×

মুক্তচিন্তা

হালিমা খাতুন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:১২ পিএম

হালিমা খাতুন

অধ্যাপক হালিমা খাতুন ১৯৩৩ সালের ২৫ আগস্ট বাগেরহাট জেলার বাদেকাড়া পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলভী আবদুর রহিম শেখ ও মাতার নাম দৌলতুন্নেসা। ১৯৪৭ সালে বাগেরহাট মনোমোহিনী বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস, ১৯৪৯ সালে বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫১ সালে বিএ পাসের পর সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন।

১৯৫৩ সালে সেখান থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের প্রথমে খুলনার একটি গার্লস স্কুলে, আরকে গার্লস কলেজে এবং পরে রাজশাহী কলেজ ফর উইমেনে অধ্যাপনা শেষে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। এখানে প্রভাষক, রিডার, অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান ও পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। হালিমা খাতুন শিশু-কিশোরদের জন্য কয়েক ডজন বই লিখেছেন। তা ছাড়া বিএড শ্রেণির শিক্ষক প্রশিক্ষণ বইও রচনা করেছেন। তাঁর ২টি ইংরেজি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত মোট বইয়ের সংখ্যা ৫০টি।

হালিমা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষভাবে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে ওই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একুশের সকালে তাঁর দায়িত্ব ছিল পিকেটিং করা। তিনি পিকেটিংয়ের আগে মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের মেয়েদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আহূত ছাত্রসমাবেশে নিয়ে আসেন। মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজের ছাত্রীদের আমতলায় সমাবেশে সমবেত করার ব্যাপারেও তিনি সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেন।

২০ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করার ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হালিমা খাতুন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। একুশের আগের রাতে তিনি গোপনে নাদেরা বেগমের বাসায় তাঁর কাছে থেকে গিয়ে হোস্টেলের ছাত্রীরা যাতে আমতলার প্রতিবাদ সভায় যায় সে সংক্রান্ত চিঠি নিয়ে আসেন। হালিমা খাতুন পুরান ঢাকার উল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের ছাত্রীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। তাঁর মধুর ক্যান্টিনের সামনে অবস্থান গ্রহণ করেন।

সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। মেয়েরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রুপে (৪ জনের গ্রুপ) বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার মাধ্যমে রাজপথে নেমে আসতে থাকেন। হালিমা খাতুন একটি গ্রুপের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হন। তাঁর দলের ওপর ৩ জন হলেন : জুলেখা (পুতুল), নূরী ও সেতেরা। তাঁদের গ্রুপটি পুলিশের বাধা অতিক্রম করে রাজপথে বের হয়ে আসে। মেয়েদের আরো কয়েকটি গ্রুপ তাঁদের অনুসরণ করে। পুলিশ দুগ্রুপ মেয়েকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান। ছাত্রদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চোখের সামনে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ছাত্রছাত্রীদের আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাঁরা বাঁধভাঙা বন্যার মতো পুলিশের বাধা অতিক্রম করে বের হন। পুলিশ টিয়ার ও লাঠিচার্জের মধ্যে অন্যদের সঙ্গে হালিমা খাতুনও বের হয়। এ টিয়ার গ্যাসের যন্ত্রণা সহ্য করে স্লোগান দিতে দিতে যান তিনি। কিন্তু বেশিদূর তাঁরা এগুতে না পেরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে হতাহতের ঘটনা ঘটে। হতাহতদের মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয়। হালিমা খাতুন তাঁর সাথীদের নিয়ে বিভিন্ন রকম সেবা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আহতদের সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন। গুলি থামলে তিনি স্বউদ্যোগে আবারো মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে যান।

এখানকার পরিস্থিতির বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ব্যারাকের সামনে গিয়ে দেখি বিশাল জায়গাজুড়ে রক্ত। এত রক্ত একসঙ্গে আর কখনো দেখিনি। তারই এক পাশে গাছের ডালে ঝুলানো শহীদের রক্তে ভেজা শার্ট ও পায়জামা। তখনো যেন রক্ত ঝরে ঝরে পড়ছে।’ (সূত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০)।

এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ উদ্দিনের মাথার খুলি উড়ে যায়। তাঁর মগজ বের হওয়া লাশের একটি ছবি তোলেন আমানুল হক। মিলিটারি তখন এসএম হল দখল করে ছাদে বালির বস্তা দিয়ে ব্যূহ তৈরি করেছিল। মিলিটারির ভয় তুচ্ছ করে হালিমা খাতুন ছবিটি বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে আসেন। সে ছবিটি পত্রিকায় ছাপানোর জন্য তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আহত ভাষাসৈনিকদের আহার, চিকিৎসা, ওষুধপত্র ক্রয় এবং আন্দোলনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এ জন্য চাঁদা তোলা হয়েছিল। হালিমা খাতুন হলো মেয়েদের সঙ্গে ঢাকা শহরে চাঁদা তুলেছেন। লিফলেট বিলি, পোস্টার লিখা এবং মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা ছিল হালিমা খাতুনের নিত্যদিনের রুটিন কাজ।

ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে এসব কাজ করে তিনি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হালিমা খাতুন পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছেন। এই মহান ভাষা সংগ্রামী গত বছর ৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

লেখকদ্বয় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App