×

মুক্তচিন্তা

বিকল্পহীন বিকল্পহীনতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:০১ পিএম

তিনিই আমাদের সেই নেতা, যিনি বাংলা ও বাঙালির আশার প্রতীক। সে ভরসার দীপ নিভে গেলে দুঃখের শেষ থাকবে না। তাই তার আলো ও পথ বহন করার মতো নেতা চাই। এ দায়িত্ব আওয়ামী লীগের। এ দায়িত্ব রাজনীতির। বিরোধী দলের ভেতরও সে ধরনের কোনো নেতা নেই। তাই রাজনীতির বর্তমান শূন্যতা পূরণ করে আগামী দিনের নেতা তৈরি হোক, এখন থেকে সে কাজ শুরু হোক।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তার শেষ মেয়াদ, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না- ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চান তিনি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। এখন তিন দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী জার্মানিতে আছেন।

তার এই ঘোষণা আন্তরিক বলেই ধরে নেয়া যায়। কারণ কিছুদিন আগে অর্থাৎ নির্বাচনের আগে যখন সিডনি সফরে আসেন তখন নাগরিক সংবর্ধনার নামে এখানকার আওয়ামী লীগের সভায়ও এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। বক্তাদের কেউ কেউ আদাজল খেয়ে তাকে চিরজীবন প্রধানমন্ত্রীর আবেদন জানাতে গেলে তিনি মাথা নেড়ে ঘন ঘন না না বলছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল তিনি তা পছন্দ করেননি।

সাধুবাদ জানাব এই কারণে, শেখ হাসিনা এ বিষয়েও প্রাজ্ঞ দূরদর্শী। আজীবন থাকার মতো একনায়কোচিত ব্যবহার তাকে মানায় না। তাই তিনি সহাস্যে তা প্রত্যাখ্যান করছিলেন। নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন বা সরকারপ্রধানের পরিবর্তন গণতন্ত্রে একটি স্বাভাবিক বিষয়। আমাদের দেশের রাজনীতি তা না মানলেও, এটাই নিয়ম। রাজনীতি যদি সচল ও একমুখী না হয়, তো এই পরিবর্তন জরুরি।

কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে কথিত বিরোধী দল তা হতে দেয় না। আমি কখনো বিএনপির হয়ে লিখি না। তাদের ইতিহাস বিকৃতি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মশকরা, একগুঁয়েমির রাজনীতি দেশে এক ধরনের অস্থিরতা আর বিকল্পহীনতা তৈরি করে রেখেছে। তারা বুকে হাত দিয়ে বলুক তো তাদের নেতা হিসেবে বয়োবৃদ্ধা খালেদা জিয়া বা তার ছেলে তারেক রহমানের বাইরে কাউকে মনে করতে পারে? মানবে কেউ? মানবে না। এটাই নিয়ম আমাদের দেশে। মা গেলে ছেলে, ছেলে গেলে হয় তার সন্তান বা আত্মীয় কেউ। পাকিস্তানে ভুট্টোর দলেও একই নিয়ম। বাবা, মেয়ে অতঃপর মেয়ের জামাই। এখন সবাই উধাও। ভারতের কংগ্রেসেও সে ধারা। নেহেরু, নেহেরুর মেয়ের পর তার ছেলে, এখন দৌহিত্র বা নাতনির পালা।

এতে কী হয়েছে? তাদের কেউই সরকারপ্রধান হতে পারছেন না। কারণ মানুষ হয়তো তা চাইছেন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা আর একমুখী রাজনীতির পরও শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। তিনি না থাকলে কী হবে বা কী হতে পারে, ভাবাই কঠিন।

এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। গণতন্ত্রের মূল ভাবনা যা, তা থাকলে আজ আমরা এটাকে বিষয় মনে করতাম না। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি তা হতে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো এমন কোনো নেতা নেই, যিনি বা যারা শেখ হাসিনার পরিবর্তে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হতে পারেন। ক্রমাগত নিজেকে একক করে তোলা শেখ হাসিনা আজ দেশ-বিদেশে সমাদৃত এক নেতা। এটা তার অর্জন।

