতরে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বিদেশি প্রফেশনালরা আমাদের এখানে কাজ করছেন, আমাদের জায়গাগুলো তাদের দিয়ে দিতে হচ্ছে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ: শিক্ষাবিদ ও গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App