×

বিশেষ সংখ্যা

কালো মানুষের কিংবদন্তি নেতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৪৯ পিএম

কালো মানুষের কিংবদন্তি নেতা

স্বাধীন জাম্বিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীক হবে মুটেম্বোর শেকল ভাঙা মূর্তি। কেনেথ কাউন্ডার মুখের কথাই শেষ কথা। মুটেম্বো হচ্ছে জাম্বিয়ার সংগ্রামী মানুষের প্রতীক। শেকল ভেঙেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের। শেকল ভাঙা মুটেম্বোর শৌর্যময় প্রতিকৃতিকেই রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে স্বাধীন দেশ জাম্বিয়া। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির নয়, এ দেশে অনেক যত্নে গড়ে তোলা হয় ‘ফ্রিডম স্ট্যাচু’। স্বাধীনতার দশম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৯৭৩ সলের ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় প্রতীক ফ্রিডম স্ট্যাচু জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে স্ট্যাচুর আড়ালের কিংবদন্তি নায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্যাঙ্কো এমপুন্তো মুটেম্বো এখনো বেঁচে আছেন এবং সিংহপুরুষ কেনেথ কাউন্ডার মতোই সাধারণ জীবনযাপন করছেন তার জন্মস্থান এম্বালা শহরে। জাম্বিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন সেই সব শহীদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে এই ‘ফ্রিডম স্ট্যাচু’ উৎসর্গ করা হয়েছে। এই উৎসর্গ বাণী লেখা আছে ফ্রিডম স্ট্যাচুর একেবারে পাদদেশে প্রস্তর ফলকে। এই পবিত্র আঙিনার সবুজ চত্বরে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা বেওয়ারিশ ছিন্নমূল বেশ কয়েকটি মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এমন ছিমছাম পরিপাটি সাজানো গোছানো নগরীর বুকে এই ভাসমান মানুষগুলো কি ফ্রিডম স্ট্যাচুর পায়ের কাছে এসে স্বাধীনতাকেই উপহাস করছে!

সাম্প্রতিককালে ‘গ্লোবাল ভিলেজের’ আপাত নির্দোষ তত্ত্বেও ডামাডোল আমাদের কানের দুয়ারে যতই করতালি বাজাক না কেন এর মধ্যে আছে নির্মম শুভঙ্করের ফাঁকি। পশুবৃত্তি থেকে মানুষের অনেক উত্তরণ ঘটেছে সত্যি, তবু আধিপত্যকামিতার অসভ্য প্রবণতা থেকে বিশেষ একটা মুক্তি ঘটেনি বললেই চলে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের রক্তখচিত ইতিহাসের পাতায় পাতায় খচিত আছে নানা নামে ও অজুহাতে মানুষের আধিপত্যকামিতার উলঙ্গ এবং হিংস্র ছাপ।

সত্যিকারের কথায় কতটুকু বেরিয়ে আসতে পেরেছে মানুষ সেই অনতিক্রম্য প্রবণতা থেকে? একেবারে অনতিক্রম্য না বলে ‘প্রায় অনতিক্রম্য’ বলাটাই হয়তো উচিত ছিল, কিন্তু সেটা বলেছি বড় দুঃখে পড়ে। শক্তি যার আছে, আধিপত্য সে দেখাবেই, সভ্যতা বা ভদ্রতার দোহাই দেয়ার কারণে আধিপত্যের থাবা একটুখানি আড়াল করলেও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলে ধারাল নখরসহ সে থাবা ঠিকই হানা দেবে, আগের নামে না হোক নতুন নামে, অথবা বেনামে। ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ তত্ত্বেও প্রায় সাম্যবাদী চেহারা ওই আধিপত্যের লোলুপ নখরে খাবলে খুবলে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আজকের এ রচনার গোড়াতেই এমন এক শক্তি উপক্রমিনকার আশ্রয় নিতে হয়েছে অতিসম্প্রতি আমার আফ্রিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কারণে। না, আফ্রিকা বললে ঠিক হবে না, আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশ জাম্বিয়া কালো মানুষের লড়াকু নেতা কেনেথ কাউন্ডার দেশ জাম্বিয়ায় মাস তিনেকের সফরে আমার যে অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে তারই প্রেক্ষিতে আমাকে মন্তব্য করতেই হচ্ছে- ১৯৬৪ সালে এই দেশটি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব লাভ করেছে, কিন্তু আধিপত্যবাদের অবসান হয়নি। চেহারা পাল্টেছে আধিপত্যের ধরন বদলেছে শোষণের; সত্যিকারের মুক্তি মেলেনি এ দেশের জনসাধারণের। মানতেই হবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ নির্যাতন নিপীড়ন এখন এ দেশে নেই।

