×

অর্থনীতি

সাভার চামড়া শিল্প নগরী স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ২০ হাজার শ্রমিক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:১৮ এএম

সাভার চামড়া শিল্প নগরী স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ২০ হাজার শ্রমিক
গত বছরের অক্টোবরে সাভারের চামড়া শিল্প এলাকার মিতালী ট্যানারিতে দুর্ঘটনাবশত সালফিউরিক এসিডের একটি ব্যারেল ভেঙে এসিড ছড়িয়ে পড়ে। এতে চারজন শ্রমিক দগ্ধ হন। ট্যানারি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার জন্য আনা হয় তাদের। তীব্র যানজট ঠেলে হাসপাতালে পৌঁছাতেই পেরিয়ে যায় চার ঘণ্টা। ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আহত হাসেম আলী (৩৫)। মিতালী ট্যানারির শ্রমিক মিলন হোসেন বলেন, এই চারজন এসিডে দগ্ধ হওয়ার পর কী করব, কোথায় যাব তা নিয়ে সবাই দিশাহারা হয়ে পড়ে। কাছাকাছি কোনো ওষুধ এবং চিকিৎসক ছিল না। আমরা আহতদের ওপর প্রচুর পানি ঢেলেছিলাম, কিন্তু তা যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছিল না। সম্ভবত দ্রুত চিকিৎসা দিতে পারলে হাসেম মারা যেত না। চামড়া শিল্প নগরীর মধ্যে কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা সুবিধা না থাকায় এর আগেও অনেক শ্রমিক এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। ট্যানারিতে এ রকম দুর্ঘটনা খুবই সাধারণ বিষয়। কারণ এখানে শ্রমিকরা কোনো ধরনের নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করেন। কোনো কারণে আহত হলে চিকিৎসার জন্য তাদের শিল্পাঞ্চলের বাইরে যেতে হয়। আর পথে কোনো কারণে দেরি হলে সেটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রসঙ্গত, রাজধানীর লাইফলাইন বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হাজারীবাগের অধিকাংশ ট্যানারি সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয় সরকার। গত কয়েক বছরে ধলেশ্বরীর তীরে অবস্থিত হরিণধারায় ২০০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্প নগরীতে ১৫৫টি ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর করা হয়েছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১৯টি কারখানা উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। যেখানে মোট ২০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। তবে যে প্রকল্পের অধীনে কারখানাগুলো সরানো হয়েছে, সেখানে কোনো হাসপাতালের পরিকল্পনা ছিল না। ছিল না শ্রমিকদের আবাসনের কোনো ব্যবস্থাও। স¤প্রতি চামড়া নগরীর বিভিন্ন কারখানা ঘুরে দেখা যায়, শ্রমিকরা কাঁচা চামড়া লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করছেন। আবার বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের দ্রবণে চামড়া ভিজিয়ে রাখছেন। এ সময় অনেককেই কোনো ধরনের গ্লাভস এবং জুতা ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক বলেন, আমাদের কাজ খুবই বিপজ্জনক। ছয় মাস আগে রাসায়নিকের ট্যাঙ্ক পড়ে দুজন শ্রমিক নিহত হয়। তাদের দ্রæত চিকিৎসার ব্যবস্থার করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। তা ছাড়া চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করলেও দুর্ঘটনার জন্য নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। অক্টোবার ৩ তারিখের দুর্ঘটনায় আহত সুমন বলেন, ট্যানারি মালিক নিহত হাসেমের পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং আহত অন্য তিনজনকে মাত্র ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এরপর আমরা আর কোনো টাকা পাইনি। যদিও বেশ কিছু দিন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি থাকতে হয়েছিল। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে অন্য একটি কারখানায় দুর্ঘটনায় ডান হাত হারান বাবুল হোসেন। তিনি বলেন, আমার চিকিৎসায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দুর্ঘটনার পর মালিক কথা দিয়েছিলেন আমাকে কিছু টাকা দেবেন। কিন্তু এখন আর তিনি আমার ফোনই ধরেন না। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ওই কারখানার মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় অক্ষম হলে তার নিয়োগদাতা তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা দিবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ২০১৭ সালে চামড়া কারখানা সাভারে স্থানান্তরের পর বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ৬ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে এবং ৩০ জন বিভিন্ন পর্যায়ের আহত হয়েছেন। তবে এদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। সরকারের কারখানা ও স্থাপনা পরিদর্শন বিভাগের (বিআইএফই) কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এই ধরনের তথ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। বিআইএফই-এর সহকারী মহাপরিচালক (পরিদর্শক) জাকির হোসেন বলেন, ট্যানারিতে অনেক সমস্যা আছে। আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে পারছি না। দ্রæত জনবল বাড়ানোর জন্য আমরা পরিকল্পনা করছি। বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, চামড়া এবং পাদুকা রপ্তানিকারক সমিতির (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন মাহিনের কাছে এ বিষয়ে তথ্য চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা মাত্র ৩০টি কারখানার প্রতিনিধিত্ব করি। যার কারণে অনেক সময় সব দুর্ঘটনার খবর আমরা রাখতে পারি না। বাংলাদেশ ওকুপেশনাল সেফটি, হেলথ এন্ড এনভাইরোনমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ওশি) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, ১ লাখ ২৯ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চামড়া শিল্পে কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ কর্মী কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশ প্রায়ই ত্বকের পোড়া, শরীরের ব্যথা এবং খিটখিটে মেজাজ, এলার্জি, জ্বর, আলসার, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, চোখে কম দেখা এবং মাথা ব্যথাসহ ২০ ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। যাদের এই শিল্পে কমপক্ষে আট বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ১০৫ জন কর্মীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করে ওশি। গবেষণা দলের প্রধান গবেষক শারমিন সুলতানা বলেন, আইন প্রয়োগ ও পরিদর্শনের ক্ষেত্রে শিথিলতা প্রদর্শন এবং রাসায়নিক পদার্থ ও যন্ত্রাদি পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জ্ঞানের অভাব তাদের স্বাস্থ্যের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। এদিকে, চামড়াশিল্প নগরীতে শ্রকিদের কোনো আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শ্রমিককে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় থাকতে হয়। যদিও গত বছরের ৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্যানারি মালিক এবং কর্তৃপক্ষকে সময়ক্ষেপণ না করে দ্রæত শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। শ্রমিকদের আবাসন, চিকিৎসা, ভালো মজুরি এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনের লক্ষে ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ট্যানারস এসোসিয়েসনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্বারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। গত বছরের মে মাসে স্বাক্ষরিত এমওইউ অনুযায়ী, একজন নতুন শ্রমিক ১২ হাজার ৩৮১ টাকা এবং একজন দক্ষ শ্রমিক মাসে ২৩ হাজার টাকা মজুরি পাবে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, কারখানাগুলোতে কর্তৃপক্ষের অগ্নি নিবারণ ব্যবস্থা স্থাপনের কথা থাকলেও এখনো হয়নি। চলতি বছরের জুনে ট্যানারিগুলো স্থানান্তরিত করার প্রকল্প শেষ হলে শিল্প নগরীর অভ্যন্তরে একটি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা হবে। বেশ কয়েকটি ট্যানারি মালিক জানান, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) শিগগিরই শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদি গড়ে তুলবে। বিসিক সূত্র জানায়, তারা ইতোমধ্যেই হাসপাতাল, স্কুল ও অন্যান্য সুবিধাদি গড়ে তুলতে সরকারের কাছে ১৫০০ কোটি টাকা দাবি করেছে। বাংলাদেশ ফিনিশেড চামড়া, চামড়া ও জুতা রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ মহিন জানান, তারা শিগগিরই শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন এবং আবাসন সুবিধাগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সহযোগিতা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App