×

বিশেষ সংখ্যা

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৩:৪৪ পিএম

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ
বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ বুধবার চলতি অর্থবছরের শেষার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে যা মূলত বেসরকারি ঋণের লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। এতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানোর কৗশল নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্ধারণ করা হয়েছে বাজারে টাকার প্রবাহ আরো বাড়ানোর লক্ষ্য মাত্রা যার মধ্যে রয়েছে নিট অভ্যন্তরীণ সম্পদ ১৬.৮%, অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৫.৯%, সরকারি ঋণ ১০.৯%, বেসরকারি ঋণ ১৬.৫% এবং মুদ্রা সরবরাহ ১২%। প্রস্তাবিত মুদ্রানীতিতে বর্তমান আর্থিক বছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭. ৮% হতে পারে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই মুদ্রানীতিতে উদ্দেশ্য ধরা হয়েছে প্রথমত ভোক্তা মূল্যস্ফীতি পরিমিত পর্যায়ে রাখা; দ্বিতীয়ত, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সমর্খন জোগানো। এই মুদ্রানীতিতে যে উদ্দেশ্য ধরা হয়েছে তা যুক্তিযুক্ত ও সময়োপযোগী। মুদ্রানীতি ঘোষণাপত্রে আরো বলা হয়েছে যে, মুল্যস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতার কারণে নতুন মুদ্রানীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি। মুদ্রানীতি ঘোষণাপত্রের সারাংশে বলা হয়েছে দ্রুত মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বিদেশ থেকে আনতে হবে যার জন্য আর্থিক খাতের সামর্থ্য বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি সুদ ও বিনিময় হারে চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে বাজার ব্যবস্থাপনা বাধাগ্রস্ত হবে যা বিনিয়োগের পরিবেশ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা দিধাগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন সংগঠন বলছে মুদ্রানীতি সম্প্রসারণমূলক যাতে ব্যাপক মুদ্রা ১২% প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংন্থান বৃদ্ধি নিয়ে তেমন দিকনির্দশেনা নেই। বিগত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ৮৫ কোটি ডলার ঘাটতি রয়েছে যা ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ছিল ১৩ কোটি ডলার। দেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি বড় উদ্যোগ তৈরি করেছে যা ক্রমান্বয়ে চলতি হিসাবে আগের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে যা লেনদেন বাণিজ্যে ঘাটতি ও দেশের বাইরে অর্থ পরিশোধের কারণেই এমনটি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী রিমান আমদানি হচ্ছে তার ৩০%ই মূলধনী যন্ত্রাংশ এবং অগ্রাধিকার বৃহৎ প্রকল্প। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে কিন্তু এটা উদীয়মান অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। আবার সঞ্চয়ীদের উৎসাহ জোগাতে উদ্যোগ প্রয়োজন কারণ জাতীয় সঞ্চয়ের হার কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১১.৫% যা ২০১২ সালে ছিল ২০%। পাবলিকের সঞ্চয়ের ৩২%ই সঞ্চয়পত্রে যার ৮০%ই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় লেনদেন হচ্ছে যা মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল ধারায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। বেসরকারি খাতের ঋণ যাতে সরকারি খাতে চলে না যায় এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। গত বছরটি নির্বাচনী বছর হওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা একটি অনিশ্চিয়তার বছর কাটলেও সরকারি খাতের বিনিয়োগ টার্গেট তুলনায় বেশ বেড়ে ছিল। বর্তমান নতুন বছরে নতুন সরকার স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সরকার গঠন করায় এখন বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং চীন জাপান প্রভৃতি দেশ থেকে বড় বিনিয়োগ আসছে বিশেষত টেক্সটাইল পোশাক, যন্ত্রপাতি। তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি। আবার নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে যেখানে উৎপাদন শুরু হলে রপ্তানি বাণিজ্য তা অবদান রাখবে। এরই মধ্যে ব্যবসার পরিবেশ উন্নতি করতে সরকার নানা রকম উদ্যোগ নিচ্ছে সত্যি কিন্তু বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া খুবই মন্থর। এখনো দেশে ব্যবসায় অর্থায়নের বড় উৎস ব্যাংকিং খাত হলেও এর বিকল্প গড়ে তুলতে বিগত জুলাই-ডিসেম্বরই মুদ্রানীতিতে ঘোষণা থাকলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এখন সময় এসছে পুঁজিবাজার ও বড় মার্কেট থেকে অর্থায়নের উৎস বাড়াতে হবে। এখনে উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক ঘোষিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রনীতির ঘোষণা পরপর দুই দিন মাঝারি ধরনের দরপতন হয়েছে শেয়ার বাজারে যা লক্ষণীয়। নতুন মুদ্রানীতিতে পুঁজি বাজারে ক্ষতিগ্রস্তকারক যেমন কোনো উৎপাদন নেই। তেমনই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তেমন কোনো পদক্ষেপ ও পরিলক্ষিত নয়। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সংগ্রহের কথা থাকলেও দেশের বন্ড মার্কেট কার্যকর না থাকায় এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সম্ভব হয়ে উঠছে না। এ ব্যাপারে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি কার্যকর ভ‚মিকা পালন করে তবে ব্যাংকিং খাতের ওপর চাপ কমবে। বড় ঋণ গ্রহীতায় মার্কেটমুখী হবে যা ঋণখেলাপি কমাতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে। কারণ বর্তমানে ঋণখেলাপি বেড়ে তা মোট বিনিয়োগকৃত ঋণের ১১.