জাতির জনক কেনেথ কাউন্ডা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত (বর্তমান প্রেসিডেন্ট এডগার লঙ্গু) এ দেশের মানুষই দেশ পরিচালনা করছেন। ব্রিটিশ নেই, কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই দেশটির অর্থনীতির উপরে প্রায় অনতিক্রম্য আধিপত্য বিস্তার করে আছে ভারত-চীনসহ একাধিক শক্তিশালী দেশ, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা বা কঙ্গোর মতো প্রতিবেশী দেশও।

থাক সে প্রসঙ্গ। একটি স্বাধীন দেশের রাজনীতি বা অর্থনীতি নিয়ে নাক গলানোর অভিপ্রায় আমাদের নেই। বরং এ দেশের উপনিবেশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামী নেতৃবৃন্দকে আমরা সব সময় স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায় ও সহমর্মিতায়। দুশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শৌর্য-বীর্যময় লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস আমাদেরও আছে।

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েও মুক্তি মেলেনি আমাদের, তেশই বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে পাকিস্তানি অপশাসন ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সেও এক উপনিবেশের কাল বটে। কাজেই ঔপনিবেশিক আধিপত্য কাকে বলে, দূর এশিয়ার এক প্রান্তের মানুষ হলেও আমরা বেশ ভালোই জানি।

গত শতকের মধ্য ভাগে সে এক সুবর্ণ সময় এসেছিল বটে, ঔপনিবেশিক শাসনের শেকল ভাঙার সময়। শুধু ব্রিটশ উপনিবেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানা দেশে নানা রঙের উপনিবেশ ছিল। এই আফ্রিকার দেশগুলোতেই ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ এবং আরো অনেক দেশের ঔপনিবেশিক শাসন বহাল ছিল দীর্ঘকাল। কালো মানুষের অধিকার ছিল না নিজের দেশে মাথা উঁচু করে কথা বলার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার।

কী আশ্চর্য, কালো হয়ে জন্ম নেয়া কারো অপরাধ হতে পারে? জন্মের উপরে কারো হাত থাকে? আর জন্মসূত্রে যে দেশের মাটির সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ, সেই দেশের ভালোমন্দের কথা বলার অধিকার তো দেশবাসীর জন্মগত অধিকার। মায়ের কথা, মাতৃভূমির কথা দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চরণ করা কোনো সন্তানের অপরাধ হতে পারে না, সেই অনিবার্য অধিকারও দিতে চায়নি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ। কিন্তু চিরকাল তা চলবে কেন?

পৃথিবীর ইতিহাস বলে- শোষিত বঞ্চিত অধিকারহারা মানুষ এক সময় ঐক্যবদ্ধ হয়, প্রতিবাদী হয়, স্বাধীনতাকামী হয় এবং দুর্বার আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিকতার জঞ্জাল ছুড়ে ফেলে মুক্তির স্বাদ লাভ করে। এ ঘটনা আমাদের উপমহাদেশে যেমন ঘটেছে, আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশেও ঠিক তেমনই ঘটেছে বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে। কালো মানুষের অবিসংবাদিত নেতা কেনেথ কাউন্ডার নেতৃত্বে জাম্বিয়ার মাটিতে উপনিবেশবিরোধী যে আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা হয় তা প্রায় একই সময়ে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় অনেক দেশে উত্তাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাসহ বিভিন্ন দেশের উপনিবেশবিরোধী নেতৃবৃন্দ এই জাম্বিয়ায় বসেই নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জরুরি মিটিং করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রায় সবারই অঘোষিত রাজনৈতিক দপ্তর হয়ে ওঠে জাম্বিয়া। এ সবই সম্ভব হয় কেনেথ কাউন্ডার উদার সহযোগিতা এবং পৃষ্ঠপোষকতার কারণে।

