×

জাতীয়

আতঙ্ক কাটেনি চুড়িহাট্টায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৫৬ এএম

আতঙ্ক কাটেনি চুড়িহাট্টায়
আতঙ্ক কাটেনি চুড়িহাট্টায়
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তিন দিন অতিবাহিত হলেও এখনো আতঙ্ক কাটেনি এলাকাবাসীর। এখনো অনেকটাই ভুতুড়ে পরিবেশ চুড়িহাট্টায়। আগুনের বিভীষিকা যেন পিছু ছাড়ছে না স্থানীয়দের। অগ্নিকাণ্ডের সময় স্থানীয় যারা বাসাবাড়ি ছেড়ে সরে গিয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ এলাকায় ফিরলেও আতঙ্ক বিরাজ করছে অনেকের মধ্যে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের কারণ নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা না কাটলেও আগুনের উৎস ও ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, পিকআপের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণেই ভয়াবহ এই আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রতিটি গাড়ি, বাড়ি ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় থাকা গ্যাস সিলিন্ডার যেন এক একটি বোমা। অন্যদিকে চুড়িহাট্টার সাধারণ লোকজন বলছেন, প্লাস্টিক ও বিভিন্ন রকম দাহ্য-অদাহ্য রাসায়নিক পদার্থ মজুদের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে এবং এত বেশি বিস্তৃত হয়েছে। বেশি টাকার লোভে বাড়িওয়ালারা গোপনে-অগোপনে কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া দিচ্ছেন, যা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকে তারা দ্রুত সব ধরনের রাসায়নিক পদার্থের অপসারণ চান। এলাকাবাসীর দাবি, পুরান ঢাকার চকবাজার, ইসলামপুর, ইমানগঞ্জ, নলগোনা, পোস্তাসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০ সহস্রাধিক নানা ধরনের কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। সরকারের উচিত আবাসিক এলাকা থেকে এসব বিপজ্জনক রাসায়নিক গোডাউন সরিয়ে নেয়া। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক সামসুল আলম জানান, পরিদপ্তরের ২৯ ধরনের কেমিক্যাল অনুমোদন দেয়ার এখতিয়ার আছে। কিন্তু পুরান ঢাকায় ৮শ ধরনের কেমিক্যাল থাকলেও এগুলোর কোনোটিরই অনুমোদন নেই। সিটি করপোরেশনের তালিকা অনুয়ায়ী পুরান ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রায় দুই হাজার কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সামসুল আলম বলেন, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্টে আমাদের তদন্তে পিগমেন্ট, ডাইসসহ বেশ কিছু ধরনের কেমিক্যাল পাওয়া গেছে, তবে দুয়েকটি ছাড়া এগুলোকে অবিপজ্জনক কেমিক্যাল বলা যেতে পারে। সবই রংয়ের কেমিক্যাল। তিনি বলেন, গ্যাস লাইটারের রিফিল, বডি স্প্রে, প্লাস্টিক আগুনকে উসকে দিয়েছে এবং দ্রুত ছড়িয়েছে। কী কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে সেটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা বলতে পারব। পুরান ঢাকায় আগুন লাগার পর এর ভয়াবহতা তৈরিতে যা যা দরকার তার সবই এখানে আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে ওয়াহেদ ম্যানশনের বেজমেন্ট থেকে কেমিক্যাল অপসারণের মধ্য দিয়ে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকার কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলো বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। গতকাল শনিবার দুপুরে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তিনি। তার এই ঘোষণার পরপরই এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন এলাকার ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, পুরান ঢাকার শত শত বছরের ব্যবসায়িক পরিবেশ হঠাৎ করেই ঘোষণা দিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। আগে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন, পরে কেমিক্যাল ব্যবসা অপসারণ করতে হবে। গতকাল দুপুরে ব্রিফকালে মেয়র বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর দুদিন পরই এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল। ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের মধ্য দিয়ে আজ থেকে পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গুদাম উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হলো। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরান ঢাকার সব কেমিক্যাল গুদাম অপসারণ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এ জন্য যত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয় নিব। তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত যেসব বাড়ির মালিকরা কেমিক্যাল গুদাম অপসারণের উদ্যোগ নেননি সেসব বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সবার সহযোগিতা চেয়ে মেয়র বলেন, পুরান ঢাকায় একেক এলাকায় লাখ লাখ বাড়িঘর রয়েছে। আশা করব স্থানীয়রা আমাদের সহায়তা করবেন। পার্শ্ববর্তী কোনো বাড়িতে কেমিক্যাল গুদাম দেখতে পেলে আমাদের জানাবেন, পুলিশকে জানাবেন। কারো বাড়িতে কেমিক্যাল গুদাম থাকলে দ্রুত সরিয়ে নিন। নয়তো বাড়ির মালিককেও আইনের আওতায় আনা হবে। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হয়েছে জানিয়ে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ঘটনার সূত্রপাতের সময়ের ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র আমাকে জানিয়েছে, একটি গাড়ির সিলিন্ডার থেকে এ আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর পাশের একটি গ্যাস সিলিন্ডারভর্তি পিকআপের আগুন ছড়িয়ে পড়লে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই আশপাশের কয়েকটি ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে সকালে চকবাজারের অগ্নি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রথমে চকবাজার, এরপর পর্যায়ক্রমে পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়া হবে। স্থানীয়রা যা বললেন : চাল ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন বলেন, প্লাস্টিক, রাসায়নিকের মজুদের কারণে আগুন এত বেশি বিস্তৃত হয়। আমরা কতবার বলছি, আবাসিক এলাকা থেকে এসব বিপজ্জনক জিনিস সরান। এলাকার বাড়িওয়ালারাও বেশি টাকার লোভে গোডাউন ভাড়া দেয়, আর তাতে এসব মালামাল মজুদ করা হয়। দোষ তাদেরও কম না। ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো দিকের ভবনের মালিকানা চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের। সেই ভবনের পেছনে ছোট ঘরে হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডারগুলো মজুদ করা হতো বলে এলাকাবাসী জানায়। ওয়াহেদ ম্যানশনের উল্টো দিকে আনাস হোটেলের পেছনের ভবনের মালিক দুই ভাই সোহেল ও ইসমাইল। এ ভবনের নিচতলায়ও রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে বলে জানান পাশের বাড়ির বাসিন্দা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আলিম উদ্দিন। চুড়িহাট্টা ১৫/১ নম্বর বাড়ির মালিকদের একজন মো. সোহেল বলেন, তাদের সামনের লাভলু সাহেবের বাড়ির পুরোটাই বিভিন্ন রাসায়নিকের গুদাম হিসেবে ভাড়া দেয়া আছে। রাসায়নিকের কারণেই জানমালের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মন্তব্য করেন তিনি। অন্যদিকে চুড়িহাট্টার বাসিন্দা ইব্রাহিমের মতে, পিকআপ ভ্যানের সিলিন্ডার বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত এবং বিস্তৃতি। মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে। আর অতিরিক্ত যানজটের কারণে অন্যান্য গাড়ির সিলিন্ডারগুলো একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে, যার কারণে এতগুলো মানুষের জীবন চলে গেছে। বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের অভিযোগ, পুরান ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় নিয়মিত যানজট লেগে থাকে। চুড়িহাট্টার আগুনের ভয়াবহতার জন্য এ যানজটও দায়ী। চুড়িহাট্টা মোড় এখন যেমন : চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৫টি ভবনসহ আশপাশের অন্তত ১০টি ভবন ছাড়া অন্যান্য ভবনে গত শুক্রবার দুপুরই বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া চুড়িহাট্টা মোড়ের আগুনে পোড়া যানবাহনের অংশ, পারফিউম, প্রসাধনী ও অন্যান্য ছাইয়ের অংশ পরিষ্কার করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এতে ১০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট এখনো সেখানে অবস্থান করছে। উৎসুক মানুষের ভিড় ঠেকাতে আছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, বাংলাদেশ প্লাস্টিক সমিতি, চকবাজার থানা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কালো ব্যানার টানিয়ে শোক জানিয়েছে। নিহতদের স্বজন, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের মালিকরা হাহাকার করছেন। সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় কীভাবে জীবন চালাবেন তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিসহ কেউ কেউ এ ব্যাপারে সরকারের সাহায্য কামনা করেছেন। ভয়াবহ ওই আগুনে চুড়িহাট্টায় ২৭ থেকে ৩০টি দোকান ক্ষতি হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App