×

জাতীয়

আগুন ছড়ানোর নেপথ্যে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৩৫ এএম

আগুন ছড়ানোর নেপথ্যে

ফাইল ছবি

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের একদিন পর গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তদন্তে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের মজুদের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে বলে জানতে পেরেছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দল। অগ্নিকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহিদ ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের ক্যানেস্তারা ও পারফিউমের বোতল মজুদ ছিল। যেগুলো ব্ল্যাস্ট হয়ে বোমার মতো কাজ করেছে। অগ্নিকাণ্ডের পর ওয়াহিদ ভবনের নিচতলাতেই একসঙ্গে ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এই ভবনের বেজমেন্টের গোডাউনে ছোট-বড় ড্রামে ১১ ধরনের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্যের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সচিব (সহকারী পরিচালক) সালেহ উদ্দিন বলেছেন, এসব দাহ্য পদার্থে আগুন ছড়িয়ে পড়লে পরিণতি আরো ভয়াবহ হতো। এদিকে সিটি করপোরেশনের তদন্ত দল জানিয়েছে, অনুমতি না থাকলেও ভবনগুলোতে রাসায়নিক ও বিভিন্ন দাহ্য সামগ্রীর গুদাম গড়ে তোলা হয়েছিল। ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি, আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাও সেখানে ছিল না। সকালে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত দলের সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ওয়াহিদ ম্যানসনের দোতলার পুরোটাতেই গোডাউন ছিল। প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর এই ভবন নির্মিত হলেও সিঁড়ির পরিমাণ যথেষ্ট ছিল না। আগুন নিয়ন্ত্রণের কোনো ইকুইপমেন্ট ছিল না, ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়তো সিলিন্ডার বিস্ফোরণে, কিন্তু কেমিক্যালের কারণেই আগুনটা দ্রুত ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, ওয়াহিদ মঞ্জিলের গ্রাউন্ড ফ্লোর ও দোতলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিম ও কলামগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক সপ্তাহ পর জানা যাবে, ভবনটি আদৌ ব্যবহারের উপযোগী কিনা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো রাজউকের অনুমোদিত কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারেননি রাজউকের অথরাইজড অফিসার মো. নুরুজ্জামান জহির। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর চুড়িহাট্টা মোড়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এরপর সেই আগুন প্রথমে রাস্তায় থাকা যানবাহন এবং পরে ঘটনাস্থলের ৫টি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। আগুনে পুড়ে কয়লা হয় ৬৭টি প্রাণ। আহত হন আরো ৪১ জন, যারা এখন হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। মর্মান্তিক এ হতাহতের ঘটনার পর শোকে স্তব্ধ পুরো এলাকাবাসী। ভবিষ্যতে যেন আর কোনো লাশের মিছিল দেখতে না হয়, সে জন্য পুরান ঢাকা থেকে অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের দ্রুত অপসারণ চান বিক্ষুব্ধ লোকজন। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ট্রান্সফরমার, গ্যাস সিলিন্ডার অথবা কেমিক্যালের বিস্ফোরণের কারণে আগুন লাগতে পারে। গত বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছিলেন, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড সিলিন্ডারের বিস্ফোরণেই হয়েছে। এর সঙ্গে রাসায়নিক গুদামের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে গতকাল সকালে তদন্ত শুরু করার পর মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দলের সদসর‌্যা। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের ক্যানেস্তারা ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া আরো অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটি জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো ব্ল্যাস্ট হয়ে বোমার মতো কাজ করেছে। ‘শিল্প মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের বিষয়ে’ দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জুলফিকার বলেন, অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। যা যা ছিল, সেগুলো সবই রাসায়নিক। কেমিক্যালের কারণেই আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে বেশি। ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন্স) দিলিপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে গঠিত ৩ সদস্যের এই তদন্ত কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে গতকাল সকাল থেকে চুড়িহাট্টা মোড়ের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো পরিদর্শন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১১ সদস্যের কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৫ সদস্যের কমিটি। পরিদর্শন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত আগুনে পুড়ে যাওয়া ও আংশিক পোড়া পাঁচটি ৫টি ভবনের মধ্যে ৪টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এসব ভবনে লাল-কালো কালিতে লেখা সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। লাল ফিতা দিয়ে কর্ডন করা হয়েছে ভবনগুলো। সাইনবোর্ডগুলো টাঙান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। সাইনবোর্ডে লেখা, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। ভবনটি ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো’। যেসব ভবনে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে সেগুলো হলো- চুড়িহাট্টার নন্দ কুমার দত্তের ১৮, ৬৩/২,৬৩/৩, ৬৪ ও ৬৫নং ভবন। ডিএসসিসির কমিটির আহবায়ক ও সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো পরিদর্শন করেছি। আগুনে ৫টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি ভবন প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী। বাকি ভবনগুলো ব্যবহারের উপযোগী কিনা জানা যাবে এক সপ্তাহ পর। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনের অনুমতি নেই। যে কোনো মূল্যে সবাই মিলে এসব এলাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়া হবে। এতদিন সরানো হয়নি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবার যে কোনো মূল্যে সেসব সরিয়ে নেয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচতলায় ডজনখানেক দোকান। আর দোতলায় পারফিউম ও প্লাস্টিক সামগ্রীর গোডাউন ছিল। আশপাশের বিভিন্ন ভবনেও রাসায়নিক ও দাহ্য সামগ্রীর গুদাম বা দোকান ছিল। ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচতলাতেই একসঙ্গে ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়, যার মধ্যে দুই বছরের শিশু ও নারীও ছিল। সিঁড়ি ঘরের ফ্লোরে দলা পাকানো অবস্থায় ছিল পোড়া লাশগুলো। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অনেক লাশ। এ ছাড়া দুটি রেস্তোরাঁ থেকে উদ্ধার করা হয় একাধিক মরদেহ। গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, প্রাণোচ্ছল চুড়িহাট্টা যেন মৃত্যুপুরী। উৎসুক জনতার কলকাকলি ভিড়েও সর্বত্রই এক ধরনের হাহাকার বিরাজ করছে। হতাহতদের স্বজন, প্রতিবেশী সবার চোখেমুখে ক্ষোভ আর হতাশা। এ ঘটনার জন্য অবৈধ কেমিক্যাল কারবারিদের দায়ী করছেন সবাই। গতকাল সকাল থেকে চুড়িহাট্টা মোড় থেকে পুড়ে যাওয়া গাড়িসহ অন্যান্য ধ্বংসস্ত‚প সরাতে কাজ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সড়কের থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলেছে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর ভেতর আগের মতোই আছে। এলাকায় বিদ্যুৎ, গ্যাস না থাকায় এলাকাবাসীর অনেকেই আত্মীয়-স্বজনের বাসায় চলে গেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর সাংবাদিকদের সামনে আসে। কমিটির আহবায়ক ও মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, তদন্ত কমিটির সবাই মতবিনিময় করেছি এবং এখানে সবকিছু দেখেছি। এখন আমরা তদন্ত কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, আমাদের প্রাথমিক কাজ হবে অগ্নিকাণ্ডের উৎস ও কারণ খুঁজে বের করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া। তদন্ত কমিটির সদস্য পুলিশের লালবাগ জোনের উপকমিশনার ইব্রাহিম খান সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আমরা বাদী হয়ে একটা মামলা করেছি। যেহেতু একটি মর্মান্তিক ঘটনা, আমরা তদন্ত করব। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতে সুপারিশ করব। এদিকে আগুন লাগার কারণ হিসেবে অনেকেই ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের কথা বললেও সেখানে কোনো ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আগুনের কারণেই ৩টি বিদ্যুতের খুঁটি ও বৈদ্যুতিক তার পুড়ে গেছে। আগুনে বিদ্যুতের চারটি স্পেন (এক খুঁটি থেকে অন্য খুঁটি পর্যন্ত এক স্পেন), এলটি তার (.৪১৫ কেভি লো ভোল্টেজ তার) এবং ৫ স্পেন এরিয়াল বান্ডেল ক্যাবল নষ্ট হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ডিপিডিসির ২ সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- লালবাগ জোনের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী সারোয়ার কায়নাত ও প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম মুকুল। তারা আজ শনিবারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। গতকাল সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগুন লাগা ওয়াহিদ ম্যানসনের আশপাশে কোনো ট্রান্সফরমার ছিল না। পাশের হায়দারবক্স লেনে একটি এবং কাটারা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে আরেকটি ট্রান্সফরমার ছিল, যা অক্ষত অবস্থায় আছে। এদিকে পুরান ঢাকা থেকে অবৈধ ক্যামিক্যাল গোডাউন অপসারণের দাবিতে এলাকায় মানববন্ধন করেছে চকবাজার থানা ছাত্রলীগ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App