×

মুক্তচিন্তা

ডাক্তার তুমি কার- রোগীর না ওষুধ কোম্পানির?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৪৮ পিএম

অনেক ডাক্তারের ভূমিকা থেকে তাদের ওষুধ বিক্রেতার চেয়ে বেশি কিছু ভাবা যায় না। ডাক্তাররা রোগীকে দিয়ে তাদের পছন্দমতো ওষুধ কিনতে বাধ্য করবে। কেননা একজন ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় অসহায় থাকে ও ডাক্তারকে সে বিশ্বাস করে। অনেক চিকিৎসকই রোগীর এই পবিত্র বিশ্বাসকে টাকা উপার্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের নাম লিখে, এমনকি অপারেশনও করে। যা আরো ভয়ঙ্কর।

মূলধারার চিকিৎসাব্যবস্থা পুঁজির সেবায় বিকশিত হয়েছে, মুনাফা করা যার মূল লক্ষ্য। চিকিৎসাব্যবস্থা আপনাআপনি মানবতার সেবা করে না, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন দিয়ে সেটা করতে তাকে বাধ্য করা হয়। চিকিৎসকদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনাও গুরুত্বপূর্ণ।

চিকিৎসকদের নৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনা এবং রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের শক্ত ভিত্তি ছাড়া মূলধারার চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে মানবতার সম্পর্ক সামান্যই। এ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো।

পুঁজি এমনই একটা শক্তি যাকে বিশ্বাস করা যায় না। সে প্রেম থেকে শুরু মানুষের জীবন পর্যন্ত সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করতে চেষ্টা করে। আর তাই আধুনিক উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত খাতে ছেড়ে দেয়া হয় না।

গুরুত্বপূর্ণ জনসেবার খাতসমূহ প্রধানত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলো ব্যক্তিগত খাতে ছেড়ে রাখলে তা অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। সৃষ্টি হয় ওষুধ কোম্পানির একাধিপত্য। কয়েকজন ব্যক্তির মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে মানুষের জীবন হয়ে পড়ে পণ্য।

যেসব দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এমন অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম হয়েছে, সেখানে যাদের সুযোগ আছে তারা চিকিৎসা নিতে অন্য দেশে পাড়ি দেয় যেখানে চিকিৎসাব্যবস্থা মাৎস্যন্যায়ের খপ্পড়ে পড়েনি। বাংলাদেশ থেকে একটা বিরাট সংখ্যক রোগী প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে যায় এজন্যই।

এর ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশি হাসপাতালগুলো আয় করে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো মূলধারার চিকিৎসাবিজ্ঞান সারাবিশ্বে একই, সব দেশে একই বই পড়ে সবাই ডাক্তার হয়। বাংলাদেশে আবার ইংরেজিতে লেখা বই পড়ে ডাক্তার হতে হয়, মাতৃভাষায় নয়।

একই বই পড়ে এ দেশে যারা ডক্তার হন, মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না কেন? রোগীরা যেন ঠেকায় পড়ে এ দেশের ডাক্তারের কাছে যায়, পয়সা ও সুযোগ থাকলে মনে হয় সবাই বিদেশ থেকে চিকিৎসা করে আসত। কেন? এই দুরবস্থার জন্য রোগী, না চিকিৎসাব্যবস্থা, কে দায়ী?

কে দায়ী তা বুঝতে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার মধ্যকার কয়েকটি গলদ প্রথমেই উল্লেখ করা যায়। সবার আগে বলা প্রয়োজন, আমাদের দেশের ডাক্তাররা রোগীর ভাষায় কথা বলেন না। তাদের কথা বলার নিজস্ব ভাষা আছে। তারা অনেকেই রোগীদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দেন, আর প্রেসক্রিপশন লেখেন যে ইংরেজি অক্ষরে তা বোঝার সাধ্য ইংরেজের বাপেরও নেই।

চিকিৎসকের কাছাকাছি দোকানের ওষুধ বিক্রেতা ছাড়া সাধারণত কেউ তা বোঝে না। স্পষ্টতই ডাক্তারের সবচেয়ে কাছের মানুষ ওষুধ বিক্রেতা। ওষুধ বিক্রেতার কাজ ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা। বোঝাই যাচ্ছে, ওষুধ বিক্রেতাকে মাঝখানে রেখে আমাদের দেশের বিরাটসংখ্যক ডাক্তার এই কাজটাই করেন। এ হচ্ছে সরল অঙ্কের হিসাব, একটু তলিয়ে দেখলেও ব্যাপারটা তাই দেখা যায়।

অবশ্য সমস্যাটা বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার একার নয়। সংকটটা মূলধারার চিকিৎসাব্যবস্থার গোড়ায়, তাই অন্যদেশেও কমবেশি বিদ্যমান। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পার্দু ফার্মা এলপির কথা উল্লেখ করা যায়।