আমাদের খুব মনে আছে, এই সে দিনও স্বাধীনতাবিরোধীরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে তারা দেশকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করত। সে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার মতো কেউ ছিলেন না। ভরসা হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার। আগে আমরা জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামালদের পেলেও তারা সরাসরি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তাদের কোনো দল ছিল না। ছিল না সাংগঠনিক ভিত্তি।

সে কারণে লাখো লাখো মানুষের অংশগ্রহণের পরও আন্দোলন বা তার ফসল ঘরে তোলা যেত না। মানতেই হবে, রাজনীতির শক্তি ছাড়া এ কাজ করা অসম্ভব। সে রাজনৈতিক শক্তি ও সাহস আছে আওয়ামী লীগে। কিন্তু তার ব্যবহার ছিল না। বুকের সাহসকে সম্বল করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যে কাজ করে দেখালেন, তা ইতিহাসে চিরকাল লেখা থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি সহজ কিছু ছিল না। দেশ-বিদেশে লবিং, টাকা আর জঙ্গিবাদের জোরে সে প্রক্রিয়া বন্ধ করার অপচেষ্টা কে ঠেকাতে পারত? বঙ্গবন্ধুকন্যা বাবার তেজ আর উত্তরাধিকার বুকে নিয়ে তা করেছেন। বিএনপির কথা ভাবুন। সোজা পথ ছেড়ে তারা বেছে নিয়েছিল চোরাপথ। আগুন-সন্ত্রাস আর মানুষ মারার ভয় দেখিয়ে তারা কাবু করতে পারেনি তাকে।

পাশাপাশি দেশকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যাওয়া সহজ কিছু ছিল না। কত ধরনের আপদ। দুর্নীতি, কারচুপি, দলের ভেতর নেতাদের খাই খাই মনোভাব- সব মিলিয়ে বাংলাদেশ সবসময় এক অগ্নিকুণ্ড। সে আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে হাজির করেছেন নতুন রূপে। যে কারণে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ প্রশংসা ও ভালোবাসায় ভাসছে। এ আনন্দ, এ গর্ব আমরা জীবদ্দশায় দেখে যাব ভাবিনি। তিনি তা করে দেখিয়েছেন। কী করে তাকে বিদায় বলব আমরা?

কিন্তু বাস্তবতা এই, তার বয়স বাড়ছে। ক্লান্তি এখনো অদৃশ্যমান হলেও, নিশ্চয়ই আছে কোথাও। জানি না তার মুখের মতো ভরসার মুখ কোনটি? কেউ বলছেন শেখ রেহানা, কেউ বলছেন অন্য কেউ। বঙ্গবন্ধু পরিবারের বাইরে আওয়ামী লীগের যাওয়ার সময় হয়নি। তা তারা পারবেও না। কারণ যতদিন ঐক্য আর বলিষ্ঠতার দরকার, ততদিন এর বিকল্প নেই। জানি অনেকে আমাকে একচোখা বা পরিবারতন্ত্রের সমর্থক বলে গাল দেবেন। তাদের সংখ্যা আমার জানা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি দার্শনিক পল এস বার্কের সেই বাণীর অন্যথা হওয়ার না। তিনি মনে করতেন চেঞ্জ চেঞ্জ চেঞ্জ ইজ লাইফ। পরিবর্তনশীলতাই জীবন।

সাধারণত পরিবর্তন ভালো কিছু বয়ে আনে। যদি তা হয় সঠিক। শেখ হাসিনা সত্যি যদি যানও এখনো সময় আছে হাতে। এ সময় দীর্ঘ মনে হলেও বেশি নয়। কারণ দেশ বা কাজ থেমে থাকবে না। কাজ করতে করতে সন্ধ্যা এসে হানা দেবে দুয়ারে। তিনি দেশকে বিদ্যুতের আলোয় ভরে দিচ্ছেন বটে, মানুষের মনে মনে আদর্শ ও ভালোবাসার আলো এখনো জ্বলে ওঠার কাজ বাকি। সমাজে এখনো অন্ধকার, হানাহানি আর মনোবিকার। খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতির মূল পৃষ্ঠপোষক রাজনীতি। দলে, দলের বাইরে ঘাপটি মারা পাকি আর দালালের সংখ্যাও কম নয়। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার, এক ধরনের সুশীল নামধারীদের আচরণ।

