×

মুক্তচিন্তা

সামাজিক অঙ্গীকার রক্ষাই সরকারকে শক্তিশালী করবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৪২ পিএম

আমরা তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কর্তব্য বা দায়িত্বে অবহেলাকেও দুর্নীতি বলে চিহ্নিত করতে পারি। অন্তত দুর্নীতি দমন কমিশন তা পারে বলেই আমাদের বিশ্বাস। ওপরে বর্ণিত সামাজিক সমস্যাবলি সংশ্লিষ্ট সব মহল যদি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী হয় তবে সমাজে এক ধরনের দৃশ্যমান স্বস্তি যেমন বিরাজ করবে তেমনি অন্তর্গতভাবে সরকারও শক্তিশালী হয়ে ওঠার অবকাশ পাবে। সামাজিক নিরাপত্তার সব বিষয়ে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারসমূহ রক্ষার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার শক্তিশালী হোক।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের মাস মাত্র পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে সরকার বেশকিছু বিষয়ে কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে। এসবের মধ্যে সামাজিক সমস্যাই বেশি পরিমাণে চিহ্নিত। উল্লেখ্য, এর সবই প্রায় বিষয়েই একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারেও দলটি প্রতিশ্রুত ছিল।

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং ভয়ঙ্কর এক সামাজিক সমস্যার নাম মাদক। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কিছু দৃশ্যমান নমুনা আমরা সাম্প্রতিককালে দেখতে পাচ্ছি। আবার দুর্র্নীতির বিরুদ্ধেও সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা আছে। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান এখনো বড় তেমন কিছু দেখতে পাইনি।

যদিও দুর্নীতির পরিধি ও ব্যাখ্যা বহুমাত্রিক। একেক খাতে একেক রকমের দুর্নীতির খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখতে পাই। কোথাও দুর্নীতি ‘অর্থের’ কোথাও দুর্নীতি ‘কর্মের’। অর্থাৎ অর্থ ও কর্ম অর্থাৎ দায়িত্ব নিয়েই দুর্নীতি চক্রাকারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু শুধু ব্যাংক বা বিভিন্ন আর্থিক খাতের দুর্নীতির বিষয়টিই আমাদের চোখে বেশি পড়ে।

আবার হাসপাতালের ডাক্তারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে ইদানীং গণমাধ্যম কিছুটা সরব হয়েছে বলে সম্প্রতি দুদক কর্তৃপক্ষ বলছে কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকাও এক ধরনের দুর্নীতি। সবার ওপর আর্থিক খাতের দুর্নীতিই আমাদের মাঝেমধ্যেই চমকে দিচ্ছে। এই খাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মাদক ব্যবসায়ে সম্পৃক্তদের মতোই কিংবা তারও চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর।

গত শুক্রবারও কোনো কোনো পত্রিকা খবরের শিরোনাম করেছে অর্থ পাচারের বিষয়। দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এরকম একটি খবরের শিরোনাম ‘বছরে পাচার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা’।

সমকাল আরো বলছে এর সঙ্গে রাঘব-বোয়ালরাই জড়িত। ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুস্থিরতা ও স্বস্তি বিরাজ না করলে সামগ্রিকভাবে সব ক্ষেত্রেই এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে। বছরে উল্লিখিত ‘সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের’ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাস্কফোর্স সক্রিয় থাকলে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো বলে অর্থশাস্ত্রবিদরা মনে করেন।

সুতরাং এখানেও কম করে হলেও দুই ধরনের দুর্নীতি আমাদের সাদা চোখে ধরা পড়ে। একটি হলো পাচারকারীদের দুর্নীতি এবং স্বাভাবিকভাবেই অন্যটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের টাস্কফোর্সের নিষ্ক্রিয়তা। অন্যদিকে সিআইডি দপ্তরের কর্তারা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারির ঘোষণা করলেও সে ব্যবস্থা কোন কোন পক্ষের জন্য প্রযোজ্য হবে তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

