×

বিশেষ সংখ্যা

বেকার, শিক্ষিত বেকার আর আমাদের ব্যর্থতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৩৩ পিএম

বেকার, শিক্ষিত বেকার আর আমাদের ব্যর্থতা

এটি রাতারাতি সমাধান হবার মতো সমস্যা নয় এবং রাতারাতি সমাধান হলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী সমাধান। আমাদের দরকার আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা।

বেকারত্ব নিয়ে বাংলাদেশের সবাই বেশ চিন্তিত। নীতিনির্ধারণী মহল থেকে পাড়ার দোকানদার পর্যন্ত। আর এটা খুবই স্বাভাবিকও। কারণ বেকারত্ব দ্বারা সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত। সবাই চিন্তিত থাকার পরেও যখন সমস্যাটি সমাধান হচ্ছে না, এর অর্থ হলো আমরা সমস্যাটির ভেতরে ঢুকছি না অথবা সমস্যাটি সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি, দরকারি পদক্ষেপ না নিয়ে কাজ চালানো স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে কোনোভাবে শর্টকাটে সমাধান করার চেষ্ট করছি। এখন একটু বেকারত্বকে কাছ থেকে দেখা যাক।

কোনো ধরনের তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে সাধারণভাবে বেকার বলতে আমি বুঝি, সেই মানুষটিকে যে কাজ করতে ইচ্ছুক কিন্তু সামর্থ্য অনুসারে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন না। এখানে একটা ব্যাপার বেশ মনোযোগের দাবি রাখে। বলা হয়েছে কাজ করতে ‘ইচ্ছুক’। সক্ষমতার কথা বলা হয়নি। তার সক্ষমতা থাকতে পারে কিন্তু সেই কাজ করতে সে ইচ্ছুক নাও হতে পারে, আবার ব্যাপারটা উল্টোও হতে পারে। আর আমার মতে ইচ্ছে আর সক্ষমতার পার্থক্যই আমাদের বেকার সমস্যার অন্যতম কারণ।

ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক। একজন ২৬ বছর বয়সী অর্থনীতিতে সম্মান পাস করা মানুষ এবং একজন ২৬ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণি পাস মানুষ দুজনেই কাজ করতে ইচ্ছুক। পঞ্চম শ্রেণি পাস মানুষটি অর্থনীতির গবেষক হিসেবে কাজ করার যোগ্য নন এবং সম্মান পাস করা মানুষটি পাড়ায় মুদির দোকান চালাবার জন্য অধিক যোগ্য হওয়ার কারণে অনিচ্ছুক। তাহলে আমরা যদি পঞ্চম শ্রেণি পাস মানুষের জন্য গবেষক এবং সম্মান পাস মানুষের জন্য মুদির দোকানের ব্যবস্থা করে দেই, প্রকৃতপক্ষে তারা দুজনেই বেকার থাকবেন। আমাদের বেকার সমস্যার কোনোই সমাধান হবে না।

তাহলে যে যেই কাজে যোগ্য এবং যেই কাজ করতে ইচ্ছুক সেই কাজের ব্যবস্থা করে দিলেই তো বেকার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই না? উত্তর হলো হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল না। কাজের ব্যবস্থা করে দেয়ার অর্থ হলো কর্মসংস্থানের উপায় বের করা। মানুষগুলোকে কাজে লাগাবার মতো কাজ তৈরি করা। এটার সঙ্গে বিনিয়োগ, ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিসহ অনেক অনেক ব্যাপার জড়িত। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হলো মানুষগুলো আমাদের দরকারের কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা। আর এখানেই আসছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশটি। শিক্ষা।

বাংলাদেশের শিক্ষিতের হার গত এক দশকে অনেক বেড়েছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিক্ষিত বেকারের হার। এর পেছনের কারণ হলো আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগের সঙ্গে আধুনিকায়ন করতে পারিনি। আমাদের তরুণরা মেধায় বিশ্বের কারো চেয়ে কম এ কথা আমি মানতে রাজি না। আমাদের এই মেধাবী তরুণ সমাজের বিশালসংখ্যক তরুণকে যে আমরা বেকার বানিয়ে রেখেছি এটার দ্বায় আমরা কোনোভাবেই এড়াতে পারি না।

যখনই বেকার সমস্যা এবং শিক্ষার কথা আসে তখনই সাধারণত অভিযোগের তীর যায় আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু দ্বায় আছে। কিন্তু কোনোভাবেই দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করতে না পারার সব সব দ্বায় বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নয়। এর বেশ বড় অংশের দ্বায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং কারিগরি বিদ্যালয়গুলোর। আমাদের প্রথমেই আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা মেনে নিতে হবে। মেনে নিলেই, সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বাজারবান্ধব না।