এরই ফলে ১৯৬১ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা, জুলিয়াস নায়েরের নেতৃত্বে তানজানিয়া, ১৯৬৪ সালে কেনেথ কাউন্ডার নেতৃত্বে জাম্বিয়া, ১৯৬৫ সালে রবার্ট মুগাবের নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ে, ১৯৫৭ সালে কুয়ামে এনক্রমার নেতৃত্বে ঘানা- প্রভৃতি দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়।

তেমনিভাবে ১৯৬০ সালে পেট্রিস লুমুম্বার নেতৃত্বে ডিআর কঙ্গো বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়। আরো কিছু পরে (১৯৭৫) পর্তুগাল উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয় মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলা। এমনিভাবেই অন্যান্য অনেক দেশেই ভেঙে পড়ে ঔপনিবেশিক শাসনের শেকল। তারপর আসে স্বাধীনতা। সব দেশেই স্বাধীনতার স্বপ্ন পুরুষদের সংগ্রামী জীবনের আলেখ্য থেকেই সে দেশের জনগণ দিনে দিনে রচনা করে নেয় কিংবদন্তির গল্প, কখনোবা সেখান থেকেই তৈরি হয় মিথ্যা; সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে যা টিকে থাকে বংশপরম্পরায়।

জাম্বিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক কালো মানুষের নেতা কেনেথ কাউন্ডা এবং তার অতি ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী জ্যাঙ্কো এম্পুন্ডো মুটেম্বোর সংগ্রামমুখর জীবনের আখ্যান নিয়ে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি কিংবন্তির গল্প শোনার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রথমে কেনেথ কাউন্ডাকে নিয়ে একটি এবং পরে মুটোম্বোকে নিয়ে দুটি কিংবদন্তির গল্প আমি পরিবেশন করছি। দরিদ্র স্কুল শিক্ষকের সন্তান কেনেথ কাউন্ডা দেশের হতদরিদ্র সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেই বড় হয়েছেন এবং শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

পরাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তিনি শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের নির্মম শাসন শোষণ নির্যাতন নিপীড়ন, সর্বোপরি কালো মানুষের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং ভেতরে ভেতরে প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি নিজেও কালো মানুষ, আর এ দেশ কালো মানুষেরই দেশ। বাইরে থেকে আসা ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শাসকরা এ দেশের কালো মানুষের প্রতি যে অমানবিক অন্যায্য অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিপীড়ন করেছে তারই প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গড়ে তোলেন কালো মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনের দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি।

এই পার্টির নেতৃত্বেই ১৯৬৪ সালে জাম্বিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার বেশ আগের ঘটনা। প্রবল আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে শে^তাঙ্গ শাসকরা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে শুরু করেছে, এটা সেই সময়ের গল্প। কালো মানুষের কেনাকাটার জন্য মার্কেট খোলার অনুমতি দেয়া হয়েছে, লোক দেখানোর মতো জনকল্যাণমূলক কাজকর্মও শুরু হয়েছে। কিন্তু শে^তাঙ্গ শাসকদের অন্তরে ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বিষবাষ্প ঠিকই জমা আছে। তাই কালোদের জন্য সুযোগ-সুবিধা তারা লুসাকা শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে দিতে চায় না। রাজধানী শহর লুসাকায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কায়রো রোডের ক্ষেত্রে নিয়ম কানুন তখনো অত্যন্ত কঠোর।

