×

মুক্তচিন্তা

আগুন নেভানোর পদ্ধতির কথা ভাবতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:১২ পিএম

নিমতলীতে আগুনে পুড়ে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পর বলা হয়েছিল রাসায়নিক কারখানাগুলো জনবসতি এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। নয় বছরে তা সরানো হয়নি। ঢাকা হবে কেমিক্যাল গোডাউন মুক্ত; নদী হবে দখলমুক্ত; বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত; আর সমাজ হবে মাদকমুক্ত। এগুলো কি শুধুই স্লোগান? বায়ান্ন বাজার আর তেপ্পান্ন গলির পুরান ঢাকা কি মৃত্যুপুরীই থাকবে?

ইন্টারনেটে ‘অগ্নিনির্বাপক বল’ নামে একটি বিজ্ঞাপন আসে। এতে দেখা যায়, কেমিক্যাল ভর্তি একজাতীয় বল দূর থেকে আগুনের মধ্যে ছুড়ে মারা হচ্ছে এবং তাতে আগুন নিভে যাচ্ছে। এটি কতটা কার্যকর জানি না, সংশ্লিষ্ট মহল চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

খবর বেরিয়েছে, সরু গলিতে পানির পাইপ হাতে নিয়ে ঢুকতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে। এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়েছে। ভিড়ের মাঝে মানুষের পায়ের চাপে পানি প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে। এসব থেকে মুক্তি ‘অগ্নিনির্বাপক বল’? কে জানে? তবে কিছু একটা করা দরকার তা স্পষ্ট। এভাবে মৃত্যুর কোনো মানে হয় না।

প্রধানমন্ত্রী সারারাত ঘুমাননি। আগুনে আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করবে সরকার। নিহত পরিবারকে এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। আহতদের ৫০ হাজার। এগুলো ভালো। তবে সবচেয়ে আগে দরকার এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়া। ফায়ার সার্ভিসকে আরো শক্তিশালী ও গতিশীল করা। এ জন্য বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রাখা দরকার। পৌর প্রশাসনে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে অর্থ বরাদ্দ করা উচিত। চকবাজার ও নিমতলী চোখে আঙুল দিয়ে বলছে, প্রশাসন উদাসীন, এবার আর কথা নয়, যত্নবান হতে হবে, কাজ করতে হবে। এভাবে মৃত্যু ঠেকাতে হবে। এ ঘটনায় মন্ত্রীরা অনেক কথা বলেছেন। ওবায়দুল কাদের সঠিকভাবে বলেছেন, আমরা দায়িত্ব এড়াতে পারি না।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাসায়নিক গুদাম না সরানো দুঃখজনক। প্রধানমন্ত্রীর এই দুঃখ পাওয়াটা হালকা করে দেখার সুযোগ নেই, এ জন্য দায় কার? শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, সেখানে কেমিক্যাল গোডাউনের কোনো অস্তিত্ব নেই।

আবার অন্যত্র শিল্পমন্ত্রী বলেন, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসা বংশপরম্পরা। এটা বন্ধ করা যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কেমিক্যাল কারখানা সরাতে মেয়রকে সহযোগিতা করা হবে। মেয়র বলেছেন, পুরান ঢাকায় আর কেমিক্যাল গোডাউন নয়।

মিডিয়ার কিছু সংবাদ হৃদয়বিদারক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেননি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, তাই নামেননি স্বামী, ফলে গর্ভের সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু! মৃত্যুর পরও একে অপরকে জড়িয়ে ছিলেন দুই ভাই আলী ও অপু। মাঝখানে রেখেছিলেন ৩ বছরের শিশু আরাফাতকে। বাবার লাশের জন্য দুই যমজ শিশুর অপেক্ষা। এসবই মর্মান্তিক দুঃখজনক।