বাজারবান্ধব না, এর অর্থ হলো, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে, আমরা নতুন জ্ঞান তৈরি উপযোগী শিক্ষা দেই না। আমরা অর্জিত জ্ঞানের চর্চা করি মাত্র। এবং সেই চর্চাও অনেকটা কাজ চালানোর মতো করে। বিশেষভাবে জ্ঞানী হয়ে ওঠার মতো না। নতুন জ্ঞান তৈরির ব্যাপারে আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই একটি ভুল ধারণা আছে যে, এর জন্য অঢেল টাকার দরকার হয়। কিছু ক্ষেত্রে কথাটি সত্য হলেও সর্বক্ষেত্রে না। নতুন জ্ঞান শুধু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্ষেত্রেই হয় না, বরং খুব সাধারণভাবে কম সময়ে একটি সেবাকে ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়ার মাঝেও হয়, নতুন একটা সাহিত্য তৈরির মাঝেও হয়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে আমরা সর্বদাই নতুন জ্ঞান তৈরিতে উৎসাহিত করতে বড়ই অনীহা প্রকাশ করি। বেকার সমস্যা দূর করতে এখন আমরা বরাবরই উদ্যোক্তা তৈরি করার কথা বলি। কিন্তু উদ্যোক্তা তৈরি ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার তৈরির চেয়ে জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। কারণ একজনকে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ৫ বছর পড়িয়ে আমরা ডাক্তার বানাতে পারব। তিনি জানবেন উচ্চ রক্তচাপ হলে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্কে সমস্যা হবে। কারণ এটি প্রমাণিত। ব্যাপারটা হলো জানার।

অথচ আমরা ৫ বছর পড়িয়ে কখনোই একজন সফল উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারব না। কারণ আমরা জানি না আজ যে সেবায় গ্রাহক খুশি, আগামীকাল সে সেটায় খুশি থাকবে কিনা। এর কোনো প্রমাণিত সূত্র নেই। একজন উদ্যোক্তাকে তার সময়ের চেয়ে আগে ভাবতে হয় অর্থাৎ তাকে নতুন জ্ঞান বানাতে হয়। এটা শুধু শিক্ষা না, চিন্তাধারা। আর এই চিন্তাধারা একদিনে তৈরি হয় না। এর জন্য দরকার প্রথম থেকেই শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবমুখি বানানো।

অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক তার উল্টো অবস্থাতে দাঁড়িয়ে আছে। পঞ্চম শ্রেণির একজন বাচ্চাকে আমরা জিপিএ ৫ এর পেছনে দৌড় দিতে বলি। ১০ বছরের একটা বাচ্চা যদি পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ ৫ না পায় তাহলে তার আট বছর পরেও, কলেজে ভর্তির সময়ে, সেই জিপিএ ৫ না পাওয়ার ভার বহন করতে হয় তাকে। একই কথা সত্য স্নাতক এবং সম্মান পর্যায়ের লেখাপড়ার ফলাফলের ক্ষেত্রে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বড় বেশি ফলাফল নির্ভর। তাও পুরনো ফলাফলের ব্যাপারে। আমি কোনোভাবেই ফলাফলের গুরুত্বকে খাটো করছি না অথবা ফলাফল বাদ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা বানাবার কথা বলছি না।

আমি শুধু বলছি, পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ ৩ পাওয়া বাচ্চাটিকে কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ নিতে যেন বাধা দেওয়া না হয় অথবা তার বিজ্ঞান বিভাগে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা যেন রাখা হয়। তার সেখানে যাবার যোগ্যতা যেন তার ১০ বছর বয়সের পরীক্ষার ফলাফল না হয়। হয়তো সেই বাচ্চাই একসময় দুনিয়া কাঁপানো প্রোগ্রামার হতো। আমরা তাদের সেই রাস্তাটি যেন বন্ধ না করি।

৭.৫% প্রবৃদ্ধির দেশে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের আধুনিকীকরণ সময়ের দাবি। শুধুমাত্র অবকাঠামো এবং ব্যবসা দিয়ে আমাদের এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমরা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে পারবো না। আমাদের উন্নয়নের মহাসড়কে অন্যদের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে নতুন জ্ঞান তৈরির মিছিলে শামিল হতে হবে। আর নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারলে, তার ব্যবহার বাড়াতে পারলেই আমরা আমাদের তরুণ সমাজের ইচ্ছে আর সক্ষমতার পার্থক্য ঘুচাতে পারব। আর তাহলেই আমাদের বেকার সমস্যার সমাধান হবে।

এটি রাতারাতি সমাধান হবার মতো সমস্যা নয় এবং রাতারাতি সমাধান হলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী সমাধান। আমাদের দরকার আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা। আমরা শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানিতেই শীর্ষে থাকতে চাই না, আমরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, বিজনেস এনালিস্ট, উদ্যোক্তা রপ্তানিতেও শীর্ষে থাকতে চাই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে না বানিয়ে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তৈরি করলে অবশ্যই অবস্থার উন্নতি হবে।

বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আমি কখনই দমে যাই না। কারণ এত প্রতিকূলতার মাঝে আমাদের তরুণরা তাদের মেধার সাক্ষর রাখছে সারা পৃথিবীতে। আমি শুধু ভাবি তাদের আর একটু সুযোগ দিলে না জানি দেশটা কতই না বদলে যেতো!!!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App