বিকেল পাঁচটার পর কালোদের জন্য কায়রো রোড নিষিদ্ধ। কেনাকাটা যা করার তা অবশ্যই পাঁচটার পূর্বে সারতে হবে। নইলে বিপদ। বিকেল পাঁচটার পর কায়রো রোডে কালো মানুষ দেখা গেলেই গুলি চালিয়ে হত্যা। এদিকে কালো মানুষের জন্য তখনকার দিনে দোকান মাত্র একটি খোলা। সে দোকানেরও সামনে যাওয়া চলবে না। সে ঘোষণা স্পষ্টাক্ষরে লিখে প্রকাশ্যে টাঙিয়ে দেয়া আছেÑ ‘ব্ল্যাকস এ্যান্ড ডগস আর প্রহিবিটেড তার মানে কালো মানুষ এবং কুকুরের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নিজের দেশে নিজের পয়সায় জিনিস কিনতে গিয়েও এমন অমানবিক বাধা-নিষেধ। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না, কালো মানুষকে যেতে হবে পেছনের দিকে। সেই পেছনের দেওয়ালে ফোকর আছে কয়েকটি। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দাম দিতে হবে, তারপর সওদাপাতি নিতে হবে। কোনো দামদস্তুর চলবে না। ওজনে কম দিলে বা ভাঙতি পয়সার হিসাবে গরমিল হলে প্রতিবাদ চলবে না। মুখ খুললেই অত্যাচার, অপমান, মারপিট। ওদিকে আবার বিকেল পাঁচটার পূর্বেই কায়রো রোড ছাড়তে হবে, নইলে প্রাণনাশের হুমকি তো আছেই। কালো হয়ে জন্মেছে বলে কত আর সইবে জাম্বিয়ার কালো মানুষরা এই নিষ্ঠুর অপমান?

কালো মানুষের নেতা কেনেথ কাউন্ডা একদিন এগিয়ে আসেন অমানবিক এই অপমানের অভিনব প্রতিবাদ করতে। কায়রো রোডের কুখ্যাত সেই দোকানে তিনি যান সাইকেল কিনতে। কালো মানুষ। যথানিয়মে পেছনের দেওয়ালের ফোকরে হাত ঢুকিয়ে মূল্য পরিশোধ করার পর দাবি জানান-

সাইকেল দাও একটা। শে^তাঙ্গ সেলসম্যান খুব বিরক্ত গলায় বলে, হাত টানো। কেন! এই হাতেই তো সাইকেল নেব। দাম নিয়েছ, সাইকেল দাও। সেলসম্যান মহাখাপ্পা, ইয়ার্কি হচ্ছে? হাত টানো। বাইরের দরজায় গিয়ে সাইকেল নাও। বাইরের দরজা মানে! আহ্! সামনের দরজায় যাও বলছি। সামনের দরজায় আমি যাব কী করে? কেনেথ কাউন্ডা বলেন, তোমরা যে লিখে রেখেছ কালো এবং কুকুরের জন্য নিষিদ্ধ! ধমকে ওঠে সেলসমস্যান, হাত সরাও। যাও সামনে যাও। কেনেথ কাউন্ডার এক দাবি, আমি কালো মানুষ। আমি তো ফোকর দিয়ে দাম দিয়েছি। আমার এই হাতেই সাইকেল দিতে হবে। সেলসম্যান রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠে, বলছি তো সামনে যাও।

কেনেথ কাউন্ডা খুব ঠাণ্ডায় গলায় দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, চিৎকার করে লাভ নেই। তোমাদের ওই সাইনবোর্ড আগে নামাও। তারপর আমি সামনে যাব। আমি একা নই, সব কালো মানুষ আজ থেকে সামনে যাবে।

কেনেথ কাউন্ডার পেছনে তখন অসংখ্য কালো মানুষের ভিড়। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এই দেশে এই কায়রো রোডে এমন ঘটনা আগে কখনো দেখা যায়নি। এতগুলো কালো মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। কালো মানুষের আপসহীন নেতা কেনেথ তার অবস্থানে অনড়- নামাও সাইনবোর্ড।

তার সেই অনড় অবস্থানের কারণে সেদিন খসে পড়ে অমানবিক এবং অপমানজনক সেই সাইনবোর্ড। কায়রো রোডে এ নিয়ে সেদিন তুমুল তোলপাড়। দিনে দিনে তোলপাড় হয়ে ওঠে সারা দেশে। গণমানুষের যোগ্য নেতা কেনেথ কাউন্ডার নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত সে তোলপাড় চলতেই থাকে।

