×

বিশেষ সংখ্যা

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৩:৩৭ পিএম

আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে
সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে আজকের একুশ শতকের পৃথিবী অনেকটা এগিয়ে। তথ্যযুদ্ধে অবতীর্ণ মানুষকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। এক. যাদের জন্ম বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, দুই. যাদের জন্ম বিংশ শতাব্দীর সত্তর-আশির দশকে ও তিন. যাদের জন্ম একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে। অর্থাৎ পূর্ণবয়স্ক, মধ্যবয়স্ক ও কিশোর-তরুণ এরা একবিংশ শতাব্দীকে কীভাবে দেখছে ও মোকাবেলা করছে তা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। একুশ শতকের কিছুটা সময় পেরিয়ে এসে আমাদের চারপাশে তাকালে আমরা দেখব যে, আমাদের চিরচেনা দুনিয়াটা এখন আর তেমন নেই, যেমনটি থাকার কথা। পৃথিবীটা পরিবর্তনশীল এবং সে কারণেই এই পরিবর্তন অনিবার্য। কিন্তু এখন যে পরিবর্তন আমরা দেখছি তা কেবল সময়ের পরিবর্তন নয়। এটি এমন এক পরিবর্তন যা অপ্রতিরোধ্য, প্রচণ্ডভাবে বেগবান এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে তথ্যযুগের নির্মাণ। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আমরা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখোমুখি রয়েছি। আমরা তথ্যযুগের আগমনের মুখোমুখিও দাঁড়িয়ে আছি। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ব্যাপারটি নতুন নয়, এর মাঝেই আমরা ছিলাম এবং থাকব। তথ্যযুগের আগমনটি সাম্প্রতিক। কিন্তু আমাদের দুটিই মোকাবেলা করতে হবে। আজ নতুন করে পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নেই যে, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ এবং সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান আমলে আমরা উপর্যুপরি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছি। ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আক্রমণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও করেছে। তবে তাদের সবচেয়ে বড় অপকীর্তি ছিল সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি। এই উপমহাদেশে এত ভয়ঙ্করভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতো না যদি না ব্রিটিশরা এর উৎপাদক হতো। তারা একদিকে ভাষার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে অন্যদিকে মধ্য যুগীয় সংস্কৃতির ধারক সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তৈরি করেছে। ইংরেজ প্রবর্তিত কেরানি সৃষ্টির শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রবিভাজন-দুটিই আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার সর্বোচ্চ আঘাত ছিল। পাকিস্তান তৈরিটিই ছিল আমাদের ওপর ব্রিটিশদের সর্বশেষ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর পাকিস্তান কর্তৃক বাংলা ভাষার ওপর হামলা ছিল এর সর্বাত্মক নগ্ন প্রকাশ। সংস্কৃতি বলতে কেবলমাত্র গান, বাজনা, নাটক, সিনেমা বা সাহিত্যকে বুঝায় না। সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনপ্রবাহ। সংস্কৃতি বলতে জীবনকে ও জীবনের সর্বময় সমষ্টিকে বোঝায়। সংস্কৃতির পরিবর্তন আমাদের কাছে তাই জীবনের পরিবর্তন। অন্য অর্থে জীবনের পরিবর্তন হচ্ছে সংস্কৃতির পরিবর্তন। সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন অর্থে তাই জীবনের যে কোনো প্রত্যঙ্গে আক্রমণকেই বোঝাবে। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ভাষা আন্দোলন হলো আমাদের সংস্কৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ প্রতিবাদ। অনেকেই পাকিস্তান আমলে আরবি হরফে বাংলা লেখা, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ এবং নজরুলকে খণ্ডিত করা ইত্যাদিকে সাংস্কৃতিক আক্রমণ বলে অভিহিত করেন। মূলত পাকিস্তানিরা আমাদের এক জায়গাতেই প্রচণ্ডআঘাত করেছিল এবং আমরা তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছি। পাকিস্তানিরা নিজেরা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তারা উর্দুর হরফ বদলে আরবি হরফ ব্যবহার করেছে। তারা অন্তত দুহাজার বছরের প্রাচীন ও অনগ্রসর সংস্কৃতির কাছে আধুনিক ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়েছে। এর ফলে এরা না হয়েছে আরবীয় না হয়েছে ভারতীয়। তার সেই সংস্কৃতি আমাদের ওপর চাপাতে চেয়েছিল, যেমনটি একজন উপজাতীয় সর্দার তার গোষ্ঠীর লোকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে থাকে। আমরা বিদ্রোহ করেছি এবং সফল হয়েছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে সেই ধারাবাহিক প্রতিবাদের সাফল্য। কিন্তু একাত্তর সালে আমরা আগ্রাসী শক্তির মূলোৎপাটন করতে পারিনি, বিজয়ী হয়েছি মাত্র। সেই বিজয়ও আমরা বেশিদিন ধরে রাখতে পারিনি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বল্প সময়ের মাঝেই আমাদের সেই সাফল্য ব্যর্থতার পথে ধাবিত হয়। আজ প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ছাড়া কেউ খাঁটি বাঙালি নেতা নন। তিনি একমাত্র বাঙালি যিনি বাংলা, বাঙালি ও বাংলাভাষাকে বিশে^র একমাত্র বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছি। এই কৃতিত্ব প্রথম যার প্রাপ্য তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। যিনি ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাভাষার ভাষণ দিয়ে বাংলা ও বাঙালিকে বিশ^দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আজ আমরা যারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয়ে