×

অর্থনীতি

ডলারের বাজার অস্থির

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:৩২ পিএম

ডলারের বাজার অস্থির
চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় দেশের বাজারে মার্কিন ডলারের সংকট তীব্র হয়েছে। ফলে টাকার বিপরীতে বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৮৪ টাকা ১২ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ১ টাকা ২২ পয়সা বেশি। তবে সাধারণ মানুষ বা যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬ টাকার দরে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য না থাকা, অর্থ পাচারসহ নানা কারণে ডলারের বাজারে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স পাঠানোর বিষয়ে কিছুটা উৎসাহিত হলেও বেড়ে যাচ্ছে পণ্য আমদানির ব্যয়। কারণ আমদানির জন্য বেশি মূল্যে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্য, ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামালসহ সব আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়ছে। সর্বোপরি মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার এ সংকট মেটাতে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৫৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) বিক্রি করেছিল ২৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরে তিন দফা ডলারের দাম বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বছরের প্রথমদিন আন্তঃব্যাংক রেটে ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। দুদিন পর ৩ জানুয়ারি ডলারের দাম ৫ পয়সা এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ১০ পয়সা দাম বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ ১৪ ফেব্রæয়ারি ৭ পয়সা বেড়ে ডলারের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ৮৪ টাকা ১২ পয়সায়। বাজারের বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। বেশকিছু ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হারের চেয়ে বাড়তি মূল্য আদায় করছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর সাধারণ মানুষ, যারা ভ্রমণ বা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬ টাকার ওপরে। ডলারের দাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতমÑ রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হচ্ছে, সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি, এ ছাড়া হজ ও বিদেশ ভ্রমণসহ নানা কারণে খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের লেনদেন বেড়েছে। অর অন্যদিকে দীর্ঘদিন বৈধপথে রেমিটেন্স প্রবাহ নেতিবাচক ধারায় ছিল। সব মিলিয়ে ডলারের দাম বাড়ছে। ডলারের এ দাম বাড়ার ফলে রপ্তানিকারকরা কিছুটা সুবিধা পেলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমদানিতে। যার ফলে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে করে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সর্বশেষ যার প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বাজারের চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে- এটা সাময়িক সমাধান হবে। তবে ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য রপ্তানির খাত ও আয় বাড়াতে হবে, শুধু পোশাক শিল্পের ওপর ভর করলে চলবে না। এ ছাড়া অর্থপাচার রোধ ও রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর। এদিকে, বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই ডলারে সংকট রয়েছে। এর প্রধান কারণ, যে পরিমাণ আমদানি এলসি খোলা হয়েছে সে পরিমাণ ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে, সেটি চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। আবার এখন হজের নিবন্ধনের জন্য বাড়তি ডলার লাগছে। সব মিলিয়ে চাহিদা বেশি থাকায় ডলারের দাম বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ডলার সবরাহ করে, আর সম্প্রতি রপ্তানি রেড়েছেÑ এ অর্থ হাতে এলে ডলারের দর স্বাভাবিক হবে বলে জানান তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে। প্রথম ছয় মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭০৮ কোটি ডলার। এ সময় রপ্তানি আয় হয়েছে ২ হাজার ১৬ কোটি ডলার। এ হিসাবে আলোচিত সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৬৬ কোটি ডলার। এ সময়ে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ১৫৬ কোটি ডলার। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার রিজার্ভ অতিক্রম করেছিল। রাজধানীর মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। আর খরচ বাড়লে সর্বশেষ পণ্যের দাম বাড়ে এটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক মাস ধরেই এলসি খোলার জন্য ৮৫ টাকার মতো ডলারের দর পড়ছে। একেক ব্যাংকের একেক রেট নেয়। অনেক ব্যাংক ৮৫ টাকার ওপরেও নিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংকের ডলারের দর ৮৪ টাকা ১২ পয়সা রয়েছে। ডলারের দর বাড়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর। এ ছাড়া বর্তমান সরকার পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রো রেলসহ বেশ কিছু মেগা প্রজেক্টের কাজ করছে। এখানে প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ আমদানি করতে হচ্ছে। তাই ডলারের চাহিদা অনুযায়ী সরবারহের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারে ডলারের সরবারহ ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করছে। এ সমস্যা সাময়িক উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলো ডলার নিয়ে বেশি সমস্যায় ছিল। তবে তারা উত্তরণ করেছে। দেশে মেগা প্রজেক্টের কাজ শেষ হলে এবং নতুন নতুন কারখানা উৎপাদনে গেলে তখন আর এ সমস্যা থাকবে না বলে জানান তিনি। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের চেয়ে আমদানি ঋণপত্রের ক্ষেত্রে বেশি অর্থ আদায় করছে ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ ঠিক নয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মুখপাত্র বলেন, কেউ যেন ডলারের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেশি না নিতে পারে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষেণ করছে। গত বছরও বেশিকিছু ব্যাংককে এ নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও যদি এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের চলতি হিসাব ঋণাত্মক রয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় তা কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০৮ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫০৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App