৮৯ শতাংশ দাঁড়িয়েছে যাকে ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞগণ বলছেন মহাবিপদ সংকেত। আশা করা হয়েছিল ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিতে ও খেলাপি ঋণ কমাতে মুদ্রনীতিতে তেমন ঘোষণা না থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান বলেছেন অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা খেলাপি ঋণ কোনোক্রমেই বাড়াতে দেয়া হবে না এর জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই কমিটি কি কৌশলে এই সম্যসার সমাধান করবে তার কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিসহ অর্থবছরের প্রথমার্ধে মুদ্রা ও অর্থনীতি কার্যক্রমের সামগ্রিক সফলতার কারণে দ্বিতীয়র্ধের মুদ্রানীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়নি। রেপো রিভার্স রেপো সুদহার ৬ এবং ৪.৭৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। ঘোষিত মুদ্রানীতিকে পরিবেশবান্ধব ও কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধির দিকে ইঙ্গিত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশ্লেষকগণ বলছেন ঋণ বিতরণের লক্ষ্য কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো সহজ নয় কারণ সরকার রাজস্ব আদায়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় ঘাটতিতে রয়েছে যার কারণে সরকারি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য বাড়িয়ে ১০.৯% করা হয়েছে অথচ গত মেয়াদে তা ধরা হয়েছিল ৮.৫%। তার অর্থ দাঁড়ায় সরকার বেশি ঋণ নিচ্ছে যার কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে যা বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমানে প্রবৃদ্ধির হার ও মূল্যস্ফীতির হার মিলে দাঁড়িয়েছে ১২.৫%। অথচ বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৬.৫% অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার ও মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের লক্ষ্য বেশি যা মোটেই আশঙ্কাজনক নয়। তাই সবকিছু মিলে মুদ্রানীতিতে ঘোষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। আবার সুদের হার কমিয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ঋণের চাহিদা বাড়ানো জরুরি যদিও সরকার ঘোষিত সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার নামিয়ে অনার ঘোষণা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। অর্থনীতির নিজস্ব কতগুলো গতিধারা (Rule of thumb) আছে যেমন প্রবৃদ্ধির (Growth)-এর সঙ্গে ঋণের সরবরাহের (Supply) সম্পর্ক রয়েছে। ঋণ প্রবাহের উপস্থিতি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয়ের পথকে সুগম করে। অপরদিকে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বেশি হলে সব পণ্যের দাম বাড়ে যদি চাহিদা মতে উৎপাদন কিংবা সরবরাহের ঘাটতি থাকে। এক কথায় বলা যায় বিনিয়োগের সাথে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি নীবিড় সম্পর্ক রয়েছে যার জ¦লন্ত প্রমাণ বর্তমান সরকারের বিগত দশটি বছর যেখানে সর্বশেষ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৬% যা প্রসংশসীয় বলা যায়। একরের মুদ্রানীতির আরো একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো বাজারে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোÑ যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ঋণের প্রবাহের উৎস প্রধানত আমানত সংগ্রহ ও বৈদেশিক অনুদান। এখন আমানতের ওপর সুদের হার কম হওয়ায় আমানতকারীরা ব্যাংকে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রে আগ্রহী বেশি লাভের আশায়। আবার বৈদেশিক অনুদান সংগ্রহে অনিশ্চয়তা রয়েছে যদিও অতীতের সব অর্জন দেশের নতুন সরকারকে আরো সামনে নিয়ে যাবে। গত অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছিল ১৭২১ মার্কিন ডলার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন দেশের আর্থিক সেবা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার অভিযান বিশেষত দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, এসএমই খাতে অর্থ জোগাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত পাঁচ বছরে অনেক উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও নারী উদ্যেক্তা সৃষ্টিতে এসএমই খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে ১৫% অর্থ কেবলমাত্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই সব অর্জন দেশের নতুন সরকারকে আরো সামনে নিয়ে যাবে। এখানে উল্লেখ্য যে, মুদ্রনীতির সাথে রাজস্বনীতির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ বিধায় প্রথমটির ইতিবাচক প্রভাবে যদি কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও আয়ে পড়ে তবে দ্বিতীয়টির ওপর এর গুণগত প্রভাব পড়তে বাধ্য। তবে আশা করা যাচ্ছে যদি প্রবাহ তথা বিনিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদনের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় তবে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু প্রশ্নটি হলো নতুন গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ যথা প্রথমত, বাণিজ্য সহায়ক অবকাঠামো নির্মাণ করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা, দ্বিতীয়ত, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে বের করা এবং তৃতীয়ত, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষত ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা। এগুলোর সমাধানকল্পে সরকারের অবশ্য উৎসাহের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয় যদি মুদ্রানীতির সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায় এবং দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App