×

বিশেষ সংখ্যা

দেশের প্রথা ভাঙা গদ্যসাহিত্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৫:০২ পিএম

স্বাধীনতা উত্তরকালে দেশের রাজনীতির নিদারুন পতন-উত্থান, বেল বটম প্যান্ট আর বড় ঘড়ি পরার ফ্যাশন, ফেরদৌস ওয়াহিদ, আজম খান, ফকির আলমগীর, পিলু মমতাজের আধুনিক ঢংয়ের বাংলা গান, নায়ক রাজ রাজ্জাকের রংবাজ, সালাউদ্দিন জাকীর ঘুড্ডি, আলমগীর কবিরের সীমানা পেরিয়ে-নতুন নিরীক্ষায় ঢাকার বাংলা সিনেমা, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দেওয়ান গাজীর কিসসা, কথা ’৭১-এর মতো সাড়া জাগানো মঞ্চ নাটক, সুবর্ণা-আফজালের পারলে না রুমকী, বুলবুল আহমেদ অভিনীত ইডিয়ট, বরফ গলা নদীতে মিতা চৌধুরী, ফেরদৌসী মজুমদারের কালো স্যুটকেস মতো টিভি নাটকের আধুনিকতার ছোঁয়ায় চারদিকে প্রথা ভাঙার বা নতুনের জয় কেতনের ওড়ানোর সময় চলছিল। এর থেকে বাদ যায়নি বাংলা সাহিত্যও। সাহিত্যের শাখা অনেক বিস্তৃত, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কি নয়। কবিতায় রাজত্ব করেছেন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, শহীদ কাদরী প্রমুখ। জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার পাশা, মুনীর চৌধুরীদের অনুপস্থিতিতে বাংলা উপন্যাসকে সামনে এগিয়ে নিতে এসেছেন সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, শওকত ওসমান, আহমদ ছফা, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ। এখানে শুধু কয়েকটা গদ্য নিয়ে আলোচনা করব, সাহিত্যের সব শাখা নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে একটা বড় উপন্যাসের চেয়েও বড় হয়ে যাবে লেখা। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রয়াত লেখক সৈয়দ শামসুল হকের হাত ধরে সম্ভবত প্রথম নেতিবাচক চরিত্রের নায়কের আগমন ঘটে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যে। ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসের নায়ক বাবর আলী টেলিভিশনের জনপ্রিয় একজন উপস্থাপক যিনি একা থাকেন ঢাকার একটি ফ্ল্যাটে। তিনি সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণীদের সঙ্গে সঙ্গমে প্রবল আগ্রহ বোধ করেন। বাংলা সাহিত্যে এই উপন্যাসটিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে বরাবর কিন্তু উপন্যাসে বাবর আলীর চরিত্রের অন্যান্য দিক কেমন করেই যেন অনেক পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। আত্মদহন, মনের গভীর গোপন দুঃখ শরীরের উত্তাপে শীতল করে বেঁচে থাকতে চাইত বাবর আলী। এই উপন্যাসটিই সম্ভবত বাংলাদেশের পাঠককুলের দ্বারা সবচেয়ে ভুল দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা উপন্যাস। লেখকের নিজের ভাষাতে, ‘রচনার প্রায় কুড়ি বছর পরও এর জন্য আমাকে আমার অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়। আমি খুব কম পাঠককে জানি, যিনি উপন্যাসের একেবারে শেষ বাক্যটি লক্ষ করেছেন। আমার বিশ্বাস, এই শেষ বাক্যটিতে দাঁড়িয়ে কেউ এ উপন্যাসের জন্যে আমাকে তিরস্কার করতে পারবেন না।’ সর্বদা অস্থিরতায় ভোগা এক মানুষ বাবর, যে মাঝে-মাঝেই আক্রান্ত হয় একাকিত্বে। উপন্যাসে সেই প্রসঙ্গ বারবার ফিরে ফিরে আসে। তাকে যেন ঠিক চেনা যায় না, জগৎ যে চেনে, যার নিজস্ব কিছু দার্শনিক চিন্তা মাঝে-মাঝে চমকে দিয়ে যাচ্ছে পাঠককে। বাবর আলীর কিছু ভাবনা যা আমাকে ছুঁয়ে গেছে, ‘তুমি আছ অতীত ভবিষ্যতের মাঝখানে, আগেও যেখানে ছিলে, পরেও সেখানে থাকবে।’ কিংবা ‘যা ভালোলাগে তা ধরে রাখা বোকামি। মানুষ ধরে রাখতে চায় বলেই দুঃখ পায়। আসলে সব কিছুই একটা স্রোতের মতো। সুখ, ঐর্শ্বয, জীবন, আকাশ, বিশ্ব, মহাবিশ্ব, ছায়াপথ, তারকাপুঞ্জ, সব কিছু। সবকিছু মিলে আমার কাছে প্রবল শুভ্র জ্বলন্ত একটা মহাস্রোত মনে হয়। দুঃসহ কষ্ট হয় তখন। আমার জীবনে যদি একটা কোনো কষ্ট থাকে তাহলে তা এই। এই মহাস্রোতের সম্মুখে আমি অসহায় তুচ্ছ, আমার অপেক্ষা সে রাখেন না। তুমি আমি এই শহর, মহানগর, সভ্যতা সব অর্থহীন বলে মনে হয়। আমি কি করলাম, তুমি কি করলে, ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্য, মনে হয় সবই এক, সব ঠিক আছে – কারণ সবই কত ক্ষুদ্র।’ এসব ভাবনায় কি আমরা আসলে আলাদা বাবর আলীকে দেখতে পাই না? আমরা দেখি, বাবর আলী চট্টগ্রামে দুপুরে ঘুমিয়ে তার বাবাকে স্বপ্ন দেখেছে আর রাতে ফেরার পথে বিমানে বসে রাতের ঢাকাকে ‘ছেলেবেলার জোনাক জ্বলা বনের মতো’ লাগছে। ‘জোনাক জ্বলা বন’ আর ‘কাজলা দিদি’ যেন বাঙালির শৈশব-কৈশোরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপন্যাসের শেষে দেখি বাবর জাহেদা নয় হাসনুকেই উদ্ধার করেছে। কৈশোরে বোনকে রেখে পালিয়ে আসার ফলে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সীমাহীন গ্লানি, অপরাধবোধ, যন্ত্রণা ও অনুতাপ; এসব ভুলে থাকার জন্য সে বেছে নিয়েছিল প্রতারণা ও লাম্পট্যের পথ, আর নিজের পরস্পবিরোধী এই দুটো চরিত্র তাকে করে তুলেছিলো দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা বাংলা সাহিত্যের আর একটি মাইলফলক। মেদহীন লেখা, কল্পনার রামধনুতে ভর করে হেঁটেছেন তিনি ভিন্ন পথে। রাজনৈতিক উপন্যাস লিখতে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি থাকে। সমসাময়িক ঘটনার বাস্তবতা আর লেখাতে যদি অমিল থাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণি, বস্তিবাসী, গ্রামের সাধারণ মানুষরাই তার উপন্যাসের চরিত্র, কোনো নামকরা, বিখ্যাত মানুষজনদের তার উপন্যাসে রাখেননি। উপন্যাসের নায়ক আসলে উনিশো ঊনসত্তর সাল। এ সময়টিকে ধারণ করে আছে তৎকালীন পূর্ববাংলার ঐতিহাসিক গণজাগরণ। ইতিহাসের এ সময়কে চিত্রিত করতে আন্দোলিত সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে অনেক চরিত্রকে তুলে ধরেছেন লেখক। তাই সে সময়ের অনুষঙ্গ হিসেবে দুটি বিষয় এসেছে এ উপন্যাসে- মিছিল ও রাজনীতি। গল্পের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনোয়ার আর আলতাফ। সঙ্গে আছে রিকশা চালক খিজির। আলতাফ ডানপন্থি আর আনোয়ার বামপন্থি। এই দুই বন্ধুর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লেখক সে সময়ের মানুষের দুই ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমাদের বিশদভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন। ঢাকার এক সস্তার গলিতে ওসমানের বাসা, এক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App