×

মুক্তচিন্তা

প্রতিভা মুৎসুদ্দি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:১৫ পিএম

প্রতিভা মুৎসুদ্দি

প্রতিভা মুৎসুদ্দি

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষাসংগ্রামী প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৩৫ সালের ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মহামনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৫৯ সালে এমএ পাস করেন।

১৯৬১ সালে ময়মনসিংহ মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করে বছরখানেক সেখানে শিক্ষকতা করেন।

১৯৬৩ সালে ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং এরপর ভাইস প্রিন্সিপাল পদে উন্নীত হন। ১৯৬৫ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি কুমুদিনী ট্রাস্টের পরিচালক হিসেবেও দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে কুমুদিনী কমপ্লেক্সের প্রশাসক ও পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

মানবতার সেবায় নিবেদিত এই কল্যাণময়ী নারী ভাষাসংগ্রামী সমাজের এক মহান আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রদত্ত বক্তব্যের প্রতিবাদে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি চট্টগ্রামের রাউজানে অবস্থিত মহামনি এডাপালি ইনস্টিটিউটের ছাত্রী।

জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে এ স্কুলে যে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয় সেখানেই তিনি প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষার সপক্ষে অনুষ্ঠিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় প্রতিভা মুৎসুদ্দি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী। এ সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

একুশের হত্যাকাণ্ডের খবর চট্টগ্রামে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে মহিলারাও এর প্রতিবাদ সোচ্চার হয়ে ওঠে। ২৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রামে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে দশ সহস্রাধিক ছাত্রছাত্রীর এক সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিন স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা খালি পায়ে এই শোভাযাত্রায় শরিক হন।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে মহিলাদের এই প্রথম প্রতিবাদ মিছিলে প্রতিভা মুৎসুদ্দির অংশগ্রহণ ছিল খুবই সক্রিয়। ওই মিছিল ছাড়া অন্যান্য কর্মসূচিতেও মহিলারা ট্রাকে করে শহর প্রদক্ষিণ করতেন। প্রতিভা মুৎসুদ্দি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অন্য সহপাঠীদের নিয়ে এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলাম। ঢাকায় বর্বরোচিত হামলার কথা আমরা একুশ তারিখ বিকেলেই জানতে পারি। ঢাকার ঘটনার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করি এবং তা প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে অব্যাহত রাখি।

ছাত্রীর সংখ্যা অত্যন্ত কম ছিল। আমরা মাত্র ৩/৪ জন ছাত্রী চট্টগ্রামের এসব মিছিল-সমাবেশে অশংগ্রহণ করি। ১৯৫২ সালের পরেও তিনি এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ডাকসু’র ছাত্রী প্রতিনিধি নির্বাচিত হন এবং ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরবর্তীকালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন এই ভাষা আন্দোলনে আরো সক্রিয় হয়ে পড়ি। সম্পর্ক স্থাপিত হয় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংষদ ‘ডাকসু’তে ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ছাত্রী প্রতিনিধি নির্বাচিত হই। স্বভাবতই তখন আন্দোলন সংগ্রামের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়।

‘১৯৫৫ সালে পরীক্ষা থাকায় সিদ্ধান্ত ছিল আমার ওপর কোনো বড় দায়িত্ব না দেয়ার। সে অনুযায়ী আমি লেখাপড়ায় তখন ব্যস্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে খবর পেলাম পাকিস্তান পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের শহীদ মিনারে যেতে দিচ্ছে না, পুরো এলাকা তারা কর্ডন করে রেখেছে। এ খবর পেয়ে আমরা কয়েকজন ছাত্রী ছুটে যাই শহীদ মিনারের দিকে।

দেখি বেয়োনেট উঁচিয়ে পুলিশ শহীদ মিনার কর্ডন করে রেখেছে। কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছে না। এক পর্যায়ে পুলিশ আচমকা লাঠিচার্জ করে। এতে অনেকে আহত হন, অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, তখন আমি অনন্যোপায় হয়ে কয়েকজনকে নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে বই পড়ার ভান করি। পুলিশ লাইব্রেরিটিকে ঘিরে রাখে।

বেশ কিছু সময় পরে পুলিশ চলে যাওয়ায় আমরা হলের দিকে যেতে থাকি। কিছুদূর যেতে না যেতেই একটি পুলিশ ভ্যান এসে আমাদের গতিরোধ করে দাঁড়ায়। আমাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, এটা আঁচ করতে পেরে আমরা স্লোগান দিতে থাকি। পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে প্রথমে লালবাগ থানায়, পরে সেখান থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানে তিনি সাহিত্যকর্ম ও লেখালেখিতে নিয়োজিত।

এম আর মাহবুব ও সালেক নাছির উদ্দিন : লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App