×

বিশেষ সংখ্যা

বাংলা সংস্কৃতির উত্থান-পতন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৬:১৯ পিএম

বাংলা সংস্কৃতির উত্থান-পতন

আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে অবস্থিত কয়েকটি বিষয়, যথা- চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক, নৃত্য ও সঙ্গীত নিয়ে অল্প পরিসরে কিছু কথা এই নিবন্ধে উপস্থাপন করা হলো। এই বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করা ও অধিক উদাহরণসহ বলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যারা পরবর্তীতে সংস্কৃতির ধারক-বাহক হবেন তাদের জন্য জেনে থাকা ভালো যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া কাজের চেয়ে স্থায়ীভাবে টিকে থাকার কাজ করা অনেক ভালো। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, নতুন নতুন ভাবনা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে। প্রতিশ্রুতিশীল অনেক তরুণই এইসব মাধ্যমে কাজ করছেন। তারা আমাদের সংস্কৃতিকে আরও বিকশিত করবেন, আরও সমৃদ্ধ করবেন বলেই বিশ্বাস।

বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলেও পুরোপুরি প্রতিকূলে আছে তা বলা যাবে না। প্রাকৃতিক আকাশের ন্যায় সাংস্কৃতিক আকাশেও কখনো কখনো কালো মেঘ দাপটের সঙ্গে দুর্যোগ দাবড়িয়ে বেড়ায়, কখনো আবার ঝলমলে রোদের নির্মল নির্ভেজাল রশ্মিতে ভরপুর থাকে।

প্রাকৃতিক আকাশে যেমন কিছু আবর্জনা উড়ে বেড়ায় তেমন সাংস্কৃতিক আকাশেও আবর্জনার অন্ত নেই। ভালো-মন্দ, আলো-আঁধার বুঝে নেয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পর অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। একটি দেশের অস্তিত্ব অনেকখানি নির্ভর করে সে দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎকর্ষতার পরিমাপে।

সুতরাং সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক চর্চা গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। জীবনের অস্তিত্ব যেমন খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানে, দেশের অস্তিত্ব তেমনই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। এই তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিলে তার ভেতরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে সততা, নৈতিকতা, সহানুভূতি-সহমর্মিতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি।

এখানে আমি কেবল সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের কথা সংক্ষেপে বলছি। আমাদের সংস্কৃতির একটি বিরাট অংশজুড়ে আছে চলচ্চিত্র। একটা সময় চলচ্চিত্র আর যাত্রাপালাই ছিল বাঙালির প্রধান বিনোদন মাধ্যম। এখন যাত্রাপালা বন্ধের উপক্রম। রহিম বাদশা, রূপবান কন্যা, গুনাইবিবি, আলোমতি- এসব নামকরণ ছাপিয়ে এলো সিরাজুদ্দৌলা, শাহজাহান প্রভৃতি ইতিহাসনির্ভর যাত্রাপালা।

মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আকর্ষণ বোধকরি এখন আর চোখে পড়বে না। কালের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে এসব প্রেম আখ্যান, সামাজিক আখ্যান বা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত আখ্যান-উপাখ্যান। এসব কাহিনী চলচ্চিত্রেও রূপদান করা হয়েছে এবং জনপ্রিয় হয়েছে।

এরপর অনেকটা আধুনিক হিসেবে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে- জীবন থেকে নেয়া, ময়নামতি, অবুঝ মন, সারেং বউ, হাঙর নদী গ্রেনেড, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, দুই পয়সার আলতা, ভাত দে, গোলাপী এখন ট্রেনে, ছন্দ হারিয়ে গেল, কাচের স্বর্গ, নাচের পুতুল, বধূ বিদায়, আলোর মিছিল- এমন কত না চলচ্চিত্র।

মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, সংগ্রাম, ওরা ১১ জন প্রভৃতি। এরপর আরও পরে পরিপক্করূপে তৈরি হয়েছে আগুনের পরশমণি, জয়যাত্রা প্রভৃতি ছবি। দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটেছে।