এই ওষুধ কোম্পানির তৈরি অক্সি-কনটিন নামের ওপিয়ড অনেক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এ জন্য ২০০৭ সালে পার্দু ও তার তিন কর্মকর্তাকে ৬৩৪০ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হয়। এই ক্ষতিকারক ওষুধটি বিক্রি করে তারা আয় করেছে ৩১০০ কোটি ডলার। আসলে অন্যান্য ওষুধ কোম্পানি থেকে পার্দু তেমন আলাদা নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়ো-এথিকসের অধ্যাপক পিটার সিঙ্গার ৬ ফেব্রুয়ারি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে ‘ডার্টি মানি এন্ড টেইন্টেড ফিলানথ্রপি’ শীর্ষক একটি লেখায় পার্দু ফার্মার এসব অপকর্ম সম্পর্কে বলেছেন। অক্সি-কনটিনের ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল।

ওষুধের প্রচারণার অনেক সূক্ষ্ম ও গোপন কৌশল আছে। তার বিক্রয়কর্মীরা সভা-সম্মেলনের নামে ডাক্তারদের আকর্ষণীয় স্থানসমূহে বেড়াতে নিয়ে যেত। আলোচক হিসেবে তাদের সম্মানী দেয়ার নামে ঘুষ দেয়া হতো।

বিক্রয়কর্মীরা যে যে ডাক্তারের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের নাম দেখে তাদের কমিশন দেয়া হতো। ভালো বিক্রয়কর্মীর বোনাস ২ হাজার ডলারের উপরে হয়েছে।

আমাদের দেশে অবস্থা এরচেয়ে খারাপ। একটা ব্যক্তিগত ঘটনা বলি। একবার এক ডাক্তারের চেম্বার থেকে আমি বের হলাম। কয়েকজন রিপ্রেজেন্টেটিভ এসে আমাকে ঘিরে ধরল। এমন ঘটনা যে প্রায় সময়ই হয়, তা সবাই জানেন। তারা প্রত্যেকে আমার প্রেসক্রিশন দেখতে চান ও মোবাইলে ছবি তুলতে চান।

আমি দিতে চাচ্ছিলাম না। একজন খুব বেশি কাতরভাবে অনুরোধ করছিলেন। আমি তাদের একজনকে বললাম, ‘কেন আপনাকে এই প্রেসক্রিপশন দেখাব, বলেন। আপনারাই আমাদের রোগীদের সমস্যা।

কারণ ডাক্তার তো আমার রোগ সারানোর জন্য ওষুধ লেখে নাই, লিখেছে আপনার বলে দেয়া ওষুধগুলো। ওষুধ লিখেছে আপনার জন্য, আমার জন্য নয়।’

অনেক ডাক্তারের ভূমিকা থেকে তাদের ওষুধ বিক্রেতার চেয়ে বেশি কিছু ভাবা যায় না। শুধু তারা ক্ষমতায় একটু বেশি। ওষুধের দোকানের একজন বিক্রয়কর্মী আমি যা চাইব, তাই দিবে, বেশি বা কম নয়। কিন্তু ডাক্তাররা রোগীকে দিয়ে তাদের পছন্দমতো ওষুধ কিনতে বাধ্য করবে।

কেননা একজন ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় অসহায় থাকে ও ডাক্তারকে সে বিশ্বাস করে। অনেক চিকিৎসকই রোগীর এই পবিত্র বিশ্বাসকে টাকা উপার্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধের নাম লিখে, এমনকি অপারেশনও করে। যা আরো ভয়ঙ্কর।

২০০৬-এর ২৬ জুন গার্ডিয়ান পত্রিকায় সারা বোসলি লিখেছেন, ভোক্তা সংস্থাসমূহের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘কনজ্যুমার ইন্টারন্যাশনাল’ একটি গবেষণায় জানায় ওষুধ কোম্পানিগুলো গবেষণায় যে অর্থ ব্যয় করে তার দ্বিগুণ ব্যয় করে তাদের উৎপাদিত ওষুধ বাজারজাতকরণে।

যেসব কোম্পানিকে হিসেবে নেয়া হয়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে দেখা গেছে চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের প্রশ্নসাপেক্ষ সম্পর্ক। জার্মান ও ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষ ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের সঙ্গে ডাক্তারদের যোগসাজশমূলক দুর্নীতির তদন্ত করে।

দেখা গেছে, ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে এই ওষুধ কোম্পানিটি ডাক্তারদের ১৫৬০ লাখ ডলার দামের জিনিসপত্র অবৈধভাবে উপহার হিসেবে দিয়েছে।

আমাদের দেশের চিকিৎসায় অবস্থা এরচেয়ে ভালো হওয়ার কোনো কারণ দেখি না, খারাপ হতে পারে। ডাক্তার তুমি কার- প্রশ্নটির উত্তর তাই জরুরি। শিক্ষা-চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারের বিষয়সমূহে ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচার বন্ধ করে সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ হতে হবে মুখ্য।

আলমগীর খান : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App