×

মুক্তচিন্তা

আলোতে অন্ধকার এবং অন্ধকারে আলো

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৫ পিএম

বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করেনি, সমর্থন দেয়নি, বিরোধিতাই করেছে, তার আলোর নিচের অন্ধকার গ্রাস করে নিতে চেয়েছে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে। পারেনি। জয় হয়েছে সেই চেতনারই যাকে একদা দেখেছি আমরা সিপাহিদের সেই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে। বলার কি অপেক্ষা রাখে যে, রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন ও অগ্রগতি যা ঘটার তা মুক্তির আকাক্সক্ষা পরিচালিত বিদ্রোহের কারণেই ঘটেছে। আর রাষ্ট্রই তো প্রধান নিয়ন্ত্রক মানুষের সামাজিক জীবনের। তবে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিতরাও ছিল। আন্দোলন তো বরঞ্চ তারাই সূচনা করেছে, পরে তা বড় ও প্রবল হয়েছে জনগণকে সঙ্গে পেয়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, একাত্তরের যুদ্ধ সবারই ইতিহাস এটি। বুদ্ধিজীবী মিশেছেন জনগণের সঙ্গে, মিশেছেন বলেই তারা একে অসম্পূর্ণ, অন্যকে বাদ দিয়ে। বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে জনগণের ঐক্য দরকার, সামনের দিকে যাওয়ার জন্য।

পর্ব-২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাও ঘটেছে ব্রিটিশের হাতে এবং রাজনৈতিক কারণে। এ ছিল পূর্ববঙ্গবাসীদের জন্য একটি রাজনৈতিক ঘুষ। ১৯০৫-এ বঙ্গ বিভাগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজটি সম্ভব হয়নি, যে জন্য পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজের নেতারা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, তাদের খুশি করার অভিপ্রায়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলো। আয়োজনটা ছিল ছোট। তবে কেবল যে একটি সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট রাখা তা তো নয়, অভিপ্রায়টা ছিল অনুগত নাগরিক সৃষ্টিরও। সেটাই প্রধান।

ওই লাইনেই এগিয়েছে। প্রথমদিকে ভাইস চ্যান্সেলর ও চ্যান্সেলর উভয়েই থাকতেন ইংরেজ। পরে বাঙালি ভাইস চ্যান্সেলররা এলেন। কিন্তু তারা যে স্বাধীনচেতা মানুষ তৈরিতে উদ্যোগী ছিলেন তা মোটেই নয়। রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথা উল্লেখ করেছি। স্যার এ এফ রহমানও অত্যন্ত ইংরেজভক্ত ছিলেন। ছাত্ররা কোনো রকম রাজনীতি করবে এ তিনিও পছন্দ করতেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তৃতাগুলো পড়লে শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝা যায়। যেমন ধরা যাক, ১৯৩০ সালে দেয়া জাস্টিস এস এম সোলায়মানের সমাবর্তন বক্তৃতা। তিনি ভারতবর্ষীয়, কিন্তু কোনো সাহেব কোনো সমাবর্তন বক্তৃতায় যা বলেননি, তিনি তাই বলেছেন, ছাত্ররা যেন রাজনীতি থেকে দূরে থাকে।

বাঁশের চেয়ে কঞ্চি তেজী বটে। ১৯৩৬ সালে স্যার যদুনাথ সরকার তার বক্তৃতায় বলছেন, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অন্য কোনো সময়েই অর্ধসত্য ও মিথ্যা এতটা ক্ষতি করেনি, আজ যতটা করছে। কথার কথা নয়, তার বিশ্বাসের কথা। তবে সত্য বললে বলতে হয় যে মিথ্যা ও অর্ধসত্য তার ও তাদের লেখাতেই পেয়েছে ছাত্ররা।

১৯৪৮-এর সমাবর্তনের সময়ে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। সৃষ্টি করেছিলেন ভাইস চ্যান্সেলর স্বয়ং, তার বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। মুদ্রিত বক্তৃতার অক্ষরগুলো ভেদ করে তার উত্তেজনা ধ্বনি-প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে, ছাপা অক্ষরেও। এর কারণ ‘জাতির পিতা’ জিন্নাহ সাহেব স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন ওই সমাবর্তনে, সম্ভবত ভাইস চ্যান্সেলরের উৎসাহের কারণেই। আগস্ট মাসে ‘স্বাধীন’ হয়েছে দেশ, পরের বছর মার্চ মাসে অনুষ্ঠান হচ্ছে সমাবর্তনের।

