×

বিশেষ সংখ্যা

নির্বাসিত তারুণ্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৭:৪০ পিএম

নির্বাসিত তারুণ্য

তখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই সব সাহসী সত্যোচ্চারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাজের অগ্রযাত্রা, পৃথিবীর সভ্যতা। এইসব উচ্চারণ ছাড়া অকপট সত্য ছাড়া মানুষ বাঁচে না। এই দুর্বৃত্তায়নের মধ্যে কবিতার মহত্তম বাণীই আমাদের সহায়। ‘যদি তোর ডাক শুনে, কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। এই কথা শুনেই এগুতে হবে একা, একজন, তারপর দুয়েকজন- পরে অসংখ্য। আজ প্যালেস্টাইনে, ইরাকে, আফগানস্তানে, আফ্রিকার নানা দেশে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে- তার প্রতিবাদ শুধু স্লোগানে নয় তার প্রকৃত প্রতিবাদ রক্তাক্ষরে। কবিতার প্রজ¦লন্ত উচ্চারণে। একটি আন্দোলনশীল জাতির মধ্যে আক্রমণের আবেগ তৈরি করেন কবিরা, শিল্পীরা। সমাজের স্তম্ভ হচ্ছে সত্য আর সত্যের শিল্পরূপ হচ্ছে কবিতা।

কবিদের বিরুদ্ধে সৃষ্টিশীল মানুষের বিরুদ্ধে নানা কথা বলা হয়। শুধু যে আমাদের দেশে তা নয়। পৃথিবীর সব দেশেই সৃজনশীলদের ছন্নছাড়া, মতিচ্ছন্ন, কর্মবিমুখ ইত্যাকার অভিধাতেও অভিষিক্ত করা হয়। কিন্তু এ কথা তো সত্য, সমাজের এমন কোনো লোক আছে যে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কিংবা বলা যায় অনুভূতিপ্রবণ সে লিখতে চেষ্টা করেনি বিশেষ করে কবিতা লেখেনি।

যে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন নয় সেও কবিতা অন্তরে রচনা বেরিয়েছে। কবিয়াল যারা, জারি কিংবা সারি গায়ক তারাও রচনা করে কবিতা। বাঙালি শিক্ষিতজনদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষিতজনরা জীবনে দুয়েকটা পদ রচনা করেছেন। লিখলেও কবি হয়ে ওঠেননি।

এরকম লোকের সংখ্যা যেহেতু সর্বাধিক সেতেু গ্লানি ঢাকতে তারা বিজয়ী কবিদের সমাজের যায় তারাই কবিদের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে গিয়ে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির আসন অলঙ্কৃত করছেন। পৃথিবীতে ব্যর্থ প্রেমিক আর ব্যর্থ কবির সংখ্যা মনে হয় সমান।

কবি না হতে পারার বেদনা ভয়ঙ্কর। কবিদের বিরুদ্ধে আদিকাল থেকেই রাজনীতিক কিংবা সমাজের কর্ণধাররা লেগে আছেন। প্লেটো তো তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের স্থান দিতে চাননি। কি করে দেবেন কবিরা সত্যের চেয়ে আরো গভীর সত্য, সময়ের চেয়ে আরো অধিক সময়, কাল ও মহাকালে দ্রষ্টা।

কবিরা যতক্ষণ স্বপ্ন না দেখেন ততক্ষণ অন্যরা তা ভাবতেও পারেন না। বিজ্ঞান ও কবিতার মধ্যে অনেক অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য হচ্ছে একবার ভাবতে পারলে স্বপ্ন দেখতে পারলে তার অস্তিত্ব খোঁজার প্রচেষ্টা নেয়া যায়।

লেখক আর কবির বিজ্ঞানীদের পথপ্রদর্শক এ কথা বর্তমান পৃথিবীতে স্বীকৃত। কে না অমরত্ব চায়। অমর হওয়ার বাসনা মানুষের অনন্তকালের।

রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে কবিতা রচনা করছেন, কার্ল মার্কস, লেলিন, হোচিমিন, মাওসেতুং, চৌ এন লাই, যোসেফ স্তালিন এঙ্গেলস, হজরত আলী (রা.) এবং ইতিহাসে নিষ্ঠুর হিসেবে খ্যাত ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া, ইতিহাসের বর্বর হন্তারক হিটলার, সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপোল্ড সেদর সেঙ্ঘর ভারতবর্ষের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে আলোচিত ব্যক্তিত্ব বাজপেয়িও কবিতা রচনা করেন।

এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সাফল্যও পেয়েছেন। কিন্তু দিগ্বিজয়ী কবি হওয়ার বাসনা প্রত্যেকের অন্তরে লুক্কায়িত। কবি হলে কি সুবিধা? একজন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতে পারে। উত্তরে বলা যায়, হওয়ার সুবিধা হচ্ছে আপনি যা চান তাই পাবেন।

কবিদের হাতে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ থাকে। এ কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যেতে পারেন। আমাকে বোকা ভাবতে পারেন। একটা বাস্তব ঘটনা একবার আমি মফম্বলের এক হোটেলে চার খাবার পর পয়সা দিতে গিয়েছিলাম- আমার কাছ থেকে কোনো পায়সা নিলেন না হোটেল মালিক।

আমি বললাম কেন? তিনি বললেন আপনি কবিতা লেখেন আমি আপনাকে চিনি- আপনার কাছ থেকে পয়সা নেবো না। একবার ঢাকার এক ফার্নিচারের দোকানে আসবাবপত্র কিনতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করার পর দোকানি বললেন আপনার বিলটা আবার ঠিক করতে হবে।

আমি বললাম কেন- কোনো সমস্যা? আমি সরকারি চাকরিতে আছি- আপনি নির্দ্বিধায় কার্ড পাঞ্চ করুন- তিনি বললেন না আপনাকে একটু ডিসকাউন্ট দিতে চায়- আপনার কবিতার সাথে আমার পরিচয় আছে-আপনার চাকরির পরিচয় আমার কাছে বড় নয়।

পাশে আমার স্ত্রী ছিলেন, এতদিন কবিদের তিনি অনেক গালমন্দ করেছেন, আজ তারই সামনে এই কাব্যসম্মান- আমি আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। এভাবেই অনেক জায়গায় কবিদের কবিতার সম্মাননা আছে।

যারা মুখে কবিদের বিরুদ্ধে কথা বলেন অন্তরে তারাই লালন করেন কবিদের জন্য গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। কিন্তু কি করে কবি হবেন- এর কোন সূত্র কোন পূর্ব ধারণা কাঠামো এসব কিন্তু নেই। যারা লেখা শেখানোর স্কুল খুলেছেন- তারা প্রতারক।

এই কবিতাই হচ্ছে একমাত্র সয়ম্ভ শিল্প যেখানে অন্যের কোনো ভাগ নেই। পূর্বসূরিদের সামান্য প্রেরণা রঞ্জিত অনুকরণ থাকরেও পরবর্তী সময় তা হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র মৌলিক কারো সাহায্য ছাড়া, শত বিরোধিতার মুখে কিবতায় অগ্রযাত্রা অপ্রতিহত।

কবিরা আসে ঝাক বেঁধে, উল্লাস করতে করতে, দুঃখ ও শোক সহ্য করতে করতে, শেষ পর্যন্ত হয়তো থাকে কিংবা বাঁচে দুয়েকজন। ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন হয়। কবিরা সাহসের সঙ্গে সত্যোচ্চারণ করেন। কবিরা প্রতিবাদ করেন সাহসের সঙ্গে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি অমর একুশের আন্দোলন শুরু হয়েছিল কবিদের হাতেই। হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদিত প্রত্রিকা দিয়ে কবিরা আগুন জ্বেলে দিয়েছিল শব্দে শব্দে। স্বাধীনতার আন্দোলনের কবিরা ছিলেন অগ্রসৈনিক শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, আল মুজাহিদী, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখরা ছিলেন মাঠে কলমে সৈনিক।

এমনকি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন প্রথম কবি নজরুল ও কবি হসরত মোহানী। এ থেকেই প্রমাণিত হয় সত্যের সপক্ষে রাজনীতিকদের চেয়ে কবিরা অগ্রগামী। ইদানীং কবিতার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনি কিছু কিছু মূর্খ রাজনীতিক, মূর্খ কিছু আমলা ও বণিকদের।

এই ভেঙে পড়া সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই কবিরা নির্যাতিত হন। কবি শামসুর রাহমান আক্রান্ত হয়েছিলেন স্বগৃহে, কবি আল মাহমুদকে হুমকি দেয়া হয়েছিল টেলিফোনে, কবি হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হলেন।