আবার এও বুঝতে পারি যে, যেহেতু তদন্তসাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে সে ক্ষেত্রে ‘তদন্ত’ কতটা ন্যায়ভিত্তিক হবে তাও বিরাট এক প্রশ্ন। ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধানের পক্ষ থেকে জাতিকে জানানো হয়েছে যে, নজরদারি অব্যাহত আছে। কীভাবে নজরদারি অব্যাহত আছে তাও এক বিরাট প্রশ্ন।

চুরি যাওয়ার পরে নজরদারি নাকি আগে থেকেই নজরদারি বলবৎ ছিল? চুরি যাওয়ার পর বাড়িঘর পুলিশি পাহারার আওতায় আনার কি মানে থাকতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের বিবেচনায় দুদককে এখন এরূপ এক ঘোষণা দেয়ার সময় এসেছে যে, তারা বলবে দক্ষতার অভাব নিয়ে কেউ কোনো পদে আসীন হলে সেটাও হবে দুর্নীতি।

কারণ অদক্ষ লোকটির অযোগ্যতার কারণে রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই। আমাদের এ পর্যন্ত যত আর্থিক ক্ষতিসাধিত হয়েছে তার পেছনে অদক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অযোগ্যতা যেমন ছিল তেমনি ব্যক্তিস্বার্থে ছিল কারো কারো যোগসাজশ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাচারকারীদের সঙ্গে বুঝেশুনে হাত মেলানোয় এসব অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগ্যতার অভাব হয়নি মোটেই।

তদন্ত কমিটি যেন সেদিকেও আমাদের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করাতে পারেন আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সেরকমই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স সরকারের এই ঘোষণায় দেশের সাধারণ মানুষ যেমন আশ্বস্ত হয়েছিল সে ঘোষণা কার্যকরের মাধ্যমে সরকার জনগণের পূর্ণ আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। এটি সম্ভব হলে সরকারেরও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে।

সম্প্রতি সরকার আরেকটি বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তা হলো অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর উদ্ধারে জিরো টলারেন্স। এই ঘোষণা অনুযায়ী বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে চলছে উচ্ছেদ অভিযান। এই অভিযানে অবৈধভাবে বসতি কিংবা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কারণে কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।

কিন্তু এই সম্পদ বিনষ্টির পরও মানুষকে হাহাকার করতে কিংবা প্রতিবাদী আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। মানুষ আসলে যখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, জাতীয় প্রয়োজন সর্বাগ্রে তখন নিজের ছোট স্বার্থ নিয়ে খুব বেশি বিচলিত হয় না। সাধারণের সুবিধা ও রাষ্ট্রের চাহিদাকে সবাই সম্মান করেন।

কিন্তু এ জন্য এক ধরনের মোটিভেশন দরকার। আবার শুধু মোটিভেশনই নয়- আইনের শাসনও অত্যন্ত জরুরি। আইনকে যদি আমরা কোথাও শক্তভাবে দাঁড়াতে দেখি সেখানে বেআইনি কাজকর্ম পরিচালনা করা শক্তিধর লোকের পক্ষেও সম্ভব হয় না। বাংলায় চিরায়ত একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- ‘মানুষ শক্তের ভক্ত নরমের যম!’ সুতরাং প্রশাসন বা প্রতিষ্ঠানকে কখনো কখনো সেই শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হয়।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও যে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি আছে তাও অবৈধ দখলদার কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ ব্যক্তিদের বুঝিয়ে দিতে হয়। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যায়। সব মিলিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার অনেকটা জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদের দায়িত্ব পালনকালে তার অবস্থান স্পষ্ট করবে। মানুষ ব্যক্তিগত কষ্ট স্বীকার করে হলেও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যে কোনো রকমের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে বলেই আমাদের ধারণা।

রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় সব শহরের ফুটপাতগুলো বেশুমার বেদখলে চলে গেছে। শোনা যায় ফুটপাতে বসা দোকানিরা নানাজনকে চাঁদা প্রদানের মাধ্যমে এই সুবিধাটুকু নিয়ে থাকে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ কখনো এরূপ সুবিধা প্রদান করে না বলেই আমরা জানি।