উপাচার্য ড. মাহমুদ হাসান ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, কিন্তু সে দিন কি সাহিত্য কি ইংরেজি ভাষা সব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ অস্বীকার করেছেন তিনি, স্বাধীনভাবে ধ্বনি তুলেছেন, ইয়া কায়েদে আজম, ইয়া আমিরে পাকিস্তান বলে। তুলনায় জিন্নাহ সাহেব বরঞ্চ সংযত। কিন্তু সংযত ভাষায় ও ভঙ্গিতে তিনি যা বলেছেন সেই বক্তব্যে তেমন কোনো সংযম নেই, সেখানে রাষ্ট্রনায়কের বক্তব্যটি অত্যন্ত পরিষ্কার ও চাঁচাছোলা।

তিনি বললেন, ছাত্ররা, তোমরা দেখবে কোনো রাজনৈতিক দল যেন তোমাদের ব্যবহার করতে না পারে। বলেই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, তোমাদের কর্তব্য হলো মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করা, মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনেছে এবং সেই পাকিস্তানকে রক্ষা করবে, তোমাদের কাজ হবে তাকে সাহায্য করা। যেন মুসলিম লীগ একটি রাজনৈতিক দল নয়, যেন তার কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই।

উক্তির নিচে অনুক্ত থাকল আসল বক্তব্য : পাকিস্তানে রাজনীতি আমরা অর্থাৎ মুসলিম লীগাররাই শুধু করব, অন্য কারো সে অধিকার থাকবে না। তারপরেই চলে এল তার বিস্ফোরক বক্তব্যটি, যেটি তিনি রেসকোর্সের জনসভায় ইতোমধ্যেই প্রকাশ করেছেন।

সেটি হলো উর্দু এবং কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ছাত্রদের বললেন রাজনীতি না করতে। আবার বললেন মুসলিম লীগে যোগ দাও, তারপরে নিয়ে এলেন চূড়ান্ত রাজনৈতিক বক্তব্য একটি- উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।

যাদের বোঝার তারা বুঝল যে, বাঙালিদের জন্য এই স্বর স্বাধীনতার নয়, পরাধীনতার। ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদ গিয়েছে, কিন্তু অবাঙালি পাকিস্তানিদের প্রায় উপনিবেশবাদ চলে এসেছে। বাঙালি এক পরাধীনতা থেকে আরেক পরাধীনতায় নিক্ষিপ্ত হতে যাচ্ছে।

জিন্নাহ আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করেছিলেন তার ওই সমাবর্তন বক্তৃতাতে। তিনি দ্বিতীয় একটি পথনির্দেশ দিলেন ছাত্রদের। প্রথম নির্দেশের (ওই যে তোমরা রাজনীতি করো না, শুধু মুসলিম লীগ করো এই পরামর্শ) পাশে এটি তার দ্বিতীয় নির্দেশ।

তিনি বললেন, ছাত্ররা, তোমরা দেখো তোমাদের কাছে কী চমৎকার সুযোগ এসেছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করো। দৃষ্টান্ত হিসেবে করাচির একজন ব্যাংক ক্লার্কের কথা বললেন তিনি। এই যুবক বেতন পেত ২০০ টাকা, স্বাধীনতার পর এখন সে একটি ফার্মে যোগ দিয়েছে, বেতন দাঁড়িয়েছে ১৫০০ টাকা। এই রকম সুযোগ আজ তোমাদের দ্বারে সমুপস্থিত।

হাত বাড়িয়ে ধরে নাও। রাজনীতি করো না, মুসলিম লীগের সেবা করো, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মেনে নিয়ে গোলাম হয়ে যাও এবং নিজের তালে থাকো; বিদ্রোহ, বিপ্লব, মাথা তুলে উঠে-দাঁড়ানো, কিংবা সংলগ্ন হওয়া জনগণের সঙ্গে এসব করতে যেয়ো না, মৎস্য ধরিবে খাইবে সুখে; এর চেয়ে বেশি কী দরকার।

স্বাধীনতা এসেছে কিন্তু রাষ্ট্র চাইছে রাষ্ট্রের নাগরিকরা সিপাহি অভ্যুত্থানের ওই যে চেতনা, মুক্তির চেতনা, ওদিকে ধুয়েমুছে ফেলুক। অথচ স্বাধীনতা যে এসেছে সেটা গোলাম ও স্বার্থপরদের কারণে নয়, এসেছে অভ্যুত্থানের চেতনায় যারা উদ্দীপ্ত তাদের নিরন্তর সাধনায়; রাষ্ট্রবিরোধী গণআন্দোলন, বিপ্লবী যুবকদের তৎপরতা, নৌবাহিনীর বিদ্রোহ ইত্যাদির পথ ধরে।

