×

জাতীয়

সমন্বয়হীন দুই প্রতিষ্ঠান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:০৬ পিএম

সমন্বয়হীন দুই প্রতিষ্ঠান

বুড়িগঙ্গা নদীর সীমানা জরিপ করে খুঁটি স্থাপন করা হলেও বিআইডবিøউটিএর উচ্ছেদ অভিযানে তা গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার তোলা ছবি-ভোরের কাগজ

বেশ কয়েক বছর আগে নদীর সীমানা জরিপ করে আরসিসি পিলার বা ঢালাই করা খুঁটি স্থাপন করেছিল ঢাকা জেলা প্রশাসন ও গণপূর্ত বিভাগ। এখন সে সীমানাই মানছে না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবি্ল উটিএ)। উচ্ছেদ অভিযানে গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে খুঁটির কয়েক’শ ফুট বাইরে থাকা স্থাপনাও। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন স্থানীয়রা। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া উচ্ছেদ অভিযানের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অবশ্য বিআইডবি্লউটিএ বলছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ীই এ উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। বেশ কিছু সীমানা খুঁটি ভুল জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল। আবার কিছু খুঁটি সরিয়ে ফেলেছিলেন দখলদাররা। এখন সেগুলো নতুন করে যাচাই-বাছাই করে সঠিক জায়গায় স্থাপনের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা নদীবন্দরের আওতাধীন ১৪টি সার্কেলের মধ্যে ৬টি সার্কেলের এলাকায় এই কাজ সম্পন্ন হওয়ায় সে অনুযায়ীই স্থাপনাগুলো ভাঙা হয়েছে। বাকি সার্কেলের জরিপ শেষেও একইভাবে অভিযান চালানো হবে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সীমানা নিয়ে মূল বির্তক দেখা দিয়েছে পুরান ঢাকার পার্শ্ববর্তী কামরাঙ্গীর চর, ইসলামবাগ, কামালবাগ, খোলামোড়াসহ বেশ কিছু এলাকায়। এখানে নদীর সীমানা জরিপে কোন মানচিত্র অনুসরণ করা হবে-এ বিষয়ে শুরু থেকেই কোনো সমন্বয় ছিল না জেলা প্রশাসন ও বিআইডবি্লউটিএর মধ্যে। ঢাকার চারপাশের নদ-নদী রক্ষার দাবিতে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতে পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা ও হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি রিট করা হয় (রিট নং-৩৫০৩)। সে পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ আমলের সিএস বা বাংলাদেশ আমলের আরএস ম্যাপ অনুযায়ী নদীর সীমানা চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন আদালত। নির্দেশনায় বলা হয়, নদীর স্বার্থ যেখানে যে ম্যাপে বেশি সংরক্ষিত হবে সেখানে সেই ম্যাপ অনুসরণ করতে হবে। এ রায়ের পর বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার তীর চিহ্নিত করে ৯ হাজার ৫৭৭টি সীমানা পিলার স্থাপন করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন। তখন খুঁটিগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ভেঙে বা সরিয়ে ফেলে অনেক দখলদার। পরে গণপূর্র্ত বিভাগের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের তীরে ৪ হাজার ৬৩টি ও শীতলক্ষ্যার তীরে আরো ৫ হাজার ১১টি খুঁটি স্থাপন করা হয়। তবে এর মধ্যে ২ হাজার ১৯৮টি পিলারের সীমানা নিয়েই আপত্তি তোলে বিআইডবি্লউটিএ। সংস্থাটি ২০০৬ সালে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে করা নদীর তীরভূমির (ফোরশোর ম্যাপ ২০০৬) মানচিত্র অনুসরণের দাবি জানায়। দুই সংস্থার সমন্বয়হীনতায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে : কামরাঙ্গীর চরের হুজুরপাড়া এলাকায় শেখ রাসেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে সীমানা খুঁটি অতিক্রম না করা বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙতে দেখা যায়। একই দৃশ্য দেখা যায় ইসলামবাগ এলাকাতেও। গুঁড়িয়ে দেয়া ওইসব স্থাপনার মধ্যে ৭ তলা ভবন পর্যন্ত ছিল। এদিকে গত বুধবার ভাঙা হয় কামরাঙ্গীর চরের ঝাউচরে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলের শ^শুরের তিন তলা বাড়িটি। তবে এসব স্থাপনার মালিক কেউই নদী দখল করেছেন বলে মানতে নারাজ। কাজল জানান, তার শ্বশুর ১৯৬২ সালে জমিটি কেনেন। নামজারি, খাজনাপত্রও চালু রয়েছে তাদের। একই কথা জানান, ইসলামাবাগের ইসহাক মিয়া। তিনি জানান, তার বাবা ১৯৮১ সালে তিন কাঠা জমি কিনেছিলেন এখানে। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে কোনো বেড়িবাঁধ ছিল না। বেড়িবাঁধ নির্মাণের সময় তাদের ১ কাঠার মতো জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। ক্ষতিপূরণও পান তারা। কিন্তু এর কিছুদিন পর বিআইডবি্লটিএ তাদের দালানের একাংশ ভেঙে দেয়। এরপর সীমানা খুঁটি স্থাপন করে গণপূর্ত বিভাগ। আবার গত কয়েকদিন আগে সে খুঁটির ভেতরে থাকা স্থাপনাও ভেঙে দেয়া হয়। এতে তার মতো অনেক বাসিন্দা সর্বস্বান্ত হয়েছেন বলে জানান তিনি। জটিলতার পেছনের কারণ : বুড়িগঙ্গার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৯৭ সালে অথবা মতভেদে তারও আগে ১৭৬২ সালের ভূমিকম্পের ফলে সলমাসি, কলাতিয়া, মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ এলাকা দিয়ে প্রবাহমান বুড়িগঙ্গা কিছুটা দক্ষিণে সরে যায়। তখন তলদেশের গঠনগত পরিবর্তন হওয়ায় নদীতে পলি পড়ার গতিও বেড়ে যায়। ফলে মাঝখানে জেগে উঠতে থাকে চর, যার একটি অংশ পরবর্তী সময়ে কামরাঙ্গীর চর ও আরেকটি অংশ নবাবগঞ্জ চর হিসেবে পরিচিত হয়। পরবর্তী সময়ে আদি চ্যানেলে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় দখলদারদের কবলে পড়ে নদীর এ অংশটি। আর দক্ষিণের ধারাটিই বর্তমান মূল বুড়িগঙ্গা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখন বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে গিয়ে আদি ম্যাপ অনুসরণ করা হলে তা মূলত ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া নদীর জমি উদ্ধারকেই বোঝায়। যেখানে শত শত বছর ধরে গড়ে উঠেছে বিশাল জনপদ। এখানকার বাসিন্দাদের জমির মালিকানা, নামজারি, খাজনা ইত্যাদিও চালু রয়েছে সরকারিভাবেই। অন্যদিকে বর্তমান বুড়িগঙ্গা উদ্ধার করতে গিয়ে ১৯০৮ সালের বন্দর আইন অনুসরণ করতে হচ্ছে বিআইডবিøউটিএকে। এ আইনে তীরভ‚মি উদ্ধারের বাইরে অন্য কোনো জমি উদ্ধারের সুযোগ নেই সংস্থাটির। অর্থাৎ আদি বুড়িগঙ্গা উদ্ধার করতে হলে বিস্তর জনপদ উচ্ছেদ বা প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করতে হবে। আর বর্তমান বুড়িগঙ্গা উদ্ধার করতে হলে নদীর তীর ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি দখলমুক্ত করতে হবে। সেটি করলে আদি চ্যানেলটি আবার উদ্ধারের আওতার বাইরে থেকে যাবে। বন্দর আইন ও বাস্তব অবস্থা : ১৯০৮ সালের বন্দর আইন অনুযায়ী জোয়ারের সময় নদী পানি যে সীমানায় পৌঁছে তাকে বলা হয় হাই-ওয়াটার মার্ক এবং ভাটার সময় যে সীমানায় নামে তাকে বলা হয় লো-ওয়াটার মার্ক। হাই-ওয়াটার মার্ক পর্যন্ত সীমানায় কোনো স্থাপনা করা বেআইনি। আর এর বাইরে ৫০ মিটার বা ১৫০ ফুট এলাকা পর্যন্ত বন্দরের সীমানা। সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে স্থাপনা বা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড মিটফোর্ড থেকে গাবতলী পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করায় এখন আর নদীর জোয়ার ভাটা ধরে সীমানা নিধারণ করা সম্ভব নয়। তাই ২০০৬ সালে করা বুড়িগঙ্গার তীরভ‚মির একটি মানচিত্রকে নদীর সীমানা বলে নির্ধারণ করছে বিআইডবি্লউটিএ। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ফলে প্রকৃত নদীর সঙ্গে আর মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই মানচিত্রের। দেখা গেছে, কামরাঙ্গীচরে বা ইসলামবাগে যেখানে মানচিত্রে নদীর তীর দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে সেখানে নদী নেই। ওই এলাকা মূলত বাঁধের ভেতরের জনপদ। সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : বিআইডবিøউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক বলেন, নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেখানে আমাদের কিছু করার নেই। প্রথমে স্থাপিত কিছু খুঁটি নিয়ে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। ফলে সেগুলো সঠিক জায়গায় বসানো হয়েছে। তিনি বলেন, এখন সব সংস্থার সমন্বয়েই সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী অভিযান চালানো হচ্ছে। আর ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, কোন এলাকায় সীমানা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে তা ম্যাপ না দেখে স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App