জীবনযাত্রা আরও উন্নত হলে, প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পেলে গতানুগতিক কাহিনী থেকে অত্যাধুনিক কাহিনীতে প্রবেশ করলাম আমরা। কিন্তু কেন সেই স্বর্ণোজ্জ্বল চলচ্চিত্র থেকে বঞ্চিত হলাম তা কেউ ভেবে দেখিনি। এত আধুনিক হওয়া সত্ত্বেও দর্শক কেন চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল তা অনুভব করিনি কেউ।

সিনেমা হলে গিয়ে সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্র দেখার উৎসাহ কেন হারিয়ে ফেলল তা বুঝবার দরকার ছিল চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, বাংলা চলচ্চিত্রে একশ্রেণির অপেশাদার ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশ করেন যারা সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে না জেনে ব্যবসাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

তাদের ধারণা সমাজের নিম্ন আয়ের বা নিম্ন শ্রেণির মানুষের পছন্দের ছবি তৈরি করলে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু এ ধারণাটা যে সম্পূর্ণ ভুল তার প্রমাণ সিনেমা হলগুলো ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাওয়া। যা হোক, সেই জায়গাটি থেকে ফেরার চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরেই।

কিন্তু পুরোপুরি ফেরা সম্ভব হচ্ছে না হয়তো সেই চক্র থেকে বের হওয়া দুঃসাধ্য বলে। কিছু ভালো চলচ্চিত্র এখনো যে নির্মিত হচ্ছে না, তা নয়। হচ্ছে, তবে সেগুলোর দর্শক যথেষ্ট কমে গেছে। এক শ্রেণির দর্শকের হলে গিয়ে ছবি দেখার অভ্যাস বন্ধ হয়ে গেছে। এবং এক শ্রেণির দর্শক না যেতে পারছেন সাধারণ সিনেমা হলে, না যেতে পারছেন যমুনা ফিউচার পার্ক বা বসুন্ধরার মতো উঁচু মানের হলগুলিতে।

এক জায়গা পরিবেশের অভাব, এক জায়গা অর্থের অভাব। সুতরাং বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে যদি চলচ্চিত্রকে আমরা একটি শিল্প-সংস্কৃতির উচ্চ স্থানে দেখতে চাই। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কিছু চলচ্চিত্রের কথা বলা হয়, সেগুলো দেখতে গেলেও অতটা স্বস্তি পাওয়া যায় না।

যেমন ‘আয়নাবাজি’ বা ‘দেবী’ নিয়ে হইচই বা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা থাকলেও ছবি দেখার পর অতটা আকর্ষণ করতে পারেনি যতটা করেছে ‘অজ্ঞাতনামা’। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমরা ‘জীবন থেকে নেয়া’র ধারে-কাছেও যেতে পারছি না। অর্থাৎ জীবন-ছোঁয়া ছবি আর দেখতে পাচ্ছি না। এই পরিধি ডিঙাতে হবে- এখনই সময়।

আমাদের মঞ্চনাটক আশির দশকে খুব উজ্জ্বলতা পায়। আশার কথা যে এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। মঞ্চ নাটকের জলুস একটুও কমেনি। সে সময় মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মিলনায়তনে অধিকাংশ নাটক মঞ্চস্থ হতো। সময়ের বিবর্তনে এখন মিলনায়তনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্পকলা একাডেমিতে বেশ আধুনিকীকরণ করে হল নির্মিত হয়েছে।

থিয়েটার আরও জনপ্রিয় হয়েছে। দর্শকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুবচন নির্বাসনে, কেরামতমঙ্গল, বার্থ ফ্যান্টাসি, কিত্তনখোলা, নূরলদীনের সারাজীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, গণনায়ক, কোর্ট মার্শাল, ইঙ্গিত প্রভৃতি নাটকের পাশাপাশি বেশ কিছু অনূদিত নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে যার মধ্যে ওথেলো, ম্যাকবেথ, কঞ্জুস, ভদ্দরনোক, গ্যালিলিও অন্যতম।

সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান মঞ্চ নাটকগুলো আরও গতিশীল হয়েছে, আরও তথ্যনির্ভর হয়েছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রাচের কর্নেল থেকে শুরু করে হাছনজানের রাজা, বাংলার মাটি বাংলার জল, পঞ্চনারী আখ্যান, মুক্তি, ওপেন কাপল নাটকগুলো একটি বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আধুনিক নাট্যচর্চা চলছে তাতে আশা রাখতে পারি আমাদের মঞ্চনাটকের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল। আমরা ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ পথনাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি এই নাটকের অভিনেতা লিয়াকত আলী লাকি, মজিবুর রহমান দিলু ও অন্যান্যের অভিনয় দেখে।

এখন সেই মুগ্ধতার জায়গা তৈরি হচ্ছে না। তাছাড়া মঞ্চ নাটক ছিল অভিনয় শেখার অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। বর্তমানে অনেক টিভি চ্যানেল হওয়ায় এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০টি নাটক নির্মাণ/প্রচার হওয়ায় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সেই তুলনায় অভিনয়ের মান বাড়ছে না।

এবার আসি টিভি নাটকের কথায়। এক কথায় বলতে গেলে টিভি নাটকের মান ক্রমশ নিম্নমুখী। বছরে হাতেগোনা দুএকটি নাটক ছাড়া তেমন ভালো নাটক নির্মাণ হচ্ছে না। ধারাবাহিক নাটকের দৌরাত্ম্যে মূল নাটক ম্লান হয়ে যাচ্ছে। গতানুগতিক গল্পের বাইরে টিভি নাটক যেতে পারছে না বলে দর্শকও হ্রাস পেয়েছে অস্বাভাবিকভাবে।

আশির দশকে একমাত্র বিটিভি ভরসায় যে নাটকগুলো তৈরি হতো তা দেখার জন্য দর্শক রাস্তা খালি করে বাসায় ফিরত। বাবার কলম কোথায়, বকুলপুর কতদূর, স্বপ্নের পৃথিবী, নিলয় না জানি- এরকম সব নাটক দর্শককে মুগ্ধ করে রাখত। নব্বই দশকে নাটকের দৈন্যদশা শুরু হয়। তখনো হুমায়ূন আহমেদ ভরসার জায়গাটি ধরে রাখেন।

আশির দশকে প্রচারিত তাঁর ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’ অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। এরপর কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, উড়ে যায় বকপক্ষী ও অন্যান্য ধারাবাহিকও সমান জনপ্রিয় হয়। কী কারণে জানি না, হতে পারে প্যাকেজ নাটক আসার কারণে- অনেক প্রভাবশালী লেখক ও নাট্যনির্মাতারা একটু দূরে সরে যান।

আব্দুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, মমতাজ উদদীন আহমেদ, আল মনসুর- এঁদের মতো যোগ্য লেখক/নির্মাতার উপস্থিতি অনেক কমে যায়; ফলে যে নতুনদের আগমন ঘটে, হাতেগোনা কয়েকজন বাদে কেউ তেমন বক্তব্যধর্মী নাটক নিয়ে হাজির হতে পারেননি।

বর্তমান অবস্থা আরও নাজুক। দেখা যায় একই পরিবারের সদস্য কেউ বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়, কেউ নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়, কেউ পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। শুধুমাত্র আনন্দ দেয়ার কথা মাথায় রাখলেই তো চলে না, সামঞ্জস্য থাকা উচিত। জোরপূর্বক আনন্দদানের চেষ্টা বৃথা এ কথা তারা বুঝতে সক্ষম নন।