এরা নিজেরা ভালো থাকে, নিজেরা উদার জীবনযাপন করে, নিজেরা ভারত-আমেরিকার সেবাদাস, সন্তানদের সেসব দেশে পড়ায়, থাকতে দেয় আর দেশে ঠিক তার উল্টো রাজনীতি করে। এদের বোঝা মুশকিল। খেয়াল করবেন শুরু থেকে এই তিনবারের শাসনে তিনি কখনো তাদের সমর্থন পাননি। শুধু পাননি বললে ভুল হবে, পেয়েছেন বিরোধিতা আর অসম্মান। এরা সব ধরনের চেষ্টা জারি রেখেছে।

যার হাতে যা আছে, সে মিডিয়া বা অস্ত্র নিয়ে তার বিরোধিতা করাই এদের পবিত্র কাজ। কুৎসা, মিথ্যা আর ভয়- সব কিছুর এস্তেমাল করেও তারা শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেনি। তিনি যে পাত্তা দেননি বা দিতে চাননি, সে সাহস আর বুকের বল আছে অন্য কারো? এখন তো তেমন কোনো প্রমাণ পাইনি। তাই আমাদের ভয় যায় না।

অনুরোধ একটাই, আপনি যদি চলে যানও এমন কাউকে মনোনীত করুন, যার কাছে দেশ ও প্রগতিশীলতা নিরাপদ। জানি আবারো অনেকে আঙুল তুলবেন। শেখ হাসিনার নানা কর্মকাণ্ডের কিছু দিক নিয়ে কথা তুলবেন। অস্বীকার করি না। হেফাজত-ব্লগার হত্যায় মাঝে মাঝে সমঝোতার নামে আপসী মনোভাব আছে। কিন্তু খতিয়ে দেখুন তো কারা দায়ী? কী কারণে সরকারপ্রধানকে এমন কাজে হাত দিতে হয়? দেশ ও সমাজকে আপনারা ইচ্ছেমতো অপব্যবহার করবেন, উসকে দেবেন, মানুষকে বিধ্বংসী করে তুলবেন- সরকার কী করবে? জানমালের নিরাপত্তা না দিয়ে তারা ঘরে বসে থাকবে?

তখন তো আপনারাই বলতেন, এ কেমন সরকার? যারা নিজেরা দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে পারে না? এই শাঁখের করাতে ফেলে দেয়া সরকার যা করার তাই করেছেন শেখ হাসিনা। তারপরও তিনিই আমাদের সেই নেতা, যিনি বাংলা ও বাঙালির আশার প্রতীক। সে ভরসার দীপ নিভে গেলে দুঃখের শেষ থাকবে না। তাই তার আলো ও পথ বহন করার মতো নেতা চাই। এ দায়িত্ব আওয়ামী লীগের। এ দায়িত্ব রাজনীতির। বিরোধী দলের ভেতরও সে ধরনের কোনো নেতা নেই। তাই রাজনীতির বর্তমান শূন্যতা পূরণ করে আগামী দিনের নেতা তৈরি হোক, এখন থেকে সে কাজ শুরু হোক।

শেখ হাসিনার মেধা ও প্রজ্ঞায় বিশ্বাস রাখি বলেই বলি, তিনি যদি সত্যি যান নিশ্চয়ই আমাদের নতুন কোনো বাঘ বা পুরনো দৈত্যের মুখে রেখে যাবেন না। শেখ হাসিনা আপনার কোনো বিকল্প যে এখনো তৈরি হয়নি। কোথায় ভরসা পাব আমরা?

অজয় দাশগুপ্ত: কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App