কবিদের সাধারণ মানুষ ভালোবাসে বলেই এত প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় সর্বমহল থেকে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ওঠে সারা দেশে। কবি ববি স্যান্ডস যখন ফাঁসির রজ্জুতে নির্দ্বিধায় আত্মাহুতি দিলেন সারা পৃথিবী থেকে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেল।

মনে পড়ে বেঞ্জামিন মলয়েসিকে যখন অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলো- সারা পৃথিবী হয়ে উঠেছিল অগ্নিগর্ভ। লোরকাকে হত্যার পর যেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল লাখ লাখ লোরকা। আজো লোরকারা প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড নিয়ে পৃথিবীর পথে পথে ধাবিত।

হত্যা করে, হামলা করে কবিদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা যায় না। সেই সব মহৎ উচ্চারণকে কি মোছা যাবে? যাবে না। হুমায়ুন আজাদ যখন লেখেন-

এ আমার সময় নয়, আমি জন্মেছিলাম অন্যদের সময়ে। তখন ভাবতে হয় কবির সময় কোনটি? যখন ‘এ দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম অবাক পৃথিবী সেলাম তোমাকে সেলাম।’

মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত যেদিন অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না। যখন রবীন্দ্রনাথ বলেন- যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর এখুনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।

যখন শামসুর রাহমান বলেন- তাদের বুকের ওপরে সূর্যের চুমু ঝরে পড়ে নক্ষত্রের ছায়া বাংলাদেশ গান গায় অক্ষর শোনিতের।

যখন জীবনানন্দ বলেন- যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই প্রীতি নেই ভালোবাসা নেই, পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া

যখন রফিক আজাদ প্রশ্ন করেন- এ কেমন কাল এলো নারীরা স্তনযোগনীহীন বদ্ধডোবা পুরুষেরা নিবীর্য, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম।

তখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই সব সাহসী সত্যোচ্চারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাজের অগ্রযাত্রা, পৃথিবীর সভ্যতা। এইসব উচ্চারণ ছাড়া অকপট সত্য ছাড়া মানুষ বাঁচে না। এই দুর্বৃত্তায়নের মধ্যে কবিতার মহত্তম বাণীই আমাদের সহায়।

‘যদি তোর ডাক শুনে, কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। এই কথা শুনেই এগুতে হবে একা, একজন, তারপর দুয়েকজন- পরে অসংখ্য। আজ প্যালেস্টাইনে, ইরাকে, আফগানস্তানে, আফ্রিকার নানা দেশে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে- তার প্রতিবাদ শুধু স্লোগানে নয় তার প্রকৃত প্রতিবাদ রক্তাক্ষরে।

কবিতার প্রজ¦লন্ত উচ্চারণে। একটি আন্দোলনশীল জাতির মধ্যে আক্রমণের আবেগ তৈরি করেন কবিরা, শিল্পীরা। সমাজের স্তম্ভ হচ্ছে সত্য আর সত্যের শিল্পরূপ হচ্ছে কবিতা। যদি কবিদের উচ্চারণের মূল্য না থাকতো তবে লোককাকে, বরি স্যান্ডসকে, বেঞ্জামিন মলয়েসকে হত্যা করতে হতো না।

এমনকি হুমায়ুন আজাদকেও আক্রান্ত হতে হতো না। কবিতা কোনো বণিকের ঘরের শোভা বৃদ্ধির আসবার নয়। একদিন হয়তো বুক সেলফ থেকে কবিতার সহ্য শব্দগুলো বেরিয়ে তার অবৈধ সম্পদের হিসাব নিতে চাইবে, একদিন হয়তো বেরিয়ে পড়বে পথে পথে আর অন্যায় অসত্যের ধারক বাহকদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকবে।

হয়তো কোনো শাসক কাব্যবিরোধী সম্রাটের ঘরেই জন্ম নেবে কবি এবং তারই সন্তানের মগজে হৃদয়ে ঢুকে যাবে কবিতার অনির্বচনীয় স্বপ্ন ও আবেগ এবং সে ওই নষ্ট তাসের ঘর আর শোষিত মানুষের রক্তে গড়া প্রাসাদের ভেতর থেকে প্রতিবাদ করে বেরিয়ে আসবে- যেমন এসেছিল পৃথিবীর সব কবিরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App