কেবল জিন্নাহ সাহেব নন, ছোট ছোট জিন্নাহ সাহেবরাও সর্বদাই ওই একই পরামর্শ দিয়ে গেছেন, যখনই সম্ভব। ১৯৫৮-এর সমাবর্তনে দেখতে পাচ্ছি ইংরেজ উপাচার্য ড. ডব্লু এ জেনকিন্স গণতন্ত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন, অপরদিকে তার জবাবে প্রদেশের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর বিচারপতি আমীর উদ্দিন বলছেন, স্বাধীনতা প্রয়োজন নিশ্চয়ই, কিন্তু স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়; বলছেন, জ্ঞানের যারা চর্চা করবে তাদের সমাজের হৈচৈ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং দুঃখ করছেন এটা লক্ষ করে যে, শ্রেণি-পার্থক্যের চিহ্নগুলো সব সমান হয়ে যাওয়ায় বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার পক্ষে বিঘ্নের সৃষ্টি হচ্ছে।

ঠিক এর আগের বছরও মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল, উপাচার্যের সঙ্গে গভর্নরের। যদিও গভর্নর তখন অন্য কেউ নন, স্বয়ং এ কে ফজলুল হক। উপাচার্য বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য ছাত্রদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা নয়, যথার্থ মানুষ হিসেবে প্রস্তুত করা; জবাবে হক সাহেব বলেছেন, নাগরিক ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান নেই, ভালো নাগরিক মানেই ভালো মানুষ। অর্থাৎ তিনিও অনুগত ব্যক্তি চাইছেন, বিকশিত মানুষ চাইছেন না।

তবু থাকে। বিদ্রোহ থাকে, থাকে সিপাহি অভ্যুত্থানের ওই চেতনা। জিন্নাহ সাহেব যখন বলছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা- তখন সঙ্গে সঙ্গে এই স্বতঃস্ফূর্তরূপে প্রতিবাদ উঠেছে, ‘না, না’ বলে ধ্বনি তুলেছে ছাত্ররা। সবাই নয়, একাংশ। তবে সেই একাংশ পরে বড় অংশে পরিণত হয়েছে; ছোট্ট ওই ‘না’ অত্যন্ত বৃহৎ হয়ে উঠেছে; রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ- এভাবে ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে ভেঙে ফেলেছে পাকিস্তান নামক অত্যাচারী রাষ্ট্র যন্ত্রটিকে, স্বাধীন হয়েছে দেশ।

বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দ করেনি, সমর্থন দেয়নি, বিরোধিতাই করেছে, তার আলোর নিচের অন্ধকার গ্রাস করে নিতে চেয়েছে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে। পারেনি। জয় হয়েছে সেই চেতনারই যাকে একদা দেখেছি আমরা সিপাহিদের সেই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে। বলার কি অপেক্ষা রাখে যে, রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন ও অগ্রগতি যা ঘটার তা মুক্তির আকাক্সক্ষা পরিচালিত বিদ্রোহের কারণেই ঘটেছে। আর রাষ্ট্রই তো প্রধান নিয়ন্ত্রক মানুষের সামাজিক জীবনের।

তবে ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিতরাও ছিল। আন্দোলন তো বরঞ্চ তারাই সূচনা করেছে, পরে তা বড় ও প্রবল হয়েছে জনগণকে সঙ্গে পেয়ে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, একাত্তরের যুদ্ধ সবারই ইতিহাস এটি। বুদ্ধিজীবী মিশেছেন জনগণের সঙ্গে, মিশেছেন বলেই তারা একে অসম্পূর্ণ, অন্যকে বাদ দিয়ে।

বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে জনগণের ঐক্য দরকার, সামনের দিকে যাওয়ার জন্য। এ ঐক্য রাষ্ট্র চায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ও চায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস তো বরঞ্চ উল্টো কাজের কাজী, সে কাজ বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ সৃষ্টির অভিপ্রায় দ্বারা বিশিষ্ট। অন্ধকারের নিচে যে আলো আছে তার সম্ভাবনা বিকশিত হবে না আলোকিত জনের আনুকূল্য না পেলে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App