তাহলে প্রশ্ন জাগে কর্তৃপক্ষের আড়ালে তাহলে এমন কোন ছায়া কর্তৃপক্ষ আছে যারা এসব অর্থ গ্রহণ ও ফুটপাতে দোকান বসানোর অনুমতি দিয়ে থাকে? সম্প্রতি আমরা আরেক ধরনের উপদ্রব দেখছি দখলমুক্ত যে ফুটপাতটুকু অবশিষ্ট আছে তার ওপর। ফুটপাতজুড়ে মোটরসাইকেলের যাতায়াত- যা পথচারীকে বিরক্ত, ভীত ও বিভ্রান্ত করছে।

সব প্রকার শক্তির কাছ থেকে ফুটপাত রক্ষা এখন সময়ের দাবি। ফুটপাতে এ দেশের সাধারণ মানুষকে স্বচ্ছন্দে হাঁটার সুযোগ করে দিতে হবে। এটি সম্ভব না হলে আইনের যে শাসন প্রতিষ্ঠার কথা আমরা বলি তার কোনো ভিত্তি থাকবে না।

শুধু বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরই নয় কিংবা রাজধানী শহরের ফুটপাতসমূহই নয় আমরা যদি সমগ্র দেশের সড়ক ও মহাসড়কগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব সেখানেও প্রায় একই চিত্র। অর্থাৎ সড়ক মহাসড়কের দুপাশের জায়গাজমিও কিছুসংখ্যক তথাকথিত প্রভাবশালী বা শক্তিধর মানুষের অবৈধ দখলে চলে গেছে।

কোথাও অবৈধ স্থাপনা আবার কোথাও সড়ক মহাসড়কের ওপর বাস ও ট্রাক পার্কিংয়ের ফলে তার অর্ধেকই চলাচলের অন্তরায় হয়ে পড়ে- ফলে যখন তখন যত্রতত্র যানজট লেগেই থাকে। দেশবাসীর সঙ্গে যানজটের এখন খুব নিবিড় সম্পর্ক। একে পাশ কাটিয়ে আজ আর সাধারণের জীবনযাপন সম্ভব নয়।

তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে সড়ক ও মহাসড়কের দুপাশের অবৈধ স্থাপনা ও জঞ্জাল অপসারণের ঘোষণা শুনেছিলাম। শুনেছিলাম দ্রুত সড়ক মহাসড়ক থেকে অবৈধভাবে রাখা সব প্রকার স্থাপনাসহ অন্যান্য অস্থায়ী দোকানপাট সরিয়ে ফেলতে।

কিন্তু আমাদের দেশে অনুরোধ-উপরোধে তেমন কাজ হয় না, আশা করি সে বিষয়টি উপলব্ধি করে সড়ক ও সেতু বিভাগ দ্রুত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্যে নিজেদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করবে। দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এই যে, সড়ক ও সেতু বিভাগ সমগ্র দেশের সড়ক-মহাসড়কের দুপাশে নানাভাবে বেদখল হয়ে যাওয়া সম্পত্তির পুনরুদ্ধার করবে।

অন্তত নিজস্ব জায়গাটুকু সড়ক বিভাগ তার নিজের দখলে রাখায় সক্ষমতা দেখাবে। এই সক্ষমতা দেখাতে না পারলে দেশবাসীর কাছে সড়ক সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কর্মীদের অবহেলা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমরা তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কর্তব্য বা দায়িত্বে অবহেলাকেও দুর্নীতি বলে চিহ্নিত করতে পারি। অন্তত দুর্নীতি দমন কমিশন তা পারে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

ওপরে বর্ণিত সামাজিক সমস্যাবলি সংশ্লিষ্ট সব মহল যদি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সমাধানে আগ্রহী হয় তবে সমাজে এক ধরনের দৃশ্যমান স্বস্তি যেমন বিরাজ করবে তেমনি অন্তর্গতভাবে সরকারও শক্তিশালী হয়ে ওঠার অবকাশ পাবে। সামাজিক নিরাপত্তার সব বিষয়ে প্রতিশ্রুত অঙ্গীকারসমূহ রক্ষার মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার শক্তিশালী হোক।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App