ভীত তাদের বঙ্গবন্ধুর মতো হতে হবে। তার মতো যদি আমরা সারা পৃথিবীকে যে কোনো স্থানে দাঁড়িয়ে বলতে পারি ‘আমি বাঙালি বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’ তবে কোনো আগ্রাসনই আমাদের কাবু করতে পারবে না। সাম্প্রতিককালে মৌলবাদের নড়েচড়ে ওঠা বস্তুত পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের একটি ভিন্নরূপের প্রকাশমাত্র। পাকিস্তানিরা এখনো ষড়যন্ত্র করছে। জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ার সুবাদে আমরা তাদের মতোই অনুন্নত সংস্কৃতিতে পা দেব এই ভরসাতেই তারা বিভিন্ন নীল নকশার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার মূল চরিত্র হারায়। এটি একটি প্রতিবিপ্লব বলা যেতে পারে। আমরা বিজয় অর্জন করে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম তা বস্তুত এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে ইশতেহার থেকে আমরা যেখানে যতটা সরে দাঁড়াচ্ছি সেখানে ততটাই আমরা আগ্রাসী সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করছি। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে আমরা এই দেশের সেরা সংবিধান বলছি। আর সে জন্যই যতবারই সেই সংবিধানের মূল নীতির যত সংশোধন করা হয়েছে, সংবিধানের পবিত্রতা তত নষ্ট করা হয়েছে। এমনি করে যতবারই আমরা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ইশতেহার থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি ততই এই রাষ্ট্রের মূল চরিত্র হারাচ্ছে। বস্তুত আগ্রাসন আসছে আমাদের ঘর থেকে। আমরা আমাদের ঘরের সংস্কৃতি বদলাচ্ছি এবং সেটিই হলো সবচেয়ে বড় আগ্রাসন। বাইরের শক্তি কোনোকালেই বাংলা ও বাঙালিকে পরাস্ত করতে পারেনি। কেউ কি বিশ্বাস করবেন যে বাংলা ভাষার নামে স্বাধীন হওয়া এই রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার উন্নয়নে একটি ফুটোকড়িও ব্যয় করা হয়নি। সর্বশেষ অবস্থা হলো এই যে, ১৯৯৯-২০০০ সালের বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল বাংলা ভাষার ওপর কম্পিউটারভিত্তিক গবেষণা করার জন্য। কিন্তু সেই টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ফেরত গেছে। কোনোই কাজ হয়নি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগ কাজও করেনি টাকাও ব্যবহার করেনি। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি বিগত সরকারের আমলে বাংলা ভাষার কিবোর্ড নিয়ে প্রতারণা করেছে। গত এক দশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ধারা উর্ধ্বমুখী হয়েছে, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধনী-গরিবে বৈষম্য কমেছে, যদিও একশ্রেণির নব্য ধনিক ও ভোগবিলাসী গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়েছে, জাতীয় জীবনে স্বস্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ হয়েছে। সামাজিক নৈরাজ্য, অনাচার ও দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। একুশ শতকের একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনের জন্য নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ লক্ষ্যে ভাষা গবেষণাগার স্থাপনে প্রয়াস নিতে হবে। বাংলা একাডেমি, চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, শিল্পকলা একাডেমিসহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ হবে বাংলা ভাষার প্রাণকেন্দ্র যদিও আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো বাংলা বিভাগ খোলা হয়নি। যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বাহন এমনকি আদালতের ভাষা ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গণমাধ্যম, যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির আদান-প্রদানে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যক। কেননা নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ছাড়া কোনো জাতি কোনোকালে অগ্রসরমান ও সভ্যজাতিতে পরিণত হতে পারে না। আমরা যারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জুজুর ভয় পাচ্ছি তারা সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারব কোনোদিন বাঙালি পরাস্ত হয়নি, হবেও না। অতীতে যত বিশ্বাসঘাতকতা যেভাবেই হয়ে থাকুক না কেন এখন আর সেই সময় নেই। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন আর আগ্রাসনমুক্ত সংস্কৃতি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। বাংলাদেশ হবে বিশে^র রোল মডেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তার প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের আন্তরিকতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ এখন কূপমণ্ডূকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সাবলীল, উদার ও উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে মর্যাদার কাতারে আসীন হয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি সংস্কৃতিরও গণজাগরণ ঘটেছে। আর এই গণজোয়ারে ঢেউ শুধু শহরেই নয়, গ্রামকেও নাড়া দিচ্ছে। জীবন মানের সূচক বিবেচনায় শহর আর নগর একাকার হতে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই কৃতিত্বকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার বা ম্লান করে দেয়ার কোনো দুরভিসন্ধিতে কিছু আসবে যাবে না। মানুষ আজ অনেকটাই সজাগ ও সচেতন। যেকোন বৈরী প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে দুর্যোগ ও সংকট মুক্ত আধুনিক বাংলাদেশের জয়যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বই দেশবাসীর কাম্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App