এবারের কিংবদন্তির গল্পটি জাম্বিয়ার স্বাধীনতার মহানায়ক কেনেথ কাউন্ডাকে নিয়ে নয়। নায়কের পাশে একাধিক সহনায়কও তো থাকে। তাদের জীবনের অনেক চমকপ্রদ ঘটনা থেকেও অনেক সময় গড়ে উঠতে পারে অসামান্য কিংবদন্তির গল্প। সে গল্পে প্রবেশের আগে জানাই- একদিন জাম্বিয়ার জাদুঘর দেখতে গিয়ে আমার পা আটকে যায় মাটিতে, দৃষ্টি আটকে যায় দুটি ভাস্কর্যে। লুসাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাদুঘরের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সংগ্রামী এক বীর যোদ্ধার ব্রোঞ্জ নির্মিত এক অসামান্য ভাস্কর্য। টানটান বুকে তার সাহসের টগবগে বারুদ। হাতে উদ্ধত বর্শাফলক। কে এই সাহসী যোদ্ধা, কী তার পরিচয় আমার জানা হয়নি। হতে পারে সে জাম্বিয়ার সব বীর যোদ্ধারই প্রতিনিধিত্ব করছে।

এরপর অদূরেই ‘ফ্রিডম স্ট্যাচু’ নামের কালো রঙের ভাস্কর্যে দৃষ্টি পড়তেই আমি চমকে উঠি। প্রবল সাহসী এক স্বাধীনতা সংগ্রামী হাতের শেকল কীভাবে ভেঙে ফেলছে সেই দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ওই অসামান্য স্ট্যাচুর আদলে। আমি বিশেষভাবে শিহরিত হই যখন আমার মনে পড়ে যায়- এই ভাস্কর্যের ছবিই তো মুদ্রিত দেখেছি এ দেশের একশ টাকার নোটে!

এরপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি- এটি কেবল শিল্পীর কল্পনাপ্রসূত যে কোনো মূর্তি মাত্র নয়। কালো রঙের স্থবির এই স্ট্যাচুর আড়ালে আছে এক জীবন্ত মানুষের ইতিহাস, এই জাম্বিয়ার জাগরণে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকা আজ কিংবদন্তি হয়ে গেছে। তাই স্বাধীন জাম্বিয়া নানাভাবে শ্রদ্ধা জানায় তাকে। ১০০ কোয়াচা মূল্যের রাষ্ট্রীয় মুদ্রার নোটে ছাপা হয়েছে এই ফ্রিডম স্ট্যাচুর ছবি।

‘ফ্রিডম স্ট্যাচু’ ভাস্কর্যের আড়ালের মানুষটি এই জাম্বিয়ার সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক বীর সন্তান। তার পুরো নাম জাঙ্কো এমপুন্ডো মুটেম্বো। ১৯৩৬ সালে নর্দান প্রভিন্সের এম্বালা শহরে তার জন্ম। পিতার মৃত্যুর পর মুটেম্বো স্কুলজীবন থেকে বিদায় নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে।

শত বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে-শোষণে-নির্যাতনে জাম্বিয়া (তদানীন্তন দক্ষিণ রোডেশিয়া) তখন জর্জরিত। প্রতিবাদী মুটেম্বো স্বপ্ন দেখেন ঔপনিবেশিক শাসনের শেকল ভেঙে জাম্বিয়াকে মুক্ত করার। রবার্ট মাকাসা এবং সাইমন কাপয়েপয়ের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হয়ে অনেক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন এবং জেল জুলুম নির্যাতনের শিকার হন। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কীভাবে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো যায় সেই প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সাতজন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি কেনিয়ায় যান। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তার সাহস এবং আত্মবিশ্বাস প্রবল বৃদ্ধি পায়।

১৯৫৭ সালের মধ্যেই সারা দেশে তার সংগ্রামী ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। ড. কেনেথ কাউন্ডা কিংবা অন্যান্য নেতৃত্ব মঞ্চে ওঠার আগেই অধিকাংশ রাজনৈতিক সভায় তিনি এসে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জাম্বিয়ার স্বাধীনতা-সংগ্রামের অনিবার্যতার কথা তুলে ধরে জনগণকে জাগিয়ে তোলেন। গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বিচারের নামে প্রহসন কারাভোগ- এ সব তার নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। একবার আদালত কক্ষে সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে নেমে এসে শে^তাঙ্গ পাবলিক প্রসিকিউটরের নাকে ঘুষি মেরে রক্তাক্ত করে দেন। ১০ বছর কারাদ- এবং চারটি বেত্রদ- তার সাজা হয়।

