×

বিশেষ সংখ্যা

দুর্ধর্ষ দুদার্তে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৩৭ পিএম

দুর্ধর্ষ দুদার্তে

দুতার্তে প্রায়শই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হন। একবার তিনি দেশটির ৩২ জন রাজনীতিক, সরকারি আমলা ও বিচারকের নাম উল্লেখ করে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘এরা মাদক ব্যবসায় জড়িত। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণ না করে কোনো রকমের ঘোট পাকানোর চেষ্টা করলে তাদের প্রত্যেককেই গুলি করে হত্যা করা হবে।’

কাকডাকা ভোর। মহাসড়কের নিয়ন বাতিগুলো একে একে নিভে যাচ্ছে। সকালের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে তখন। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার রাজপথ ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। ঠিক ওই সময় রাস্তার পাশেই পড়ে থাকতে দেখা গেল এক যুবকের বুলেটবিদ্ধ মরদেহ। খবর পেয়ে ছুটে এলেন মাঝবয়সী এক নারী। মরদেহটি দেখেই চিনতে পারলেন তিনি, এ যে তারই প্রাণপ্রিয় স্বামী। হতবিহ্বল ওই নারী ঘটনার আকস্মিকতায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই ঘটেছে। মৃতদেহটি কোলে নিয়ে তিনি বিলাপ শুরু করলেন। চারদিকে ভিড় বাড়তে থাকল। সাংবাদিকরা ছুটে এলেন। এলো টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও। যারা ওই যুবককে চিনতেন, তারা হায় হায় করে বলতে থাকলেন, আরে! উনি তো আমাদের এলাকার মাদক সম্রাট ছিলেন। পুলিশ তাকে সমঝে চলতো। তারই আজ এই দশা! রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

হ্যাঁ, ফিলিপাইনের রাস্তাঘাটে এখন এ রকম মৃতদেহ পড়ে থাকার ঘটনা নিত্য। এমন ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের ক্ষমতা গ্রহণের পর এ সংখ্যাটা ৫০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন তারা। এই নিহতদের বেশিরভাগই মাদক ব্যবসার হোতা, কোনো চুনোপুঁটি নয়। মাদক ব্যবসার ওই চক্রে আছেন খোদ পুলিশের বড় বড় কর্তাব্যক্তি, সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিচারকরা পর্যন্ত। মাদকের শিকড় অনেক গভীরে চলে গেছে দেশটির।

মাদক আর দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ফিলিপাইনের এই চক্রের বিরুদ্ধেই রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। মাদক সম্রাটদের সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে এসেছেন তিনি। যাকে দেশটির জনগণ ডাকেন ‘দ্য পানিশার’ বা ‘শাস্তিদাতা’ নামে। তারই নির্দেশে অপরাধীদের ধরে ধরে এই কিলিং মিশনে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

দুতার্তে ফিলিপাইনের ১৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ৩০ জুন ২০১৬। এর মধ্যেই রীতিমতো বিভীষিকা বনে গেছেন তিনি। এই বিভীষিকা অবশ্য সাধারণ মানুষদের কাছে নয়; অপরাধীদের কাছে। বিশেষ করে দুর্নীতিবাজ ও মাদক চোরাচালানিরা তার ভয়ে এখন তটস্থ। অপরাধীদের তিনি কোনো ছাড় দেবেন না; এমনটা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সময়ই বলে দিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলেছিলেন, অপরাধ নির্মূলে অপরাধীকে দেখামাত্র গুলি করে মারা হবে। কোনো ছাড় নেই। সেই প্রতিশ্রুতিতে মিলেছিল বিপুল ভোট। এখন তিনি জনগণের সেই ঋণ শোধ দিতে অপরাধ দমনে নেমেছেন।

এর ফলে ফিলিপাইনসহ আন্তর্জাতিক মহলে বিপুলভাবে আলোচিত-সমালোচিতও হচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন- এমন অভিযোগে অনেকে তাকে ‘কসাই’ উপাধিও দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তবে তিনি তার পথে অটল আছেন।

দুতার্তে প্রায়শই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হন। একবার তিনি দেশটির ৩২ জন রাজনীতিক, সরকারি আমলা ও বিচারকের নাম উল্লেখ করে কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘এরা মাদক ব্যবসায় জড়িত। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণ না করে কোনো রকমের ঘোট পাকানোর চেষ্টা করলে তাদের প্রত্যেককেই গুলি করে হত্যা করা হবে।’ ওই ঘোষণার পর বেশিরভাগ ‘অভিযুক্ত’ আত্মসমর্পণ করেছিল। অথচ এর আগে তাদের আত্মসমর্পণ তো দূরে থাক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান আমলেই নিত না তারা।

দুতার্তে কথা বলেন চাঁচাছোলা। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্দেশে তিনি বলে থাকেন, আপনাদের কাজ বিবৃতি দেয়া, দিতে থাকুন। আমার কাজ অপরাধ নির্মূল করা। করে যাব। আপনাদের কথা শোনার সময় নেই আমার। নানা সমাবেশে মাদকব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন, ‘যথাবিহিত প্রক্রিয়া মেনে আমি কথা বলি না। আমার এখানে কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণের ব্যাপার নেই, এখানে কোনো আইনজীবী নেই। কোনো অজুহাত নয়; মাদক সংশ্লিষ্টতা পেলে সরাসরি গুলি।’