আঞ্চলিক ভাষায় হলেও সেটা অনেক আবেদন রাখতে পারে, যেমন- আনিসুল হকের লেখা ‘নাল পিরান’। সুতরাং বিষয়টি নির্মাতা ও নাট্যকারদের ভাবা দরকার। ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর মুখে ‘আইছিলা-গেছিলা’ জাতীয় শব্দ প্রয়োগ করায় সামাজিকভাবেও এর প্রভাব পড়ে এবং তা পড়েছে।

এ বিষয়গুলোও ভাবা দরকার। এতগুলো চ্যানেল অথচ মানসম্মত লেখার বড়ই অভাব। এর পেছনে হয়তো অন্য কারণ থাকতে পারে যা ‘বিজ্ঞাপন’ দিয়েও হয়তো বুঝতে পারব না।

আমাদের সংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে নৃত্য। নৃত্যের মাধ্যমে আমাদের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যও তুলে ধরা যায় ভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছে। অনেকে আমাদের ভাষা না বুঝলেও নৃত্যের কলাকৌশলে বুঝে নিতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, পূজা-পার্বণসহ দেশজ উপাদানসমূহ।

নৃত্যকলার বিস্তার লাভে বুলবুল চৌধুরী, গওহর জামিল থেকে শুরু করে রাহিজা খানম ঝুনু, আমানুল হক প্রমুখের অবদান রয়েছে। এখনো সেই ধারাবাহিকতায় নৃত্যকলার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। এখন শুধু গৎবাঁধা তালেই নৃত্য উপস্থাপন হচ্ছে না, অনেক কৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন মাত্রা যোগ করে উপস্থাপিত হচ্ছে।

এই মাধ্যমটি বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রমশ। যে কোনো পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান বা জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে নৃত্য পরিবেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। শুধু গানের সঙ্গেই নয়, কবিতার সঙ্গেও নৃত্য মানিয়ে যাচ্ছে দারুণভাবে। নৃত্য পরিচালনায় ব্যতিক্রম কাজ করে যাচ্ছেন শামীম আরা নীপা, শিবলী মোহাম্মদ, ওয়ার্দা রিহাব, কবিরুল ইসলাম রতন প্রমুখ।

সংস্কৃতির আরেকটি বড় মাধ্যম হলো সঙ্গীত। বাংলা সঙ্গীত অনেক সমৃদ্ধশালী। আমি মনে করি না বাংলা সঙ্গীতে যত ধরন আছে তা অন্য কোনো ভাষার সঙ্গীতে আছে। উনিশ শতকের গোড়া থেকেই আধুনিক বাংলা গান ক্রমশ আধুনিকতর হয়ে আমাদের উদ্বেলিত করে চলেছে।

পল্লীগীতি, ধুপো, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মাইজভাণ্ডারি, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, দেশাত্মবোধক, আধ্যাত্মিক, বাউল, মারফতি, শ্যামা, কীর্তন, ইসলামি গান ছাড়াও নানারকম বিষয়ভিত্তিক গানের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কোনো কোনো গান রচয়িতার নামেও বাংলাগান সমৃদ্ধ হয়েছে।

তাঁদের মধ্যে আছেন অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকির, হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিম, উকিল মুনশি, জালাল উদ্দীন খাঁ, পাগলা কানাই, শেখ ভানু প্রমুখ।

শুধু শ্রবণতুষ্টি বা আত্মতৃপ্তিই নয়, যুগে যুগে অনুপ্রেরণাও দিয়েছে অনেক গান। মহান মুক্তিযুদ্ধেও গান থেকে অনুপ্রেরণা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় হাতিয়ার। অনেক অনেক গান এত বাণীসমৃদ্ধ ও সুরসমৃদ্ধ যে সাধারণ মানুষের অন্তর ছুঁয়ে আছে।

দেশকে ভালোবাসার অনুপ্রেরণাও দিয়েছে অনেক গান, যেমন- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন, যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে কী দেখেছি, যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে,

আমায় যদি প্রশ্ন করে আলো-নদীর এক দেশ, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, যদি আমাকে জানতে সাধ হয় বাংলার মুখ তুমি দেখে নিও প্রভৃতি।