মিডিয়ায় এও এসেছে, সবকিছু পুড়ে গেলেও অক্ষত মসজিদ? অন্যত্র এসেছে, মসজিদ থেকে পানি দেয়া হয়নি। এসব কি আসা উচিত? যেখানে মানুষ মরছে, সেখানে ধর্মের নামে সুড়সুড়ি কেন? বিজ্ঞান বলে, আগুনে সব কিছু পুড়ে, প্রশ্ন হলো- কত ডিগ্রিতে পুড়ে?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পুরান ঢাকার চকবাজারের ট্র্যাজেডির খবর প্রধান শিরোনাম হয়েছে। বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা, এএফপি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক পোস্ট, এনডিটিভি, আরো অসংখ্য মিডিয়া কভার করেছে। তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অগ্নিকা-ের জন্য সরকারকে দুষছেন।

তথ্যমন্ত্রী উত্তরে বলেছেন, চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। নিমতলীতে আগুনে পুড়ে শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পর বলা হয়েছিল রাসায়নিক কারখানাগুলো জনবসতি এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। নয় বছরে তা সরানো হয়নি। ঢাকা হবে কেমিক্যাল গোডাউন মুক্ত; নদী হবে দখলমুক্ত; বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত; আর সমাজ হবে মাদকমুক্ত। এগুলো কি শুধুই স্লোগান? বায়ান্ন বাজার আর তেপ্পান্ন গলির পুরান ঢাকা কি মৃত্যুপুরীই থাকবে?

শুরু করেছিলাম আগুন নেভানোর কথা বলে, শেষ করব একজন সচেতন মানুষের ‘একটু আশার আলোর’ গল্প শুনিয়ে। তিনি আমাদের পরিচিত সুকোমল মোদক, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী। দেশের বাড়ির চারকোনায় ৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসিয়েছেন। সবই কার্যক্ষম। কীভাবে? তার মুখেই শোনা যাক।

তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন, স্যানিটেশন (sanitation), বৃষ্টির জল সংরক্ষণ (rainwater harvesting), ভূগর্ভস্থ জল পুনর্ভরণ (groundwater recharge), বাগানে ইরিগেশন (garden irrigation), আর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য সংরক্ষিত জলের (fire water reserve) সমন্বিত সিস্টেমের (integrated system) অংশ হিসেবে এটা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, চকবাজারে সবার আন্তরিকতা সত্ত্বেও অগ্নিকা-ে মানুষের মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যায়নি। তার মতে, ফায়ার হাইড্রেন্টের বিকল্প নেই? তার পরামর্শ ঢাকা শহরেও এভাবে ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো যেতে পারে?

তিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন : ‘আমি দেশের জন্য এটি একটি পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে কাজ করছি। এটি মডেল হতে পারে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি গ্রাম একটি শহর হিসেবে গড়তে চান, এই জলব্যবস্থা (water management) এতে খুবই কাজে আসবে। এটি পরিবারের জন্য বা কমিউনিটির জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে। আমি দেশকে এই ডিজাইন উপহার হিসেবে দেব, এটি হচ্ছে, আমাদের ভাই-বোনের দেশের ঋণ শোধ করার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। বিস্তারিত শিগগিরই রিসার্চ জার্নাল (research paper) ও পত্রিকায় আসছে।’

সবাই এগিয়ে এলে আসলে কোনো সমস্যাই পড়ে থাকে না। দেরিতে হলেও এজন্য জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে বিমান ছিনতাই নাটকীয়তায় চকবাজার অগ্নিকাণ্ড চাপা পড়ে যাবে না তো? ছিনতাইকারী কথা বলতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে? তিনি প্রথমে আহত, পরে নিহত হয়েছেন, তাই আর কোনোদিন জানা যাবে না তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন? বিমান ছিনতাই প্রমাণ করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ছিদ্র আছে? এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ‘উল্টাপাল্টা’ খবর বলে দিচ্ছে যে এ ধরনের ঘটনায় ত্বরিত ‘সমন্বিত প্রচার সেল’ থাকাটা জরুরি। বিমান ছিনতাই ঘটনার দ্রুত অবসানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।

নিউইয়র্ক থেকে শিতাংশু গুহ: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App