দুতার্তে মাদক ব্যবসায় যুক্ত যে ৩২ রাঘব বোয়ালের নাম ঘোষণা করেছিলেন, তাদের মধ্যে সাতজন বিচারক এবং ২৫ জন বর্তমান ও সাবেক কংগ্রেসম্যান, মেয়র ও অন্যান্য স্থানীয় কর্মকর্তারাও রয়েছেন। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, এসব লোকের নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করুন এবং আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করুন। এরা পলাতক হলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করুন। এরা আত্মসমর্পণ না করলে কিংবা সামান্যতম সহিংসতারও চেষ্টা করলে, আমি পুলিশকে বলব, ‘গুলি করুন’।

মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য ফিলিপাইনের সাধারণ মানুষের কাছে দুতার্তে দিন দিন আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।

দুতার্তের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা হতে পারে। সেটি হচ্ছেও। এর বাইরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এই ক্ষ্যাপা প্রেসিডেন্ট মনোযোগ আকর্ষণের দাবি রাখেন অন্য একটি কারণে। বিশেষ করে স্বাধীনচেতা এই দুতার্তের সদিচ্ছার কারণেই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া ডলার ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রিজার্ভ চুরি নিয়ে আমরা যখন শুধু হাহাকার করেছি, ফেরত আনার দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেইনি বরং দোষাদোষির মধ্যেই ডলার উদ্ধার কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম; তখন এই দুতার্তেই উদ্যোগী হয়েছেন। যখন তার কানে গেছে, এই ডলার চুরির কারণে ফিলিপাইনে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তখনই ফুঁসে উঠেছেন তিনি। ডলার ফেরতের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অভিযুক্ত স্থানীয় রিজাল ব্যাংককে কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

দুতার্তে তার নিজ এলাকা দাভাওয়ে দেখেছেন মাদকের করাল গ্রাসে সমাজের অবক্ষয়। মাফিয়াদের অস্ত্রের মহড়া। রাজনীতিকদের ওপর জনগণের আস্থা হারানোর চরম নজির। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্য পুলিশ, বিচারক ও সাংবাদিকদেরও।

এ কারণে তিনি দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসায় জড়িত বিচারক, সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়েও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘যেসব সাংবাদিক ঘুষ গ্রহণ করে কিংবা অন্যান্য দুর্নীতির কাজে জড়িত, তাদের হত্যা করাই উচিত।’

পুলিশদের উদ্দেশেও তিনি একই ধরনের সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘প্রিয় পুলিশ কর্মকর্তারা, আপনাদের অনেকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সে খবর আমার কাছে আছে। আপনারা যদি ওই পথ থেকে সরে না আসেন পরিণতি শুভ হবে না। ওই পথ থেকে সরে আসুন। নিজের পবিত্র দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকুন। এর বাইরে যেতে হলে হয় আমাকে হত্যা করতে হবে, নইলে আমি আপনাদের হত্যা করব। প্রজন্মকে বাঁচাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি।’

দুতার্তের এই মাদক-দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ দেশটির প্রধান বিচারপতি লোরডেস সেরেনো। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট যেভাবে বিচারপতিদের নাম মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে প্রকাশ্য বক্তৃতায় উল্লেখ করছেন, তাতে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। জবাবে দুতার্তে বলেছেন, মাদক নির্মূলের পথে উচ্চ আদালত বাধা হয়ে দাঁড়ালেও পরোয়া করি না আমি। প্রয়োজনে মার্শাল ল’ জারি করা হবে। তারপরও কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

৭৩ বছর বয়সী দুতার্তে অনেক দিন দেশটির দক্ষিণের দাভাওয়ের মেয়র ছিলেন। তিনি অপরাধ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি কাড়েন। এর প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনে। তিনি দুবার বিয়ে করলেও এখন আছেন সিঙ্গেল। তবে কয়েকজন গার্লফ্রেন্ড রয়েছে তার।

গত নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর দুতার্তে বলেছিলেন, ‘আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জনগণের এই রায় মেনে নিচ্ছি। আমি ফিলিপাইনের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। মেয়াদের মধ্যেই মাদক ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করে ছাড়ব।’ দুতার্তের নির্বাচনী প্রচারণাকে কেউ কেউ ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন। দুতার্তে জনসভায় বলেছিলেন, মাদকের বিরুদ্ধে এই লড়াই চালাতে গিয়ে লোকে যদি তাকে কসাইও বলে, বলুক। তিনি দেশের জনগণকে পচে মরতে দিতে পারেন না।

দুতার্তে আরো বলেছেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ দেখছে, আমি যদি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে থাকি, একটি পয়সাও যদি অসৎপথে আয় করে থাকি; তারা আমাকে ক্ষমতাচ্যূত করুক। আমার একটিই দোষ, আমি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটাচ্ছি। এবং আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, মাদকচক্র শেষ না করা পর্যন্ত এটা বন্ধ হবে না।

জাতীয়-আন্তর্জাতিক চাপ সামলে দুতার্তে কি পারবেন ফিলিপাইনকে মাদক আর দুর্নীতির ক্যান্সার থেকে মুক্ত করতে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের সামনের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App