যে গান আমাদের সংস্কৃতিকে এত উচ্চতায় নিয়ে গেছে সেই গান নিয়ে এখন অনেকটা শঙ্কিত। সঙ্গীত নিয়ে শঙ্কার কথা বলতে দ্বিধা নেই একটুও। কারণ সঙ্গীতে মানুষের প্রাণ মিশে থাকে। কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পশ্চিমা ধাঁচকে গ্রহণ করতে বা ধারণ করতে গিয়ে বাণী ও সুরে খামিরা মিশাল পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই গানের বাণীতে পরিবর্তনের ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে।

এই পরিবর্তন বুমেরাং হয়ে দেখা দিচ্ছে। সাময়িকভাবে গানটি হয়তো এক শ্রেণির শ্রোতার কাছে প্রিয় হচ্ছে, কিন্তু তার স্থায়িত্ব নেই। শুধুমাত্র ব্যবসায়িক চিন্তা থেকেই এগুলো করা হচ্ছে। আজকাল ইউটিউবের ভিউয়ার্স দিয়েও গানের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হচ্ছে যেটা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়।

তাছাড়া গান শোনার চেয়ে দেখার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে সবই মেনে নিলাম, কিন্তু মূল বিষয় থেকে আমরা যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে না যাই। আমাদের গানের ভাণ্ডার খুবই সমৃদ্ধ। এই জায়গাটি ধরে রাখা এবং ভাণ্ডার বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি।

আশার কথা যে কিছু কিছু তরুণ খুব ভালো গানের কথা লিখছেন এবং ব্যতিক্রম সুরও দিচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু অনেক মন্দের ভিড়ে সেই ভালো কাজগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। স্থায়ী হতে পারছে না। গত শতকের বিশের দশকের শেষ দিক বা তিরিশের প্রথমদিকে লেখা অনেক নজরুলগীতি বা তার আগে লেখা রবীন্দ্রসঙ্গীত এখনো মানুষ কান পেতে শোনে।

চল্লিশের দশকে গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের কণ্ঠে গীত ‘এনেছি আমার শত জনমের প্রেম’ এখনো অনেক শ্রোতাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে এবং পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরাও এই গান কণ্ঠে তুলে আনন্দ পান। এরকম হাজারো গান বাঙালির অন্তর ছুঁয়ে আছে। আমি চাই আজকের গানটিও একশো দুইশো বছর পরেও মানুষ সমান আগ্রহ নিয়ে শুনবে।

আমি আশাবাদী। আমার সর্বশেষ শোনা ভালো একটি গানের কথা দিয়ে শেষ করছি। কবির বকুলের লেখা, রাজিব দাস হিল্লোলের সুরে শফিক তুহিন ও ইয়াসমিন লাবণ্যর কণ্ঠে ‘জোছনা পড়ে গলে গলে ঘুমায় বালুচর’। এরকম গান আরও হোক, স্থায়িত্ব পাক।

আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে অবস্থিত কয়েকটি বিষয়, যথা- চলচ্চিত্র, মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক, নৃত্য ও সঙ্গীত নিয়ে অল্প পরিসরে কিছু কথা এই নিবন্ধে উপস্থাপন করা হলো। এই বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করা ও অধিক উদাহরণসহ বলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

যারা পরবর্তীতে সংস্কৃতির ধারক-বাহক হবেন তাদের জন্য জেনে থাকা ভালো যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া কাজের চেয়ে স্থায়ীভাবে টিকে থাকার কাজ করা অনেক ভালো। বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, নতুন নতুন ভাবনা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে।

প্রতিশ্রুতিশীল অনেক তরুণই এইসব মাধ্যমে কাজ করছেন। তারা আমাদের সংস্কৃতিকে আরও বিকশিত করবেন, আরও সমৃদ্ধ করবেন বলেই বিশ্বাস।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App