সে হচ্ছে ১৯৬৩ সালের কথা। সাজাপ্রাপ্ত মুটেম্বোকে আনা হয় লিভিংস্টোন কারাগারে। একদিন সামরিক হেড কোয়ার্টারের একটি কক্ষে বন্দি অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হয়। দুহাত লোহার শেকলে বাঁধা। তবু ১৮ জন সশস্ত্র সৈনিক তার বুক বরাবর অস্ত্র উঁচিয়ে রাখে, যেনবা যে কোনো মুহূর্তে গুলি ছুড়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে বুক। বাস্তবেও তেমনই আদেশ আসে। শারীরিক শক্তিতে হাতের শেকল ভাঙতে পারলে তার মুক্তি। নইলে গুলি করে হত্যা। মুটেম্বো শারীরিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত করেন পরাধীন জাম্বিয়ার সাধারণ জনগণের মানসিক শক্তি। এর ফলে ম্যাজিক্যাল ঘটনা ঘটে যায়। মুটেম্বো হাতের শেকল ভেঙে মুক্ত হন এবং জাম্বিয়ার মুক্তির দিগন্ত বিপুল সম্ভাবনার আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলেন।

জাম্বিয়ার স্বাধীনতা আসে ১৯৬৪ সালে।

স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পূর্বে ব্রিটিশ সরকারের শেষ গভর্নর (নর্দান রোডেশিয়ার) স্যার ইভেলিন হন জাম্বিয়ার স্বাধীনতা-আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ড. কেনেথ কাউন্ডার কছে জানতে চানÑ স্বাধীন জাম্বিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীক কী হবে? জবাব দিতে একটুখানি সময় নেন কাউন্ডা।

গভর্নর স্মরণ করিয়ে দিতে চান, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হচ্ছে ভিক্টোরিয়া ফলস, সেটা হতে পারে প্রতীক। বিশাল বনাঞ্চল আছে, সুন্দর ইম্পালা আছে, তা¤্রখনি আছে, যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সৌন্দর্যের মধ্য থেকেও নির্বাচন করতে পারেন। বলুন দেখি কোনটি হবে রাষ্ট্রীয় প্রতীক?

স্বাধীনতা-সংগ্রামের নায়ক কেনেথ কাউন্ডা মুখ খোলেন, তিনি বলেন, আমি একটু অন্য রকম বিষয় ভাবছি। বলুন আপনার ভাবনার কথা।

স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ মাথা উঁচু করে বলেন, স্বাধীন জাম্বিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীক হবে মুটেম্বোর শেকল ভাঙা মূর্তি। কেনেথ কাউন্ডার মুখের কথাই শেষ কথা। মুটেম্বো হচ্ছে জাম্বিয়ার সংগ্রামী মানুষের প্রতীক। শেকল ভেঙেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের। শেকল ভাঙা মুটেম্বোর শৌর্যময় প্রতিকৃতিকেই রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে স্বাধীন দেশ জাম্বিয়া। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির নয়, এ দেশে অনেক যত্নে গড়ে তোলা হয় ‘ফ্রিডম স্ট্যাচু’।

স্বাধীনতার দশম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৯৭৩ সলের ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় প্রতীক ফ্রিডম স্ট্যাচু জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে স্ট্যাচুর আড়ালের কিংবদন্তি নায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্যাঙ্কো এমপুন্তো মুটেম্বো এখনো বেঁচে আছেন এবং সিংহপুরুষ কেনেথ কাউন্ডার মতোই সাধারণ জীবনযাপন করছেন তার জন্মস্থান এম্বালা শহরে।

জাম্বিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে যারা আত্মোৎসর্গ করেছেন সেই সব শহীদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে এই ‘ফ্রিডম স্ট্যাচু’ উৎসর্গ করা হয়েছে। এই উৎসর্গ বাণী লেখা আছে ফ্রিডম স্ট্যাচুর একেবারে পাদদেশে প্রস্তর ফলকে। এই পবিত্র আঙিনার সবুজ চত্বরে গা এলিয়ে শুয়ে থাকা বেওয়ারিশ ছিন্নমূল বেশ কয়েকটি মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। এমন ছিমছাম পরিপাটি সাজানো গোছানো নগরীর বুকে এই ভাসমান মানুষগুলো কি ফ্রিডম স্ট্যাচুর পায়ের কাছে এসে স্বাধীনতাকেই উপহাস করছে!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App